প্রশিক্ষণ ; তা-ও শিক্ষকদের এবং বিষয়ভিত্তিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সেকেন্ডারী এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এর আওতায় এস.এস.সি সমমানের দাখিল স্তরে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন বিষয়ক বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মসূচিটি সম্পন্ন হল সম্প্রতি। গত ১১ থেকে ১৬ জুন দু’টি ব্যাচের তিনদিন করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে দাখিল স্তরে বাংলা ও ইতিহাস বিষয়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ছিলো এটি। উল্লেখ্য, যে সব মাদ্রাসায় প্রভাষকদেরও দাখিল স্তরে ক্লাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, সে সব মাদ্রাসার প্রভাষকগণও এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই প্রশিক্ষনার্থীদের মধ্যে সহকারী শিক্ষকদের পাশাপাশি কয়েকজন প্রভাষকও ছিলেন।
প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের ষোলশহরস্থ বিবিরহাটে অবস্থিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসায়।
পাঠক মাত্রই জানেন, এবার অনুষ্ঠিত এস.এস.সি পরীক্ষায় দু’টি বিষয়ে প্রচলিত ধারা বাদ দিয়ে সৃজনশীল ধারায় প্রশ্নপত্র দেয়া হয়। এইচ.এস.সি এবং দাখিল (এস.এস.সি সমমানের) স্তরে ২০১২ থেকে সেই দু’টি বিষয়ে (বাংলা ও ইতিহাস) সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন হচ্ছে সেই পদ্ধতি, যাতে শিক্ষার্থী মূল বই যথাযথ পাঠ এবং আলোচনা ও অনুশীলন ছাড়া প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারবে না। এতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান আহরন নিশ্চিত হবে।
উপরন্তু শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে সংশ্লিষ্ট বই পুস্তক এনে দিলেও উত্তর দিতে পারবে না। এতে নকল প্রবণতা চিরতরে দূর হবে।
সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ের উদ্যোগ এবং তারও আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ; দু’টিই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশিক্ষণটি যদি যথাযথ পর্যায়ে না হয়, তাহলে উদ্যোগটি মাঠে মারা যাবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ যথাযথ না হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণটির ধরণ, ব্যাপ্তী, সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষক, সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের আচার আচরণ ইত্যাদি সাপেক্ষে।
প্রথমেই আসা যাক প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তী বা সময় বিষয়ে। মাত্র তিনদিনে এতো বিশাল একটা কর্মযজ্ঞ সম্ভব নয়। প্রথমদিনের অর্ধেক সময় চলে যায় সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তাব্যক্তিদের আপনবাদ্যি ও জ্ঞান বিতরনমূলক বক্তৃতায়। যে সব বক্তৃতার অধিকাংশই অপ্রাসঙ্গিক। যেমন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তার বক্তৃতায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তথা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় অধিক হারে আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে বলেছেন।
কিংবা জামেয়া আহমদিয়ার অধ্যক্ষ বলেছেন মাতা-পিতার পরেই শিক্ষকের স্থান কোথায় - নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য এসব বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রশিক্ষণের বিশাল একটা সময় অপচয় হয়েছে। যে শিক্ষক গত বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করে আসছেন, তাঁকে এখন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে এনে এসব জ্ঞান বিতরণমূলক বক্তৃতা শ্রবনে বাধ্য করা কতটা যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখা দরকার।
