যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।
জ্বালো...জ্বালো...
কারও গগণবিদারী কন্ঠে কোন কিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার আহ্বান সম্বলিত সুতীব্র চিৎকার শুনতে পাই। চিৎকারটি থেমে যাওয়ার সাথে সাথে সুরে বেসুরে তাল মিলিয়ে আরও কতগুলো বিক্ষুব্ধ মানুষের সম্মিলিত কন্ঠে ভেসে আসে-
'আগুন জ্বালো...'
শত কন্ঠস্বরের সম্মিলিত চিৎকারে কার্ল মার্কসকে নিয়ে আমার মনযোগ ক্ষুণ্ণ হয়। ব্যাটা ও নিশ্চয়ই সংক্ষুব্ধ মানুষগুলোর চিৎকার শুনে ভয় পেয়েছে।
তোরণের ওপাশে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছে। তোরণের এ পাশে একটা শতবর্ষ প্রাচীন বটগাছ আছে। এর গুঁড়িতে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসেছে। তার মানে এখনই উঠছে না। কোলের উপর একগাদা চকচকে টাকা।
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের একাউন্ট এবং গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই টাকাগুলো তুলেছে। প্রথমে আমার কাছে তা জালিয়াতি বলেই মনে হয়েছিল। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসই বন্ধুকে তার একাউন্ট ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল।
আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়ে নিশ্চিন্তমনে মার্কস দুনিয়া কাঁপানো এক তন্ত্র উপহার দিয়েছেন। এর নাম সমাজতন্ত্র।
তিনি জীবিত থাকতে এই তন্ত্র কাজ না করলেও মৃত্যুর পর এটি সাড়া বিশ্বে একটি আলোড়ন তোলে। শোষিত এবং নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়তে থাকে। তারপর কি হল কে জানে! কমিউনিজমকে একসময় ক্যাপিটালিজম গ্রাস করে ফেলে। একসময়কার সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই তন্ত্রটি এখন অনেকটা নির্বাসিত।
উনবিংশ শতাব্দীর একটি তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীতে আলোড়ন তুলেছিল। একবিংশ শতাব্দীতে এটি এখন অনেকটা তাত্ত্বিকতার আড়ালে বন্দী হয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রীরা ধীরে ধীরে ক্যাপিটালিজমের পকেটওয়ালা জামা গায়ে চড়াচ্ছেন। এই অসময়ে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা মার্কস শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের কাছে কেন? এতগুলো টাকা নিয়ে তোরণের ওপাশে যাবেন কেন? তাহলে তিনিও কি পুঁজিবাদ জিন্দাবাদ বলে নেমে পড়লেন নাকি?
ভাবনায় ছেদ পড়ে। ক্ষুব্ধ মানুষের কন্ঠের আওয়াজটা আরও জোরালো হয়।
আমার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ হয় এই আওয়াজের উৎসের দিকে। সংক্ষুব্ধ মানুষের কন্ঠ শুনে আমি বুঝতে পারি এটি একটি মিছিল। ওয়ান ইলেভেনের আগে এরকম মিছিল প্রতিদিনই হতো। মিটিং হত, মিছিল হত, মারামারি ভাংচুর হত। টায়ার পুড়িয়ে, গাড়ি পুড়িয়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন সবাই একসাথে কোরাস গেয়ে উঠত-
জ্বালো রে জ্বালো
আগুন জ্বালো।
আজকের এই শ্লোগানটি একটু ভিন্নরকম মনে হচ্ছে। আগুন জ্বালানোর কথা বলে মিছিলকে তাতিয়ে দেওয়া লোকজন ভোটের কি সব কথা বলছে।
ভোট রক্ষার দাবীতে
আগুন জ্বালো একসাথে।
ভোট পেয়েছে আমার ভাই
ভোট ডাকাতের রক্ষা নাই।
ভোটে পাশ ভোটে ফেল
মনজুর ভাইয়ের দারুণ খেল...
