সাহিত্যের কথা বলা হবে!!!
চলে গেলেন ফারজানা কবির রিতা। সঙ্গে নিলেন নিজের দুই সন্তানকেও। এই চলে যাওয়া মানে তো নিজের কাছে হেরে যাওয়া। নিজের জীবনের কর্তৃত্ব কেমন করে চলে যায় অন্যের হাতে সেই দিনক্ষণের হিসাব নারী নিজেই কী জানে? জীবন কী এতই তুচ্ছ? জীবনকে ভালবেসে জীবনের কাছেই কী ফেরা যায় না? লিখেছেন জিনাত রিপা
'আমি পায়েল। আমি এবং আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমরাই দায়ী।
আমাদের বাবা রাশেদুল কবির আমাদের সঙ্গে যা করেছে, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। দাদা শফিকুল কবির মায়ের কাছ থেকে জোর করে স্ট্যাম্পে লিখে নিয়েছে যে ১ জুলাই বাসা ছাড়তে হবে। '_রাজধানীর আলমবাগের ২২৯ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার দেয়ালজুড়ে লেখা কথাগুলো। ১২ বছর বয়সী এক অভিমানী কিশোরী পায়েলের লেখা। এই বাড়ির দেয়ালজুড়ে রয়েছে এমন অসংখ্য কথামালা।
যেন একটা ডায়েরি হয়ে উঠেছে ওই বাড়ির দেয়াল। শুধু পায়েল নয়, তার একমাত্র বড় ভাই ১৩ বছরের পাবনের লেখাও আছে দেয়ালের অন্য প্রান্তে। 'আমরা কি বাবার অবৈধ সন্তান? আমার বাবা কেন বলল আমাদের মতো সন্তানের দরকার নেই, সেদিন সমাজের পাঁচজনের সামনে কেন আমাদের সন্তান হিসেবে অস্বীকার করল? আপনারাই বলুন, আমাদের মা দোষী, না বাবা দোষী?' বয়ঃসন্ধির সময়টায় যখন অন্যায় আর অবিচারের বিপক্ষে নিজের মনকে গড়ে তোলার দীক্ষা নেয় মন, তখন মায়ের নিত্য অপমান কোন সন্তানই বা মেনে নেয়? পায়েল আর পাবনের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক সেটাই। ওদের মা ফারজানা কবির রিতার সঙ্গে বাবা রাশেদুল কবিরের বিয়ে হয়েছিল প্রায় ১৮ বছর আগে। সংসারটা চলছিল ঠিকঠাক।
এরই মধ্যে রিতার মামাতো বোন স্মৃতির সঙ্গে রাশেদুলের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিণতি মেলে স্মৃতির সঙ্গে রাশেদুলের দ্বিতীয় বিয়েতে। শুরু থেকে রিতা মেনে নেয়নি এ বিয়ে। কিন্তু ক্রমাগত রাশেদুলের অবহেলা আর অপমানে স্বল্পভাষী রিতা ধীরে ধীরে নিজেকে আরো গুটিয়ে নেন। ক্রমেই হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ।
কাছের সব আশ্রয় হারাতে থাকলে অসহায়ত্বও পেয়ে বসে তাঁকে। পরিবারের এই অসুস্থ পরিবেশের প্রভাব পড়ে পায়েল, পাবনের মনেও। পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে 'রাশেদুলের দ্বিতীয় বিয়েতে আমার অমত নেই' এমন আপসনামায় জোরপূর্বক সই নেওয়া হয় রিতার। এমনকি ৩০ জুনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। রিতা শেষ আশ্রয় মেনেছিলেন সাংবাদিক শ্বশুর শফিকুল কবিরকে।
সেই আশ্রয়ের প্রত্যাখ্যানটাই সবচেয়ে বড় আঘাত দিল তাঁকে। চারপাশের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল বলেই কি রিতা অনন্তলোকের পথ খুলে দিলেন নিজেই? পায়েল আর পাবনকে করে নিলেন অনন্তযাত্রার সঙ্গী? আত্দহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড সে তদন্ত চলছে। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তিনটি প্রাণ ঝরে গেছে অকালে, এটাই বড় সত্য। তবে কি আত্দহত্যাই শেষ সমাধান? জীবনকে ভালোবেসে জীবনের কাছে ফেরা কি যায় না? এই চরম ব্যস্ত সময়ে প্রায়-যান্ত্রিক মানুষগুলোকেও রিতার চলে যাওয়া একটু হলেও ভাবিয়েছে, কেন এভাবে চলে যাওয়া?
