এতকিছু ... ওই সিনেমার জন্যই...
১.
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে আবার পুনরায় ঝরে যায়,
দেখে কবিকুল এতো ক্লেশ পায়। আথচ হে তরু
তুমি নিজে নির্বিকার। এই প্রিয় বেদনা বোঝনা!
- বিনয় মজুমদার
কেমন আছিস বল!? হ্যাঁ... অনেকদিনপর পর তোকে লিখতে বসা। অনেকটা বাধ্য হয়েই কিংবা বলতে পারিস মানুষের মনের অবচেতনে যে খেদ জমে; হয়তো তা থেকে কিছুটা মুক্তিরও প্রচেষ্টা। জানিস অনেকদিন তোকে দেখিনা।
সত্যি কথা বলতে কী খুব যে দেখতে ইচ্ছে করে তাও কিন্ত না ! আসলে আমরা প্রত্যেকেই তো নিজেদের পৃথিবীতে পৃথিবীটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে কিংবা পৃথিবীর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছি টের-ই পাইনি।
তোর কী মনে পড়ে ভার্সিটির দিনগুলোর কথা! তুই আমি রুমকী আর আরও একজন! দেখেছিস কী আশ্চর্য নামটাই ভুলে গেছি! ওই যে নাখালপাড়ায় বাসা ছিলো! অথচ অমরা একদিন প্রত্যেকের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ ছিলাম। আমরা চারজন একদিন বৃষ্টিতে ভিজলাম, রুমকীর সে কী ভয়! বাসায় বকবে! তারপর তুই জোর করে টেনে নিয়ে গেলি। তারপর আমরা রিকশায় করে চারজন একসঙ্গে বাসায় ফিরলাম। ওই মেয়েটার... ও হ্যাঁ মনে পড়েছে শারমীন।
শারমীনের জুতা ছিড়ে গেল বলে একটু পর পর ঘ্যান ঘ্যান করছিল বলে তুইও ওকে ধমক দিলি! তারপর ওই যে চারুকলা থেকে তোর স্কুলের একটা ফ্রেন্ড আসতো। আমরা একদিন হাজীর বিরিয়ানী খেতে গেলাম! তুই বললি বুড়িগঙ্গা দেখতে যাবি। কী আর করা, গেলাম সবাই মিলে! নৌকায় করে ঘুরলাম। আসলে কী উচ্ছলই না ছিল সেই দিনগুলো ! আর তুই বোধহয় জন্মগত ভাবেই কিছুটা উচ্ছলতা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলি। তোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়ানো ছিলো উচ্ছলতা আর আনন্দ।
তোর সেই উচ্ছলতারা এখন কেমন আছে রে?
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে শারমীন যেন কোথায় হারিয়ে গেল কিন্ত কী আশ্চর্য আমরা কেউ তার খোঁজও করিনি। অথচ আমরাই তার আপনজন ছিলাম আর তোকে আমাকে রুমকীকেই সে জীবনের সবচাইতে আপনজন এবং কাছের মানুষ মনে করতো। রুমকী অবশ্য বলেছিল ওর বাবার কী এক ঝামেলা হবার কারণে ওরা গ্রামে চলে যায়। পরে ওখানে নাকী বিয়ে করে সংসার শুরু করে। কী অভিমানী মেয়ে দেখ! আমরা ওর কাছের মানুষ হয়ে ওর কোন খোঁজ খবর করিনি বলে নিজে থেকেও কিছু জানায়নি।
