সত্যানুসন্ধিৎসু
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ (পাবনা)
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। একটু আগেই পাকবাহিনীর পেতে রাখা টিএনটি চার্জারের পরিকল্পিত বিষ্ফোরণে উপমহাদেশের বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিগত সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধে খুলনা-যশোহর-কুষ্টিয়া-ফরিদপুরের বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত ও দিশেহারা হাজার হাজার পাক-আর্মি পদ্মানদী পার হয়ে পাবনা জেলায় ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় প্রকাশ করা হচ্ছে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি। আমাদের আভ্যন্তরীণ সংবাদদাতারাও একই খবর দিয়েছে।
সেসব খবরের ভিত্তিতে আমরা ১৩ ডিসেম্বর রাত দশটা থেকেই কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী সড়কের প্রায় ৭ কিলোমিটার জুড়ে এ্যাম্বুশ পেতে বসে রইলাম রাতভর। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পলায়ণপর পাকবাহিনীর অগ্রগামী দলটি এ্যাম্বুশে পড়ামাত্র গর্জে উঠলো প্রায় ৫ শ' মুক্তিযোদ্ধার সকল অস্ত্র। পায়ে হেঁটে আসা শত্রুসেনার দলটি নিমেষেই মাটির সাথে মিশে গেল রাস্তার দু'পাশে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায়। সেই শুরু থেকে সারাদিন ধরে চলছে তুমুল যুদ্ধ। মাথার ওপর বারে বারে চক্কর দিচ্ছে স্বাধীন বাংলার মিগ-২১ জঙ্গী বিমান - যেখানেই পাকবাহিনী সেখানেই হামলা।
পরাজিত পাকবাহিনী ঈশ্বরদীর দিকে আসছে যশোহর-কুষ্টিয়ার দিক থেকে সড়কপথে পায়ে হেঁটে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ওপারে অগ্রসরমান মিত্রবাহিনীর কমান্ডার লে.জেনারেল আর.এন.রাইনা ও তার দল ৪ মাউন্টেইন ডিভিশন ও ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের বিশাল বাহিনী তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ.মঞ্জুর-এর অধীনস্ত দশ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যেই পতন ঘটেছে যশোহর সেনানিবাসের আর সেই সাথে মুক্ত হয়েছে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মাগুরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বিশাল এলাকা। আসন্ন বিজয়ের পদধ্বনি আনন্দ উদ্বেলিত করেছে তাদের গত নয় মাসের সদা শঙ্কিত মন।
শুধু তারাই বলি কেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হয়ে আনন্দ উচ্ছল প্রতিটি বাঙালিই। কোথাও একটু জোরে শব্দ হলেই কেউ একজন বলে ওঠে, "ঐ যে আমাদের বিচ্ছু বাহিনীর বোমা পড়লো। " এমনকি মেঘের গর্জনও কথিত হয় বোমার শব্দ বলে।
যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা
হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সংলগ্ন ছোট্ট রেল শহর পাকশী।
বৃটিশ রাজত্বকালের তৎকালীন ইউরাপীয়ান অফিসার্স কলোনীর সুইমিং পুলের চৌবাচ্চার জঙ্গলাকীর্ণ পাড়ে বসে চলমান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চাপা আলোচনা করছিল পাঁচজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। ইরাদ আলী মালিথার জৈষ্ঠ পুত্র ইদ্রিস মালিথা, আজিম উদ্দিন মণ্ডলের পুত্র মনজু, মাহতাব মণ্ডল ওরফে এতিমের পুত্র গেদু এবং মান্নান ও সাত্তার। সেই জঙ্গলের আড়ালে আলোচনায় মত্ত পাঁচজনের মধ্যে হঠাৎ একজনের চোখ গেল পাইলট লাইনের দিকে। কে যেন একজন অচেনা মানুষ গায়ে চাদর জড়িয়ে বিমর্ষ মুখে, দ্রুত পায়ে চারিদিকে শঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপে এগিয়ে চলেছে পাইলট লাইন ধরে ঈশ্বরদীর দিকে। সচকিত হয়ে উঠলো ওরা সকলেই।
"চল না, দেখে আসি কে যায়" বললো একজন।
