বাংলা আমার জীবনানন্দ বাংলা প্রানের সুখ। আমি একবার দেখি বারবার দেখি দেখি বাংলার মুখ
১(এক)
সালটা ছিল ১৯৯৪। আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতি পরিবারেই গরু ছিল। কিন্তু অভাব ছিল ষাঁড় বা বলদের। আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে একটি বলদ ছিল।
প্রজননের প্রয়োজনে গরুগুলোকে সেখানে নেওয়া হত। তবে বর্ষার দিনে ব্যাপারটা খুবই কষ্টদায়ক ছিল। তাই আমদের গন্যমান্য ব্যক্তিগন চিন্তা করল এর একটা বিহিত করার জন্য। আমাদের গ্রামের সবাই বসল। সেখানে আমাদের গ্রামের মেম্বার হাশেম কাকা প্রস্তাব করলো তিনি এ সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রামে একটা বলদ গরু উপহার দিতে চান।
তার এ উপহারে গ্রামের সবাই খুশি হল।
তবে তিনি শর্ত দিলেন যে তিনি শুধু বলদ দিবেন কিন্তু এর দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। এর দায়িত্ব গ্রামের অন্য কাউকে নিতে হবে। কিন্তু গ্রামের কেউ বলদ পালতে এবং এর দায়িত্ব নিতে রাজি নন। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো বলদটিকে গ্রামে ছেড়ে দেওয়া হবে।
যার যা খুশি একে খাওয়াবে। এমনকি এটি ক্ষেতের ফসল নষ্ট করলেও একে কিছু বলা যাবেনা। যথা সম্ভব তাড়িয়ে দিতে হবে। এই সিদ্ধান্তে সবাই ঐক্যমত পোষণ করল এবং সেদিনের মতো মিটিং শেষ হলো।
১ সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামে এসে পড়ল ছোট্ট একটি বাছুর বলদ।
সারা গ্রামময় ঘুরে বেড়ায় বলদটি। ছাড়া বলদ নামেই পরিচিতি ছিল এটির। গ্রামের মহিলারা বলদটিকে খাবার দেয়, ভাতের মার দেয়। ছোট ছোট বাচ্চারা এটি নিয়ে খেলা করে। গ্রামের লোকদের আর দূর গ্রামে যেতে হয়না।
গ্রামের সবাই খুশি। খুশি মেম্বারের উপরও তার এই মহান আত্নত্যাগের জন্য। হাশেম কাকার জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে।
কিন্তু বছর না পেরোতেই সবার খুশি ফিকে হয়ে আসতে শুরু করল। প্রিয় ছাড়া বলদটি তাদের কাছে হয়ে উঠল চরম শত্রু।
পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ায় বলদটি বছর না পেরোতেই বেশ রিষ্ট- পুষ্ট হয়ে উঠল। বাড়তে লাগল তার যন্ত্রনাও। বাগানের চাড়া গাছ নষ্ট করে ফেলে। ক্ষেতের ফসল খেয়ে সাবার করে। ফসল নষ্ট করে ফেলে।
কোন গরু দেখলেই বলদটি সেটির কাছে গিয়ে গুতো দেয়। গ্রামের স্কুলগামি মেয়েদের লাল রংএর ইউনিফর্ম থাকার কারনে তাদের দেখলেই তেড়ে আসত। তাই গ্রামের অনেক স্কুল ছাত্রী বাধ্য হয়ে বোরকা ধরে। অনেক মা-বাবা তাদের মেয়ের জন্য প্রাইভেট রিক্সার ব্যবস্থা করে। অনেক মেয়েই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
বলদ দেখলেই ছোট্ট বাচ্চারা চিৎকার শুরু করে। মহিলার বলদটিকে দেখলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে ভয়ে। বাচ্চাদের বলদের ভয় দেখিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়, ঘুম পড়ানো হয়।
হাশেম কাকার জনপ্রিয়তাও দিনে দিনে হ্রাস পেতে লাগলো। অবশেষে আবার মিটিং আহবান।
কি করা যায় ছাড়া বলদ নিয়ে। অবশেষে মেম্বার হাশেম কাকা একটা বক্তৃতা রাখলেন। তার সার কথা ছিল তিনি গ্রামের মানুষের কল্যানের কথা চিন্তা করে বলদ ছেড়েছেন। এতে গ্রামের মানুষের উপকারও হয়েছে। তিনি চান বলদটি এভাবেই থাকুক।
যদি গ্রামবাসি এটি না চান তবে তিনি বলদটি উঠিয়ে নিবেন। যেহেতু বলদটি তিনি দিয়েছেন সেহেতু বলদটি তারই। তবে তিনি আরো প্রস্তাব করলেন এটি জবাই করে এর অর্ধেক গ্রামের দরিদ্র লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তাবে তা যদি না হয় তাহলে বলদটি এভাবেই থাকুক।
গ্রামের মানুষ অনোন্যপায়।
ভিক্ষা চাইনা কুত্তা খেদাও অবস্থা। মেম্বার সাহেবের কথায় সবাই রাজি হলেন। হাশেম কাকার ছেলে নোভেল তার লোকজন নিয়ে বলদটিকে পাকরাও করলেন। কিছুদিনের মধ্যে হাশেম কাকার মেয়ের বিয়েতে সেই বলদটি জবাই বিয়ের মেহমানদারী সারলেন। শেষ হয়ে গেল ছাড়া বলদের ইতিহাস।
২ (দুই)
মেম্বার হাশেম কাকার ছেলে নোভেল। দুষ্টের শিরোমনি। এলাকার সব দুষ্ট ছেলেরা তার বন্ধু। তার সম্পর্কে সবার মুল্যায়ন হলো নোভেল পারেনা এমন কোন খারাপ কাজ নেই। নোভেল আমারই ক্লাসমেট।