কিচ্ছু না। তার কিছুদিনপর তো রুমকীর প্রেম হয়ে গেল থার্ড ইয়ারের সজলের সাথে। আর দশটা মেয়ের মত প্রথম প্রেমের পর রুমকীও হারিয়ে গেল আমাদের মাঝ থেকে। আমাদের মাঝথেকে কী! ক্যাম্পাস থেকেই যেন কোথায় হারিয়ে গেল ও। আজিজ মার্কেটের এক রেস্টুরেন্টে একদিন দেখা।
আমাকে বসতেও বললো কিন্ত ওর প্রেমিক বেচারা একটু অপ্রস্তত হয়ে গিয়েছিলো। পরিচয় করিয়ে দিলো আমার সাথে। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আমিও চলে আসলাম। পরে বলেছিলাম তোকে।
মুলত তার পরই আমরা দুজন খুব কাছের হয়ে গেলাম অথচ কলেজেও আমরা একসাথেই পড়েছি।
এমনকী স্কুলেও আমরা একই সেকশনে ছিলাম। আসলে রুমকীর প্রেম হওয়াতে আমরা দুজনই ভেতরে ভেতরে খুব জেলাস হয়েছিলাম। ওই যে অপরাজেয় বাংলার সামনে গিয়ে তুই আর আমি অনশন করলাম। তাতে কী তারপরই তো শুরু হয় তোর আমার উন্মাতাল ছিপনৌকার মতো গতিময় দিন।
খেয়াল করেছিস নওরীন! আমার চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই! কী সম্বোধন করবো বল? কী সম্বোধন আমি করতে পারি? এমনকী এতো বড় একটা অঘটন আমি ঘটিয়েছি অথচ তার জন্য তোর কাছে কোন ক্ষমা পর্যন্ত চাইনি! দ্যাখ তোর বন্ধুত্বের প্রতি আমার কী অগাধ বিশ্বাস।
আমি সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলাম তুই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তোর সাথে আমার যোগাযোগ নেই, দেখা নেই, কথা নেই। বৃষ্টির মধ্যে ভেজার কোন ব্যাপার নেই। অথচ দিনের পর দিন রাতের পর রাত এই গুলিই আমাকে ভাবিয়েছে। আমি নিজেই নিজের কাছে কতটা ছোট হয়ে গিয়েছি, ছোট হয়ে থেকেছি।
নওরীন একটা মানুষের একটা হাত কী কখনো আরেকটা হাতের কাছে কোন ভুলের জন্য ক্ষমা চায় বল? তুই আমার আরেকটা হাতের মতো কিংবা আরো বেশী কিছুরে! যেটা আমি হয়তো কোনদিনই বলে কিংবা লিখে বোঝাতে পারবোনা। বাইরে শক্ত একটা আবরন তুলে ধরলেও আমি তোর সব খবরই রেখেছি। বিয়েটা আজও করলিনা। এটা আমাকে ভাবায়। তোর সিডনীতে চলে যাওয়া।
তার আগের পরের কোন কিছুই আমার অজানা নয়। তোর যেদিন ফ্লাইট সেদিন আমি ঠিকই এয়ারপোর্টে গিয়েছি দুর থেকে দেখেছি আমার বন্ধু নওরীনকে চলে যেতে। চুপচাপ চোখের পানি ফেলেছি। এবং আমার ধারনা তুইও আমাকে দেখেছিস। তাই তুইও কেঁদেছিস।
২.