প্রশিক্ষণের সময় ছিলো সকাল নয়টা থেকে বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত। দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য দেড় ঘন্টা সময় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা কখনও আধা ঘন্টার বেশি পাওয়া যায়নি। সকালে কখনো সাড়ে নয়টার আগে শুরু করা যায় নি।
আর যেদিন কর্তাব্যক্তিদের বক্তৃতাপর্ব ছিলো সেদিন তো দুপুর বারটার আগে নয়-ই। যাই হোক, তিনদিনে এই প্রশিক্ষণ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। কমপক্ষে এর তিনগুণ সময় প্রয়োজন। একদিনে এতো বেশি কাজের (প্রশিক্ষণের) চাপ থাকে যে, প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী উভয়েই হাঁপিয়ে উঠেন। মনে রাখা দরকার, কাজের এই চাপ কারখানার কাজের চাপ নয়, জ্ঞান আহরণ ও যথাযথ অনুধাবনের চাপ।
যা সঠিকভাবে করার উপর নির্ভর করছে পরবর্তীতে শিক্ষার উন্নয়ণ, উন্নত জাতি ও দেশ গঠন। আজ সারাদিন যে কার্যক্রম নিয়ে প্রশিক্ষক লেকচার দিলেন, একজন প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক তার হোম ওয়ার্ক, অন্য শিক্ষকদের সাথে আলোচনা, প্রয়োগের পদ্ধতি অনুশীলন ইত্যাদি কাজগুলো করার কোনো সময়ই পান নি। ক্লাশ শেষে তাঁকে ছুটতে হয়েছে নগরীর বাইরে যে যেই উপজেলা থেকে এসেছেন সেই উদ্দেশে। হয়তো গভীর রাতে তিনি বাড়ি পৌঁছলেন এবং পরদিন সকালে আবার চট্টগ্রাম পৌঁছার জন্য তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষকদের থাকার কোনো ব্যবস্থা না করাতে এটা ঘটেছে।
টি.এ ডি.এ যা দেয়া হয়েছে তাতে তিনদিন মানসম্মতভাবে চট্টগ্রাম শহরে থাকা খাওয়া এবং যে জায়গায় ভেনু সেখানে যাওয়া আসা করতেই শেষ তো হবেই, গাঁটের পয়সাও খরচ করতে হবে। তাহলে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে প্রাপ্ত সম্মানি থেকে পুত্র কন্যাদের জন্য আম-লিচু নেয়া দূরে থাক, কারো কাছ থেকে ধার করে বাড়ি ফিরতে হবে। আর যে ব্যক্তি প্রতিদিন বাড়ি থেকে (সাতকানিয়া, সন্দ্বীপ, রাঙ্গামাটি, বাঁশখালি ইত্যাদি জায়গা থেকে) আসা যাওয়া করলো তা কিভাবে সম্ভব হলো, তা গবেষণা করলে হয়তো সম্প্রতি এভারেষ্ট বিজয় ও পাটের জিনোম আবিস্কারের মতো বাঙালির আরেকটি বিশ্ব রেকর্ডের খবর জানা যাবে।
প্রশিক্ষকগণ যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। যদিও তাঁদের মান নিয়ে প্রশ্ন এসেছে।
যেমন, বাংলা বিষয়ের প্রশিক্ষক হয়েও বাংলা বর্ণগুলো যথাযথভাবে লিখতে না পারা, চিহ্নগুলো কোনটা কোথায় বসবে সঠিকভাবে না জানা ইত্যাদি। কিন্তু আয়োজক কর্তৃপক্ষ তাঁদেরকে ভাববার ও প্রয়োগ করার পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
জেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা যেভাবে শিক্ষকদের সাথে ধমক-ধামক দিয়ে কথা বলেছেন, তা খুবই লজ্জাস্কর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রশিক্ষণের সহযোগী বিভিন্ন কাজে জেলা শিক্ষা অফিসের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই অফিসের বড় জোর কর্মচারী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা।
তাঁরা সেভাবে সহকারী শিক্ষকদের ও প্রভাষকদের ধমক-ধামক দিয়েছেন, আমাদের বর্তমান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জানলে খুবই লজ্জিত হবেন। তাহলে জামেয়া অধ্যক্ষ যে তাঁর বক্তৃতায় বলেলেন, মাতা-পিতার পরেই শিক্ষকের স্থান-সেই বক্তৃতার কি লাভ হলো। স্বয়ং শিক্ষা অফিসের লোকরাই তো শিক্ষকদের অপমান করলো। সর্ষেয় যদি ভূত থাকে, তবে ভূত তাড়াবে কে? এক এগার পরবর্তী দুদকে হিসাব দাখিল করতে গেলে অন্য কারণ দেখিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক তাদের গ্রেফতার করতেন; সেরকমভাবে নাজেহাল করা হবে না, এই আশ্বাস যদি মাননীয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রদান করেন, তাহলে তাঁর কার্যালয়ে স্বশরীরে গিয়ে তাঁর অধীনস্থ অশোভন আচরণকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দিয়ে আশার ইচ্ছে প্রকাশ করা হলো।