শ্লোগান শুনে আমার মনে ভোটের এই ছড়াটি গেঁথে যায়।
বাংলাদেশের ভোট বিষয়ে আমার স্থায়ী মেমোরিতে যা আছে তা মুছে ফেলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্লোগানে ব্যবহৃত ভোট শব্দটি নিয়ে যে ভাবনার উদয় হয় তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে- ভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। জনৈক মনজুর ভাই দারুণ খেল দেখিয়ে এই ভোট নামক জিনিসটি অধিক পরিমাণে পেয়ে পাশ করেছে। কিন্তু ভোট ডাকাতির মাধ্যমে মনজুর ভাইয়ের ভোট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
তাই মনজুর ভাইয়ের পক্ষের বিক্ষুব্ধ লোকজন আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে নেমেছে। সর্বশেষ সংবাদ এই যে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার আগেই পরাজিত পক্ষ হার মেনে নেওয়ায় আগুন এখনও ছড়িয়ে পড়েনি। আগুন নিয়ে ওয়ান ইলেভেনের আগের সব স্মৃতি আমার স্থায়ী মেমোরিতে জমা আছে। এগুলো নিয়ে আমি ভাবতে বসি।
রাজনীতির নোংরা আগুনে পুড়ে বাংলাদেশের সভ্য অস্তিত্ব যখন বিলীন হয়ে যেতে বসেছিল, তখনই ওয়ান ইলেভেন এসেছিল।
ওয়ান ইলেভেন এসে সর্বত্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়েছিল। শীর্ষ মগডালে বসা দুর্নীতিবাজ থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই কেঁপে উঠেছিল সেই ঝাঁকুনি খেয়ে। সেই ঝাঁকুনির রেশ কাটিয়ে উঠে আবার সবাই বসতে চাচ্ছে শীর্ষ মগডালে। বাঘকে বন্দী করে ফেলতে পারলেই তো কেল্লা ফতে। বাঘের ভয় আর থাকবে না, শীর্ষে উঠতেও বাধা থাকবে না।
তাই পলাশীর মোড়ে ধরা পড়া নখ দন্তহীন বাঘটিকে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে বন্দী করে পার্লামেন্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওখানে বসেই ভোটাভুটিতে বাঘটির ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
ওয়ান ইলেভেন (সপ্তম পর্ব)
ভোট নিয়ে আমার স্থায়ী মেমোরিতে আরও যে তথ্য সাজানো আছে তার সারসংক্ষেপ-
ভোট বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অতি আবশ্যকীয় একটি অস্ত্র। এই অস্ত্রটি দখলে রাখার জন্য তেমন কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। একমাত্র কুচকুচে কালো টাকার মালিক কিংবা এই টাকা প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই ভোট নামক অস্ত্রটি ছলে বলে কৌশলে দখলে রাখার সুযোগ পায়।
এক্ষেত্রে যে পেশী শক্তির প্রয়োজন হয় তার জন্যই টাকা। এই টাকা দিয়েই ভোট কেনা যায়, ভোট ডাকাতি করা যায় এমনকি ভোটের আসল মালিক জনগণকে পদদলিত করা যায়।
আহ্!
চারিদিকে টায়ার পোড়া গন্ধ। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ। আমার মনটা আবার চনমন করে উঠে।
ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে কতদিন টায়ার পোড়া গন্ধ নাকে আসেনি। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজও চোখে পানি ঝড়ায় নি। ওয়ান ইলেভেনের আগে মৃত গণতন্ত্রের নমুনা হয়ে যখন রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম, টায়ার পোড়ার গন্ধ এবং টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজে আমার নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শায়েস্তা খাঁর তোরণের এপাশ থেকে আমি অনেকদিন পর একটি হরতালের গন্ধ পাই। আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের আগমনের অপেক্ষায় আমি টায়ার পোড়া গন্ধ প্রাণ ভরে নিতে থাকি...।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।