একমত হলো ওরা। তারপর ঝোপের আড়াল দিয়ে এগিয়ে এলো ওরা পাইলট লাইনের কাছাকাছি। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগন্তুককে। বিমর্ষ পাণ্ডুর মুখ, দু'চোখে হরিণের মত শঙ্কিত দৃষ্টি।
সন্দেহ দানা বাঁধে ওদের মনে! কারণ ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছিল পাক সেনা, রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর লোকরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারিদিকে। হয়ত এদেরই একজন কেউ হতে পারে আগন্তক। সিদ্ধান্ত নিল লোকটাকে চার্জ করবে ওরা। ঝোপঝাড় আড়াল করে সন্তর্পনে এগিয়ে গেল লোকটাকে লক্ষ্য করে। তারপর আকষ্মাৎ ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে ঘিরে ধরলো লোকটিকে।
ঘটনার আচম্বিতে হচকচিয়ে গেল লোকটা। সেই অবসরে একজন সাপটে ধরলো লোকটাকে। তারপর চিৎকার করে বললো, "ওর চাদরের নিচে রাইফেল তাড়াতাড়ি বের করে নে তোরা। "
তড়িৎ গতিতে একজন চেপে ধরলো রাইফেলের বাঁট, তারপর এক হেঁচকা টানে কেড়ে নিল রাইফেলটি। একটানে গায়ের চাদর খুলে ফেললো গা থেকে।
থরথর করে কাঁপছে লোকটা। ওদের মনের মধ্যে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। ঘরবাড়ি সহায় সম্পদ, আত্মীয় স্বজন হারানোর ব্যথা। মা-বোনের সম্ভ্রম হারাবার অপমানের জ্বালা উন্মত্ত করে তুললো ওদের। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পোড়া বাড়ির খা খা করা ভিটেগুলো।
চোখে একে একে জীবন্ত হয়ে দেখা দিল অবাঙালি বিহারিদের হাতে শহীদ হাবিল উদ্দিনের ছেলে রফিক, ইয়ার আলীর ছেলে ইউসুফ, খোরশেদের ছেলে আবেদ, নবীর উদ্দিন প্রামানিকের ছেলে এবাদত, বাঙ্গাল মৌলভীর ছেলে ইসমাইল, রিয়াজের ছেলে শামছের, খেড়ুর ছেলে ইয়ার আলী, রিয়াজের জামাই প্রমুখের মুখ। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ওরা। বৃষ্টির মত বর্ষণ হতে থাকলো কিল-চড়। লোকটার গগণ বিদারী চিৎকারে প্লাবিত হলো মাঠ, ঘাট, প্রান্তর। তারপর স্তিমিত হয়ে এলো সে গগণবিদারী চিৎকার।
একজন থামিয়ে দিলো সকলকে। বললো, "এখানে খোলা রাস্তায় থাকাটা আমাদের ঠিক হচ্ছে না, চল টেনে আড়ালে নিয়ে যাই। "
কথাটা মনে ধরলো সবার। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল সাত্তারের বাড়ির পিছনে সবজি ক্ষেতে। এতক্ষণে তামাশা দেখার লোক জুটেছে বিস্তর।
শুরু হলো হাটুরে পিটুনি। এক সময়ে দেখা গেল অনেক আগেই তার রাজাকার নামের প্রাণটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবজি ক্ষেতেই মাটি চাপা দিল লাশটা। মাটির তলে হারিয়ে গেল একটা মানুষের লাশ। সব শুনে মনে হয়, লাশটা ছিলো একজন পলাতক পাকিস্তানি সেনাসদস্যের।
ইতিমধ্যে সংবাদ এলো, আরো আঠার জনের একটা স্বশস্ত্র রাজাকার দল পাইলট লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে ঈশ্বরদীর দিকে। সতের জনের হাতে সতেরটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, আর একজনের হাতে এক বস্তা গোলাবারুদ। এতক্ষণে পূর্বের পাঁচ জনের সাথে যোগ দিয়েছে স্বশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ট্রুপ যার টীম লিডার জিয়াউল হক। তার কাঁধে একটা এসএমজি। হৈ চৈ করে উঠলো সবাই, "ধর শালাদের।
"
কিন্তু সমস্যা হলো রাজাকার দলটা স্বশস্ত্র। সতেরটা রাইফেল তাদের হাতে, আর এদের সম্বল দুটো এসএমজি, একটা এসএলআর, ৬টা রাইফেল আর কিছু গ্রেনেড। তারপরও রাজাকাররা মুটামুটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। ফলে শক্তিতে ওদের কাবু করা হয়তো অসম্ভব। এদিকে দ্রুত সময় পেরিয়ে সুযোগ নষ্ট হতে চলেছে।
আর দেরি করা যায় না। জিয়াউল আর গেদু কয়েকজন যুবককে এক পাশে ডেকে কী যেন পরামর্শ করলো এক মুহূর্তের জন্য। ততোক্ষণে একজন-দু'জন করে ওদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০/২৫ জনে। তবে বাদবাকিরা সবাই নিরস্ত্র। সবাই ছুটে চললো সিভিল হাট* থেকে উত্তরদিকগামী কাটা সড়ক ডিঙ্গিয়ে পাইলট লাইনের ধারে বিশাল জামগাছ দু’টির আশেপাশের ঝোপের কাছে।
