ঈদের ছুটির পর সেদিনই ছিল প্রস্তুতি ক্যাম্পের প্রথম দিন। কোলাকুলি, হাত মেলানোর মাঝে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে এনামুল হক জুনিয়র। বিলেতফেরত এনামুলের নতুন হেয়ারকাট তখন ‘টক অব দ্য ক্যাম্প!’
চুলের নতুন স্টাইলের সঙ্গে ইংল্যান্ড থেকে এনামুল নিয়ে এসেছেন দারুণ সব স্মৃতিও। বার্মিংহাম প্রিমিয়ার লিগে খেলে এলেন উলভারহ্যাম্পটনের হয়ে। পারফরম্যান্স এতই ভালো ছিল যে দলের মূল কোচ তাঁকে সুযোগ করে দেন ওয়ারউইকশায়ারের দ্বিতীয় একাদশে খেলার।
ওখানেও দুর্দান্ত এনামুল, ডারহামের বিপক্ষে ১২ আর ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ৫—দুটি তিন দিনের ম্যাচে ১৭ উইকেট।
দ্বিতীয় একাদশের খেলা কাউন্টি ক্রিকেট নয়, কাউন্টির ছোঁয়া! এমন একটি কাউন্টির দ্বিতীয় একাদশে সুযোগ পাওয়াও বিরাট ব্যাপার, ‘ইংল্যান্ডে এবার আমাদের ‘এ’ দলের খেলাগুলো দেখুন, ওদের দ্বিতীয় একাদশই আমাদের অনেক জাতীয় খেলোয়াড়ে ভরা দলকে হারিয়ে দিয়েছে। এতেই মানটা বোঝা যায়। দ্বিতীয় একাদশ হলেও সুযোগ-সুবিধা দারুণ। খুব পেশাদার।
খুবই উপভোগ করেছি সময়টা। ’
এর আগে ২০০৮ ও ২০১১ সালে লিগ ক্রিকেট খেলেছেন। প্রতিবারই ইংল্যান্ডে দারুণ কেটেছে। মাঠের ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে এবারও খুব উপভোগ করেছেন। গত বিপিএলে একই দলে খেলা রায়ান টেন ডেসকাট, রবি বোপারাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
তবে এবার দেশের জন্য মনও উচাটন ছিল খুব। বছর খানেক হলো বাবা হয়েছেন, এতেই যেন পাল্টে গেছে জীবনের মোড়। মেয়ে নাভিনের কথা ভাবলে, মুখের দিকে তাকালে, মেয়ের মুখের হাসিতে ভুলে যান যেন পুরো দুনিয়া। হতাশা, আক্ষেপগুলো কোথায় যে উড়ে যায়!
এমনিতে হতাশা-আক্ষেপ যেন তাঁর ক্যারিয়ারেরই প্রতিশব্দ। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স ১০ বছর হবে এই অক্টোবরে।
অথচ খেলেছেন মাত্র ১৫ টেস্ট আর ১০ ওয়ানডে! শুরুটা কি রঙিনই না ছিল! ১৬ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকেই নায়ক। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ও সিরিজ জয়ের নায়ক হয়েছেন আঠারোতেই। সবচেয়ে কম বয়সে ইনিংসে ৬ ও ৭ উইকেট, ম্যাচে ১০ উইকেট ও দুই টেস্টের সিরিজে ১৮ উইকেটের বিশ্ব রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ন। এমন শুরুর পর স্পিনে দেশের প্রধানতম ভরসা অন্তত হওয়া উচিত ছিল। অথচ সেই তাঁরই জায়গাটা এখনো পাকা নয়!
শুরুর ওই সুখস্মৃতি এখনো তাঁর প্রেরণার উৎস।
এটাই আবার তাঁর ক্যারিয়ারের প্রতীক! ঝলমলে শুরুর পর বিবর্ণ এক অধ্যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসারীদের সবারই কমবেশি জানা এসব। দলে থিতু হওয়ার নতুন এক লড়াই শুরুর আগে এনামুল আবার যেন ঘুরে আসেন পেছনে, ‘নিয়মিত খেলতে না পারার পেছনে আমাদের সে সময়ের নির্বাচন পলিসি অনেকটা দায়ী। আমাকে শুধুই টেস্ট বোলারের তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ টেস্টেও পর্যাপ্ত সুযোগ মেলেনি।
ভাগ্যটাও পক্ষে ছিল না। ২০০৭ সালে ১৩-১৪ মাস আমাদের কোনো টেস্ট ছিল না। সঙ্গে নানা ইনজুরি মিলিয়ে কপালটাই আমার খারাপ। ’
এনামুলের আত্মোপলব্ধি অনেকাংশেই সত্যি। টেস্ট স্পিনারের তকমা গায়ে লাগানো হলেও দেশের মাটিতে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন সেই ২০০৯ সালে।
তার আগেরটি আরও দুই বছর আগে! অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত ভালোই করেছেন। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছেন ভারতের রঞ্জি ট্রফিতে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট পাওয়া বাংলাদেশের একমাত্র বোলার তিনি। বারবার উপেক্ষার হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছে মন। তবে নিজের সঙ্গে লড়াই করে হতাশাকে হারও মানিয়েছেন, ‘হতাশ হয়ে বসে থাকলে নিজেরই ক্ষতি।
নিজেকে তাই উজ্জীবিত করেছি। এ জন্যই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করে গেছি। মানসিকভাবে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছি যে যেখানেই খেলব, পারফর্ম করব। নিজেকে উজাড় করে দেব, খেলাটা যে পর্যায়েই হোক। আমার সময় ফুরিয়ে যায়নি।
এখনো শেখার আছে অনেক, বাংলাদেশকে দেওয়ারও আছে অনেক। ’
এই বয়সটাই তাঁর সবচেয়ে পক্ষের শক্তি। ক্যারিয়ারের বয়স ১০ হতে চললেও জীবনের ইনিংসে মাত্রই ২৬। আর একজন স্পিনারের সেরা সময় শুরুই হয় তো ত্রিশের আশপাশে! নিজেই বুঝতে পারেন নিজের উন্নতি। অভিজ্ঞতার সঙ্গে বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণ অনেক বেড়েছে।
বিদেশে অনেক খেলে শিখেছেন পেশাদারি আর চাপের মধ্যে পারফর্ম করা। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর ফিটনেসও দুর্দান্ত।
একটা আক্ষেপ অবশ্য যাওয়ার নয়। ওয়ানডেতে কেন অপাঙেক্তয় থাকবেন! ক্যারিয়ারের ১০ ওয়ানডের সবগুলোই খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ক্যারিয়ারের সব ম্যাচ একই দেশের বিপক্ষে খেলার রেকর্ড এটাই! শুনেই আঁতকে উঠলেন এনামুল, ‘এই রেকর্ড আমি চাই না।
তিন সংস্করণেই আমি খেলতে পারি। প্রিমিয়ার লিগে বা বিপিএলে নিয়মিত পারফর্ম করছি। আমাকে শুধুই টেস্ট বোলার বানিয়ে রাখা খুবই অন্যায়। পর্যাপ্ত সুযোগ পেলেই প্রমাণ করব। ’
এখনো সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়, এক লাইনে এটাই এনামুলের ক্যারিয়ারের গল্প।
তবে পরিবার, এক বছর বয়সী মেয়ে যেমন পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবন-দর্শন, এবার হয়তো পাল্টে দেবেন ক্যারিয়ারের গল্পটাও। শুরুটা করতে চান আসন্ন নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকেই। সুযোগ কি মিলবে?:।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।