নওরীন কাজটা আমি আসলেই ঠিক করিনি। তমালকে পছন্দ করতিস তুই। তোর ভালোলাগার সবটা জুড়েই ছিল তমাল। ও পত্রিকায় কী সব লেখালেখি করতো তখন। সেইসব লেখা ভীষণ ভালোলাগতো তোর।
তুই সঙ্গে করে পত্রিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতিস। আমাকে বললিও একদিন পছন্দের কথা। তমালের সরলতা, ব্যক্তিত্ব আর সুন্দর করে কথা বলা সবকিছূ তোকে ভাবায়। আমরা একদিন ফলো করলাম তমালকে, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত হয়ে পলাশীর মোড় পর্যন্ত। কারন আমরা জানতাম আজিমপুরে ওদের বাসা।
সে কিন্ত ঠিকই বুঝে গিয়েছিলো যে তাকে ফলো করা হচ্ছে। এটাই হলো কাল! সে ভেবে বসলো তুই নয় তাকে পছন্দ করি আমি। তাছাড়া কোথায় আমাদের জুওলজি ডিপার্টমেন্ট আর কোথায় তমালের কমার্স ফ্যাকাল্টি, তুই আর আমি ক্লাস শেষে ওখানে গিয়ে আড্ডা মারতাম। কখনো কখনো আমাদের সাথে থাকতো জাহীন, জয়া, হুমায়ুন।
মনে আছে তোর? একদিন ফার্মগেটের দিকে যে বাস যায় ওই বাসটাতে উঠে বসলো তমাল।
আমাদের দুজনের গন্তব্য যদিও ওদিকে নয় তবু আমরা বাসে চেপে বসলাম। কী একটা যেন নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল। তুই বললি আমার এসব ভালো লাগছে না। তারপর আমরা নেমে গেলাম।
তারপর তো একদিন হুমায়ুনের মাধ্যমে আমাদের সাথে পরিচয়।
সেইদিন একটা আকাশী বঙের থ্রীপিস পরে এসেছিলি। তোকে আকাশ নেমে আসা পরীর মতো দেখাচ্ছিলো। তুই জানতিস যে সেদিন তমালের সাথে আমাদের দেখা হবে। ওইদিন সারাবিকেল আমরা আড্ডা মেরেছিলাম টিএসসিতে, চারুকলায়, ছবির হাটে। পরে হুমায়ুনের জরুরী কী একটা ফোন আসায় ও চলে গেল।
আমরা তিনজন থাকলাম।
তারও বেশকিছুদিন পরে আমরা তিনজনই যখন মোটামুটি জড়তার সীমানা অতিক্রম করেছি। কথা ছিলো পহেলা ফালগুনে আমরা একসাথে ঘুরবো সারাদিন। খুব ভোরে তমাল চলে এসেছিলো। সেইদিন তমাল পরে এসেছিলো নীল রঙের পান্জাবী।
একটু পর আমিও চলে আসি। এই দিনের জন্য তোর অনেক প্রন্ততি ছিলো, তুই কলাপাতা রঙের একটা শাড়ী কিনেছিলি। কিন্ত তুই আসতে পারলিনা। তোর হঠাৎ করে জ্বর এলো। ওইদিন দুপুর পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম।
অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিষয নিয়ে আমাদের গল্প হলো। আমরা চারুকলাতে ভাত খেলাম। বিকেল বেলা সে আমাকে প্রপোজ করে। এবং আমিও জানিস কিছু না বুঝেই রাজী হয়ে গেলাম। এমন কেন হলো রে? মানুষের অবচেতন মন কী নিজে নিজেই একটা পথ তৈরী করে দেয় যেপথে তার কোনদিনই হাটার কথা নয়! কথা ছিলোনা!
মানুষের জীবনতো এমনই।
যা চাওয়া হয় সবসময় তা পাওয়া নাও হতে পারে কিংবা যা চাওয়া হয় তারচে বহুগুন পাওয়াও হতে পারে। তমালের সাথে থাকার কথা ছিলো নওরীনের অথচ তমালকে পেল তিথি; আর তিথিকে পেল তমাল আর তারা দুজনে পেল ফুটফুটে একটা সন্তান তীর্থ। তানভীর তমাল তীর্থ। তানজীলা তাবাসসুম তিথি আর সৈয়দ জামিলুর রহমান তমালের সন্তান। এই মার্চে যার বয়স পাঁচে পড়েছে।
এবং গুলশানের একটি স্কুলের তুখোড় ছাত্র সে। জীবনের গল্পগুলি এমনই হয়, এমনই হওয়া উচিত। আসলে কোন গল্পটি কার জন্য কখন কোথায় অপেক্ষা করে তা কী কেউ বলতে পারে? নওরীনকে লেখা তিথির এই দীর্ঘচিঠির সাত রঙ এর কাসুন্দি না ঘেটে আসুন চিঠির শেষটা পড়া যাক।
৩.