কেন প্রাণ বিসর্জন
'এই চলে যাওয়াটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। মানছি রিতার মতন পরিস্থিতিতে আমি নেই।
চাইও না এমন অবস্থায় কেউ পড়ুক। তবু ঠিক মেনে নেওয়া যায় না এই হেরে যাওয়া। ' বলছিলেন সদ্য প্রকাশিত ২৮তম বিসিএসের ফলাফলে নির্বাচিত নার্গিস আকতার কলি। একই রকম ভাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী মৌসুমী ফারহানা। 'বাচ্চা দুটো তো কোনো অপরাধ করেনি।
জানি না মৃত্যুর সময় রিতার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল। তবে এটুকু তো বোঝাই যায়, কোন পর্যায়ে মানুষ নিজেকে শেষ করে দিতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু আমি এমন মৃত্যুর বিপক্ষে। ' পুরুষের দায়টা এড়ালেন না ফরহাদ আহমেদ। মাত্রই তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শুরু করেছেন কর্মজীবন।
তিনি বলেন, 'কোনো পরিবারের বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, ভিতরে কী ঘটছে। আপাতদৃষ্টিতে আমরা যা দেখি তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা নিপীড়িত হন। পুরুষ হওয়ার জন্য দায়ভারের অংশটা আমার ওপরও বর্তায়। ভাবতে কষ্ট হয় এমন লোক সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। আর শেষ হয়ে যায় নির্যাতিতরাই।
আশ্চর্য! তবে আর দায়িত্ববোধের জায়গা বলে কি কিছুই নেই? সমাজ, সংসার, পরিবার, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, নিজের কাছে নিজের জবাবদিহিতা, মূল্যবোধ_সবই কি হারাচ্ছি আমরা?'
নীতি আর ন্যায়ের আপ্তবাক্যের বাইরে পশ্চিম ধানমণ্ডি ঝিগাতলার পঞ্চাশোর্ধ্ব সালেহা বেগম (ছদ্মনাম) বলেন তাঁর নিজের জীবনের বঞ্চনার কথা। তাঁর তিরিশ বছরের সংসার ভেঙে গেছে এক মুহূর্তে। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমার স্বামীর বয়স ৬০ বছর। এক বিবাহিতা নারীকে বিয়ে করে তালাক দিয়েছে আমাকে। সম্পদের অংশীদারিত্ব না দেওয়ার অজুহাতে আমার তিন সন্তানকেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দেয় না।
গত দুই বছর ধরে কত প্রতিষ্ঠানে গেছি আমি। সাহায্য চেয়েছি। আপনারা কয়টা খবর ছাপেন পত্রিকার পাতায়? আজ আমার কেউ নেই। কোনো আশ্রয় নেই। আমি কী করব বলতে পারেন?'