একদিন স্যার আমাদের ক্লাশে জিজ্ঞেস করলেন "বলতো ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে কে?" সবাই এক কথায় বলল জুয়েলের নাম। কারন সে ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্ষ্ট বয়। কিন্তু স্যার বললেন সবচেয়ে মেধাবী ছেলে হলো নোভেল। আমরাতে থ! স্যার ব্যাখ্যা করেলেন এভাবে যে, ও দুষ্টুমিতে যে মেধা ব্যাবহার করে তা যদি পড়ালেখায় ব্যবহার করতো তাহলে সে জুয়েলের চেয়ে অনেক ভাল ছাত্র হতে পারতো। তো এই হলো আমাদের নোভেল।
প্রতিদিন বিকেল ৫ টায় শুরু হতো তার ও তার দলের কার্যক্রম। চলত রাত ১২ টা পর্যন্ত। আমাদের গ্রামের ঠিক পাশের গ্রামে একটি ব্রীজ ছিল। নাম গাজীর ব্রীজ। সেই ব্রীজ ই ছিলো তার প্রধান আস্তানা।
আমরা এসএসসি পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিয়ে একই সাথে বাড়ি আসতাম। একদিন গল্পে গল্পে সে বলল দেখিস পরীক্ষার পর আমি ছাড়া বলদ হয়ে যাব। আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম ছাড়া বলদের কার্যক্রম কি হবে। তোর বাবাতো একটা বলদ ছাড়ছিল। ভালইতো কাজ দিচ্ছিল।
তুই কি তোদের সেই বলদের অভাব পূরণ করবি? ও বলল সেটা সময় মতো দেখতে পাবি।
যাক পরীক্ষা শেষ হলো। আমাদের সেই নোভেল গেল চিটাগাং তার কাকার কাছে। শুনেছিলাম তার কাকা তাকে কোন ছোট খাট কাজে ঢুকিয়ে দিবে। কিন্তু আমাদের চমকে দিয়ে সে এক মাসের মাথায় বাড়ি চলে এল।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার দল গুছিয়ে ফেলল। যথারীতি ব্রিজটিও প্রান ফিরে পেল তাকে পেয়ে।
ইতোমধ্যে পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমাদের নোভেল সকলের আশা অনুযায়ী ফেল করল। আমি চলে এলাম ঢাকায় পড়ালেখা করতে।
কিছুদিন পরেই শুনতে পেলাম আমাদের নতুন ছাড়া বলদ নোভেলের উৎপাতের খবর। গ্রামের মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মানুষের পুকুরের মাছ চুরি করে বিক্রি করে। খোয়ার থেকে ছাগল চুরি করে পিকনিক করে। হিন্দুদের মুর্তির সামনের খাবার চুরি করে খেয়ে ফেলে।
মুনুষের গাছের রস চুড়ি করে খায়। যাওয়ার সময় হাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আবার হাড়ির মধ্যে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করে রেখে যায়। রাতে ক্ষেতের ফুট, তরমুজ, ক্ষিরা ইত্যাদি নষ্ট করে। মানুষের কবুতর চুরি করে।
রাতের বেলা লুকিয়ে থেকে বিভিন্ন মাহিলাদের ভয় দেখায় ইত্যাদি অজশ্র অভিযোগ। তার এমন কার্যক্রমে হাশেম কাকাও অস্থির। কিছুতেই তাকে নিয়ন্ত্রনে আনা যাচ্ছেনা।
এমনি একদিন সে রাতে গিয়েছিল চেয়ারম্যানের বাড়ি। তার খোয়ার থেকে ছাগল চুরি করে পিকনিক করবে।
হয়তবা তার দলের কেউ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকা করেছিল। চুরি করতে গিয়ে ধরা খায় চেয়ারম্যানের লোকদের হতে। চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে খুব শান্তি দেয়নি। রাতেই পিটিয়ে দুই হাত ও দুই পা ভেঙ্গে আমাদের হাশেম কাকার বাড়ির সামনে রেখে আসে। যথারীতি তার দলের লোকজন বাড়িতে খবর দেয়।
অবশেষে তার স্থান হয় থানা হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল।
২মাস তাকে কাটাতে হয় মেডিকেলের বেডে। যখন সুস্থ হয় আমরা তাকে দেখতে যাই। জিজ্ঞেস করি কিরে এখন কেমন লাগছে। ও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
বলে আর জীবনেও গ্রামে যাবনা। তোরা আমাকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দে। যদি চাকুরি না দেস তবে তোদের কাছে ১ মাস করে থাকব। সব খরচ তোরা দিবি।
তবে আমদের নেভেলকে আমাদের কাছে থাকতে হয়নি।
সে সুস্থ হলে তার কাকা এসে তাকে নিয়ে যায় চিটাগাং। সেখানে ২ বছর থেকে সেজা দুবাই। সেই থেকে এখনো সে দুবাই। বিয়ে করে বউ নিয়ে সেখানেই থাকছে। আমার জানা মতে নোভেল আর গ্রামে যায়নি।
যাক এভাবেই শেষ হলো আমাদের ছাড়া বলদ নোভেলের ইতিহাস।
৩(তিন)
আমাদের ছাত্রলীগ। হ্যঁ আমাদের ছাত্রলীগ। বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র সংঘঠন যারা প্রকাশ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতে পারছে। বর্তমানে সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্র সংঘঠনের কার্যক্রম অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে।
হয়তবা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত করার একটি প্রকৃয়ার অংশ হিসেবে ছাত্র রাজনীতি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। সেখানে একমাত্র ছাত্র সংঘঠন হিসেবে ছাত্রলীগ তাদের কার্যক্রম বীরদর্পে অব্যহত রাখতে পেরেছে। এটা ছাত্র রাজনীতির জন্য একটি বিজয় বৈ কি!