তারপর ঝটপট পজিশন নিলো একেকজন একেক ঝোপের মধে। রাজাকার দলটা যখন পাইলট লাইন ধরে ওদের সোজাসুজি এলো তখন গেদু হঠাৎ চিৎকার করে বললো, "মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। কোনো ফন্দি-ফিকির না করে আত্মসমর্পণ করো তোমরা। যার যার হাতের অস্ত্র দূরে ফেলে দিয়ে মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও। "
হ্যাঁ, কাজ হলো এতেই।
রাজাকাররা দূরে অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র হাতে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো জিয়াউল, গেদু ও তাদের দলবল। বাকি সবাই ছুটে এসে রাজাকারদের ফেলে দেওয়া অস্ত্রগুলি তুলে নিলো যার যার হাতে। ইতিমধ্যে রাইফেল থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে গেদু। একজন রাজাকার পায়ে গুলি খেয়ে উল্টে পড়লো।
আর বাকি সব রেললাইনের ধারে শুয়ে পড়ে শ্লোগান দিতে থাকলো "জয় বাংলা। "
ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছে জনতা। স্লোগান শুনে লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ স্মিত হাসে। কেউ এগিয়ে দিল গামছা, কেউবা দড়ি; আর সেগুলি দিয়ে রাজাকারদের দু’হাত বাঁধা হলো শক্ত করে। তখন সাতাশটা অস্ত্র জনতার হাতে।
তারপর রাজাকারদের নিয়ে চললো মৌলভী পাড়ার পশ্চিমে ঠাকুরপাড়ার জঙ্গলের দিকে। জনতা আগেই থেমে গিয়েছিলো পিছু নেওয়া থেকে। এবার শুরু হলো এসএমজির ব্রাশ-ফায়ার। মুহূর্তের মধ্যেই নিথর হয়ে গেলো আঠারোজন রাজাকারের দেহ। পাকিস্তানি শাসকদের স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলি হলো ওই রাজাকারদল।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এখন আর ইউরোপিয়ানরা নেই। নেই পাকিস্তানিরাও। এখনো ওই পাইলট লাইনটা আগের মতই আছে। তবে ওই রেলপথে কোনও পাইলট ট্রেন আর চলে না; সিভিল হাটে কোনও যাত্রীও উঠানামা করে না।
* ঈশ্বরদী-পাকশী পাইলট লাইন যেখানে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এক শাখা সাঁড়াঘাট (বর্তমানে বিলুপ্ত) আর এক শাখা এক সময়ের বিখ্যাত গউরের বাবলা তলায় বাঁক খেয়ে পাকশীর দিকে চলে গেছে সে সংযোগ স্থলের নাম সিভিল হল্ট।
১৯১২ সালে পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ রেলসেতু তৈরির পর পাকশীতে গড়ে ওঠে রেলকেন্দ্রিক এক নৈসর্গিক শহর যা বৃটিশ পরিচালিত ইস্টার্ণ রেলওয়ের কার্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একই সময়ে স্থাপিত হয় ঈশ্বরদী রেলস্টেশন। সে সময় সাঁড়া ঘাটে পুরনো রেলস্টেশনটিও চালু ছিল। ইংরেজরা এই তিন স্টেশনে কর্মরত রেলকর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ঈশ্বরদী থেকে পাকশী পর্যন্ত সাত কিলোমিটার রেলপথ স্থাপন করে। একটি পাইলট ট্রেনযোগে সকল কর্মচারী ঈশ্বরদী, সাঁড়া ও পাকশীর মধ্যে যাতায়াত করতেন।
সেই ট্রেনটি ছিল সম্পূর্ণ টিকিটবিহীন। কাজেই আশপাশের লোকজনও ওই ট্রেনে যাতায়াতের সুযোগ পেতো। কিন্তু সাধারণের জন্য রেল অফিসের আঙিনায় যাতায়াত বা ভিড় করা ইংরেজ সাহেবদের চোখে ভালো ঠেকতো না। তাই তাদের পাকশী স্টেশনের দেড় কিলোমিটার দূরে একটা বটগাছের কাছে রোজই নামিয়ে দিতো। ওই সব যাত্রীরা ইংরেজদের চোখে পরিচিত ছিল সিভিল বলে।
তাই ওই স্টপেজের নামকরণ হয় ‘সিভিল হল্ট। ’ পরে বাঙালিদের কাছে জায়গাটি সিভিল হাট বলেই পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান আমলে পাকশীতে গড়ে ওঠে পশ্চিম রেলের বিভাগীয় সদর দফতর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।