সালেহার ক্ষোভ বোঝার সাধ্য সবার নেই।
ভুক্তভোগীরাই জানেন সে বেদনাবোধের জ্বালা। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে বেড়াতে আসা লন্ডনের একটি আয়কর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তাসনুভা চৌধুরী দায়ী করেন এ দেশের মেয়েদের অনগ্রসরতাকে। 'আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত মেয়েকেই দেখেছি, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির চাপে কিংবা নিজের উদাসীনতায় গৃহকর্মকেই কেবল দায়িত্ব ভাবেন। আসলে যেকোনো মানুষের জন্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা খুব দরকার। নারীর জন্য তো তা আরো বেশি প্রয়োজন।
দেশের বাইরে থাকলেও অন্তর্জালে নিয়মিত দেশের পত্রিকাগুলো পড়ি। যতদূর জানি, পূর্ব জুরাইনের রিতা সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ছিলেন। তিনি কেন নিজের অবস্থানটা সুদৃঢ় করেননি বা করতে পারেননি তা আমি জানব না। তবে তিনি কোনো কাজের মধ্যে থাকলে হয়তো আত্দহত্যার চিন্তাটা আনতে দ্বিতীয়বার ভাবতেন। আর রাশেদুলের মতো ছেলেরা নিজের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যান।
তাদের অর্জিত শিক্ষার মূল্য তবে তারা কোথায় দেন?'
বৃত্তে বন্দি সন্তানেরা
পায়েল আর পাবন মৃত্যুর আগে পার করেছে সবচেয়ে দুঃসহ সময়। বাবার অবহেলা আর মায়ের নিঃসঙ্গতা এই দুই মিলে ওরাও মেলাতে পারেনি নিজেদের অবস্থান। বন্ধন ছিঁড়ে যাওয়ার শঙ্কা কিংবা আশ্রয়হীনতার সংকট_সব কিছু ছাপিয়ে পায়েল, পাবনের মনের বড় অংশ জুড়ে ছিল তাদের প্রতি পরিবারের উদাসীনতা। দিনকে দিন তাই তারা হয়তো বন্দি হয়ে পড়ছিল ক্রমে ছোট হয়ে আসা বৃত্তে। ক্ষোভ, যন্ত্রণা আর অপমানের ভাষাগুলো নিংড়ে দিয়েছে দেয়ালে।
তাদের মনের সঠিক গতিবিধি বোঝা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবু এটুকু তো নিশ্চিত করেই বলা যায়, বিশ্বাস আর মূল্যবোধের জায়গাটা তারা হারিয়েই ফেলেছিল। তাই বোধ করি মায়ের অনন্তযাত্রারই সঙ্গী হলো তারা। এমন অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে যেকোনো শিশুই বেড়ে ওঠে শঙ্কাযুক্ত পরিচয় নিয়ে। কখনো তারা সে শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারে, কখনো বা নয়।
তবে এভাবে চলে যাওয়া তো কোনো সমাধান হতে পারে না। শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ নির্মল করে তোলার দায়িত্ব তো পরিবারেরই।
মনোবিজ্ঞানী বলেন
'নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপাড়ার ভিত্তিটা মজবুত হওয়া খুব জরুরি। কেউ আমাকে চালনা করছে, এর চেয়ে অনেক বেশি ভালো নয় কি নিজেকেই নিজে পরিচালনা করা?'_বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ। তিনি জানান, দুই সন্তানসহ রিতার আত্দহত্যার কাহিনী সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সবাই জেনেছে।
তবে এমন নিপীড়নের ঘটনা সমাজে অনেক ঘটছে। নারীর অন্তর্মুখিতার কারণে সমাজের সব খবর জানাও যায় না। যে অন্যায়টা রিতার সঙ্গে ঘটছিল, আত্দহত্যা সে পথকে আরো সুগম করে দেয়। না পাওয়ার গ্লানিকে যদি নারী শক্তিতে পরিণত করতে পারত, তবে নির্যাতনের হার অনেক কমত। সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গার নূ্যনতম আঘাতটাও মেনে নেওয়া কষ্টকর।
তবে নারী যদি এই ধারণাটা করে নেয় যে স্বামীই সব নয়, পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্বই আসল, তবে সে অনেক কিছুই জয় করতে পারে। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে বটে, তবে স্বশিক্ষায় আত্দনির্ভরশীল হওয়ার শক্তি নারী এখনো জোগাড় করে উঠতে পারেনি। এটা সত্যিই দুঃখজনক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।