হ্যাঁ ছাত্রলীগ। বর্তমান দলীয় সরকারের অঙ্গ সংঘঠন। ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত সংঘঠনটি আজ এক জীবন্ত হুংকার সবার জন্য।
এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই সংঘঠনটির তার বিকৃত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। এ সংঘঠনটির একটি অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বক্তৃতা দিতে হয়েছিল কাঁচের একুইরিয়াম থেকে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই তারা মারামারি শুরু করেন যেটা প্রধানমন্ত্রীকে মারার শামিল। তাদের এই অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ত্ব ত্যাগ করেন এবং জানিয়ে দেন ছাত্রলীগের তিনি কিছু নন।
ঠিক তার পর থেকেই ছাএলীগের বিকৃত কার্যক্রম বহুগুনে বেড়ে যায়। ঠিক আমাদের গ্রামের সেই ছাড়া বলটির মতো। এমন কোন দিন পাওয়া যাবেনা যেদিন ছাত্রলীগের কোন মারামারির খবর নেই। এমন কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবেনা যেখানে ছাত্রলীগের ২ গ্রুপের মারামারি হয়নি। হয়তবা এমন কোন কর্মী পাওয়া যাবেনা যে নিজ দলের হাতে মার খাননি।
যে পরিমানে সংঘর্স বা মারামারি হয় তার খুব কম অংশই পত্রিকায় আসে। পত্রিকায় শুধু ভয়াভহ সংঘর্স গুলোর রিপোর্টই আসে। আর এদের অত্যাচারে বিরক্ত হয়নি এমন কেউ নেই। প্রতিদিন কোন না কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে ছাত্রলীগের সংঘর্সের কারনে। এমন কোন হীন কাজ নেই যা ছাএলীগ করছেনা।
চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক বিক্রয়, মহিলা নিপিড়ন, মেয়েদের উত্তক্তকরণ, ছাত্রীদের দিয়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি করানো, ধর্ষণ, গনঘর্ষন, চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানী, শিক্ষক পিটানো, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের পিটানো, পুলিশ পিটানো, নিজের দলের নেতাদের পিটানো অর্থাৎ যত খারাপ কাজ রয়েছে সবার সাথে আছে এই ছাএলীগ। তার ইতিহাস এখনো বিদ্যমান। শেষ হয়নি। কতদিন এভাবে চলতে থাকবে তাও কারো জানা নেই। কে কখনযে ছাএলীগের হাতে পাকরাও হবেন না একথা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীও না।
৪(চার)
আমাদের গ্রামের সেই ছাড়া বলদটি শুধু মানুষকে যন্ত্রনা দিত। কিন্তু কারো কখনো বড় ধরণের ক্ষতি করেনি। আমাদের ছাড়া বলদ নোভেল দুষ্টের শিরোমনি হলেও কখনো কোন ছেলেকে মেরেছে বা কোন মেয়েকে উতক্ত করেছে এমন কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমাদের ছাড়া বলদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই এমন কোন অপরাধ পাওয়া যাবেনা।
আমাদের গ্রামের ছাড়া বলদটির ইতিহাস শেষ হয়েছে তাকে মেম্বার হাশেম কাকার উঠিনে নেওয়ার কারণে। আমাদের ছাড়া বলদ নোভেলের বলদামির ইতিহাস শেষ হয়েছে চেয়ারম্যানের লোকদের হাতে মার খাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের ছাড়া বলদ ছাত্রলীগের এই বিকৃত, জঘন্য, বর্বর কার্যক্রম কিভাবে বন্ধ হবে? কে বন্ধ করবে? কবে বন্ধ হবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।