নওরীন সিদ্দিক নীতু, আমি আসলে হেরে গিয়েছি। নিজের কাছেই আমি হেরে গিয়েছি।
আর সংসারের গোপন একটা অদৃশ্য ফাটলের এইসব কথা আমি আর কাকে বলবো বল? গতমাসের সাত তারিখ বৃহস্পতিবার ছিল সেদিন। সাধারনত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমরা গাড়িতে করে ঘুরতে বের হই তীর্থকে নিয়ে। সপ্তাহের বাজারটাও সেদিনই করা হয়। আমাদের গুলশানের বাসা থেকে বের হয়েছি। ওরা বাসার নিচে অপেক্ষা করছিলো আমি তীর্থকে নিয়ে নিচে নেমেছি দেখি হুমায়ুন; ওইদিন ব্যাংক থেকে ফেরার সময় হুমায়ুনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তমাল।
অনেকদিন পর হুমায়ুনকে দেখে ভীষন ভালো লাগছিলো। আমি তমালকে নিয়ে পেছনরে সিটে বসেছি আর হুমায়ুন সামনে তমালের পাশে। আমরা গল্প করতে করতে বনানী ব্রীজ হয়ে এয়ারপোর্ট রোডে আসলাম। হুমায়ুনের বাসা বনানী কবরস্থানের কাছে। আর্মি স্টেডিয়ামের কাছে আমরা ওকে নামিয়ে দিলাম রাস্তার পাশে।
তারপর আমি সামনের সিটে তমালের পাশে বসতে যাবো এমন সময় হয়েছে কী কোথ্থেকে একটা রাস্তার মেয়ে এসে তমালকে বলছে আরে স্যার আপনি! একে কোথ্থেকে তুললেন? আহ্ হা রে স্যার একসপ্তাহ আমার জ্বর আইসে। কাম র্কতে পারি নাই এর মইধ্যে আপনে নতুন মাইয়ার কাছে চইলা যাইলেন? সে একটানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিল জানিস। তমাল কোন কথা বলারই সুযোগ পায়নি। অবশ্য সুযোগ ছিলোও না কারন ওই প্রস্টিটিউট মেয়েটা অধিকারের সুরে কথা বলছিলো যেটা একদিনে তৈরী হয়নি। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি পরে বেহুশ হয়ে গিয়েছি।
পরে হাসপাতাল থেকে কিছু না বলেই তমালকে নিয়ে ভাইয়ার ইস্কাটনের বাসায় চলে এসেছি।
নওরীন, তমালের সাথে থাকাটা আসলে সম্ভব নারে। এটাই আমার শেষ কথা। তীর্থকে নিয়ে আমি তোর কাছে চলে আসতে চাই। কাগজ-পত্র সব পাঠালাম।
ভাইয়ার বাসায় পরগাছার মত কিংবা ঢাকায় থাকাটাই আমার পক্ষে সম্ভব না। ঢাকা আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা শহর। এই শহরের পাখিরা যেমন শহরটাকে ভালবাসে আমি তারচে কম বাসিনা, কিন্ত শহরের পাখিরা মন খারাপ করে চলেও যায়। তার খবর কেউই রাখেনা। তাতে কারও কোনও ক্ষতিও হয়না।
কিন্ত আমার যত ক্ষত; আমার যত বিষাদগাঁথা সব তোকে জানালাম। একেকটা মুহুর্ত এখন আমার কাছে দীর্ঘ সময়ের নিখুঁত একেকটা বোঝা। কিভাবে কী হবে আমি কিছু জানিনা। তুই সব ম্যানেজ কর।
ভালো থাক, সুন্দর থাক।
জগতের সব উচ্ছলতারা স্বর্ণলতিকার মতো ঘিরে থাক তোকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।