ভেনু নিয়ে কিছু না বলে পারছি না।
দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সুনামের অধিকারী মাদ্রাসা চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে হলো। শ্রেণীকক্ষের জানালার গ্লাসগুলো ভাঙ্গা। একটু বৃষ্টি হলেই প্রশিক্ষনার্থীরা ও তাদের কাগজ-পত্র সব ভিজেছে। এতো বিশাল বিশাল ভবন, এতো চাকচিক্য; টয়লেটে গেলে গা গুলিয়ে বমি আসার অবস্থা।
বিশাল পাঁচ কি ছয়তলা ভবন, যেখানে ক্লাশ হয়, সেখানে টয়লেট বলতে যা আছে তা এতো নিম্নমানের ও অপ্রতুল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এই টয়লেট ব্যবস্থায় কি করে দুই শতাধিক শিক্ষক তাদের প্রকৃতির ডাক সম্পন্ন করার কাজটি সারলেন তা বিস্ময়কর। টয়লেটে কোনোদিন সাবান দেখা গেলো না। কোনো বেসিনের বালাই নেই। নামাজের অজু করার ব্যবস্থা অবশ্য আছে।
কিন্তু টয়লেটের উপচে পড়া ময়লা ও দুর্গন্ধে সেখানে বসা দায়। কোথায়ও কোনো বেসিনের ব্যবস্থা নেই। এই টয়লেট ব্যবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা নৈতিক ও রুচির শিক্ষা কোনটা পাবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষে।
দুই শতাধিক শিক্ষক দুপুরের আহারের আগে-পরে হাত-মুখ ধুয়েছেন কোথায় এই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন? বেলা বারটায় ব্রেক ফাস্টে দেয়া হয়েছে একটা সিঙ্গারা, একটা মিষ্টি ও একটা আপেল। এটার নাম ব্রেক ফাস্ট হলো কেন? এটাকে জল খাবার বা নাস্তা বললে অসুবিধা কি? কোনো চা এর বালাই নেই।
সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একজন শিক্ষক এক কাপ চা খেতে পারবেন না - এ কোন সভ্য সমাজে বাস করছি! দুপুরের খাবার দেয়া হতো প্যাকেট লাঞ্চ। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের পুঁটলিতে মুখ বন্ধ করে রাখা অবস্থায় মাংস-ঝোল বা সবজি থাকতো সেই প্যাকেটে। যা খেলে আরো কিছু রোগ বালাইকে আলিঙ্গন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কখনো কখনো খাবার গন্ধও হয়ে যেতো। কিন্তু শিক্ষকদের উপায়ন্তরহীন হয়ে তা-ই ভক্ষণ করতে হয়েছে।
কোনো কোনো দিন সকালে আধা লিটারের খাবার পানি দেয়া হয়েছে তো সারাদিন আর কোনো পানিই দেয়া হয়নি। ওই আধা লিটার পানি দিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চালাতে হয়েছে। মাঝখানে দুপুরের খাবারের আগে ও পরে এই পানিতেই হাত মুখ ধুতে হয়েছে। সবচেয়ে দুর্বিসহ অবস্থা হয়েছে নারী প্রশিক্ষণার্থীদের।
ভ্যেনুতে যাতায়াত ব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষে।
বৃষ্টির কারণে এই ভ্যেনুতে যাতায়াত যে কেমন দুঃসাধ্য তা বলাই বাহুল্য। যদিও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এখানে ভ্যেনু করার ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু দুই দিন আগে বা পরে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি আয়োজন করলে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো? এতে হয়তো যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ও সুযোগ-সুবিধা আছে এমন ভ্যেনু পাওয়া যেতো।
শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে যে কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী গ্রহণ করার সময় উপরের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনবেন এই আশা রইলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।