নতুনদেশের বাবাকে নিয়ে গল্প গাথা
ফয়সাল সানি
বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্কটা আসলে কেমন হয়? মাকে নিয়ে প্রতিটি সন্তানের মনে যেমন আবেগ অনুভূতির নিরন্তর যে খেলা চলে বাবার বেলা কি তার ব্যতিক্রম ঘটে? তাহলে মাকে নিয়ে সাহিত্যে যতোটা মাতামাতি দৃশ্যমান বাবাদের নিয়ে তা অনুপস্থিত কেন?- প্রশ্নগুলো অবান্তর মনে হলেও ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যায় না,কারন মাকে নিয়ে যতোটা সাহিত্যগাথা রচিত হয়েছে,বাবাকে নিয়ে তা হয়নি। কিন্তু টরন্টো থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা নতুনদেশ ডটকম এর চলতি সংখ্যা পড়ে এই ধারনার খানিকটা চিড় ধরলো। প্রকাশমান না হলেও বাবাকে নিয়ে সন্তানের মনে আবেগের কমতি নেই,মার মতো বাবাও প্রতিটি সন্তানের মনেই ভিন্ন রকম ভালোবাসার আসন গেড়ে বসে আছেন,শুধু তার বহিঃপ্রকাশের বেলায় খানিকটা চাপা ভাব আছে,এই যা।
নানা অনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে গেলো বাবা দিবস।
বিশ্বপ্রবণতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টরন্টোর ’নতুনদেশ ডটকম’ প্রকাশ করেছে বাবা দিবসের বিশেষ সংখ্যা। বাবাকে নিয়ে আবেগময় ভালোবাসার ভিন্নরকমের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেই বিশেষ সংখ্যার বিভিন্ন লেখায়। সংখ্যাটি পড়তে পড়তে যে কোনো পাঠকেরই মনে হবে বাবাকে নিয়ে এতো ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে সন্তানের মনে!
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ছটিয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখকরা খোলা হাতে বাবাকে নিয়ে তাদের অনুভূতির কথা লিখেছেন এই সংখ্যাটিতে। গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলেছেন টরন্টোর গল্পকার আকতার হোসেন তার “আমি কেন বাবা” নিবন্ধে। সন্তান জন্ম দেওয়াই কেবল নয় সংসারে বাবার ভিন্নরকমের ভূমিকার মনস্তাত্তিক এক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তিনি তার এই লেখায়।
আকতার হোসেনের সুললিত গদ্যে সেই ব্যাখ্যা হয়ে উঠেছে আরো হৃদয়গ্রাহী। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বাবার ভূমিকা বিশ্লেষন করেছেন নুর মোহাম্মদ কাজী। সন্তানের ভবিষ্যত মঙ্গল কামনায় সংসারে বাবাকে হাতে তুলে নিতে হয় শাসনের গুরুদ-। আর সেটিই সন্তানের সঙ্গে বাবার সম্পর্ককে করে তুলে দূরবর্তী এক নিরব ভালবাসার। সেই ভালবাসায় আবেগের ছোঁয়া থাকে কিন্তু একই সঙ্গে একটা দূরত্ব্ও তৈরি করে রাখে।
বাবা এবং সন্তান দুজনের মনকেই সেই ভালবাসা আর্দ্র করে রাখে কিন্তু দুজনের মাঝেই খানিকটা দূরত্বের দেয়ালও তৈরি করে। অনবদ্য এবং যুক্তি নির্ভর বিশ্লেষন নুর মোহাম্মদ কাজীর।
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাবার সঙ্গে দূর্লভ কিছু মুহূর্তের টুকরো টুকরো স্মৃতিকে বিনেসূতোয় মারা গাথার মতোই শব্দের গাথুনিতে প্রকাশ করেছেন এক ঝাঁক লেখক। জসিম মল্লিক,আবদুল হাসিব, সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, রোকসানা লেইস, তাসরীনা শিখা,মঞ্জুলী কাজী, মৌ মধুবন্তী, লুনা শিরীন, নন্দীনী খান,রেহমান রুদ্র,রোজিনা করিম কনক,ফারহানা নাহিদ বনি, ঋতু মীর এর লেখায় রয়েছে বাবার জন্যে টানটান ভালোবাসা আর আবেগের ছোঁয়া। প্রবাসী কন্যা ঈশাত আরা মেরুনাকে নিয়মিতই চিঠি লিখেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক,পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং রেজিস্ট্রার বাবা ড. মোঃ মাহাবুবুর রহমান।
কন্যাকে লেখা সেই চিঠির পরতে পরতে বাবা মেয়ের স্নেহ ভালোবাসার খুনসুটিকে ছাড়িয়ে দীপ্ত হয়ে উঠে জীবন দর্শন । অপূর্ব ভাষা শৈলী আর বর্ণনার ভঙ্গিতে সেই চিঠিগুলো আর নিছক ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির গ-ির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, হয়ে উঠে সার্বজনীন সুখপাঠ্য এক অপূর্ব দলিল। সাহিত্যমূল্য বিচারেও সেই চিঠিগুলো যেন অমূল্য সম্পদ। ছোট্ট একটি ভূমিকা দিয়ে মেরুনা তাকে লেখা তার বাবার একটি চিঠি উপস্থাপন করেছেন পাঠকদের কাছে। চিঠিটা পড়তে পড়তে পাঠক ভুলেই যান চিঠির কথা, অবগাহন করতে থাকেন জীবন জিজ্ঞাসার ভিন্ন বলয়ে।
নতুনদেশের বাবা দিবসের লেখাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে, সবকজন লেখকই নিজ বাবাকে জড়িয়ে জীবনের অপার আনন্দ বেদনার স্মৃতি রোমন্থনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই স্মৃতির সমুদ্রে সাতার কাটার মধ্যেও কেবল বাবার সঙ্গে আনন্দ বেদনায় পাড় করে আসা কিছু মুহুর্তেরই ধারাভাষ্য হয়ে উঠে নি লেখাগুলো। তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে প্রতিটি মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি,জীবনকে দেখার ভিন্ন ভিন্ন ধারা,তারই ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পেয়েছে বিরল কিছু দার্শনিক তত্ত্ব।
মঞ্জুলী কাজী যখন বাবাকে উদ্ধৃত করে লিখেন, বাবা বলতেন”ধর্মকে নিজের ভেতরে ন্ওা। ব্লটিং পেপারের মতো আত্মস্থ করো, দেখবে ধর্মের প্রতি কোনো সংশয় থাকবে না’ তখন মনে হয় এ নিছক বাবা মেয়ের স্মৃতির আলেখ্যমাত্র নয়।
নুর মোহাম্মদ কাজী যখন ‘ বাবার শাসনকর্তার রুপ’টিকে সন্তানের সঙ্গে অঘোষিত দূরত্ব তৈরি করে রাখার খবর জানান, তখন তাসরীনা শিখা, রোকসানা লেইস, মৌ মধুবন্তী, লুণা শিরীন, নন্দীনী খান,রোজিনা করিম কনক, ফারহানা নাহিদ বনির লেখায় বাবাকে প্ওায়া যায় মমতাময়ী মায়ের চিত্রে। সাধারনভাবে মা বলতে যে চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে উঠে এদের লেখায় বাবাও চিত্রিত হয়েছেন একই রুপে।
বাবাকে নিয়ে অনেকগুলো গদ্যের ভীড়ে তিনটিমাত্র কবিতা স্থান পেয়েছে বাবা দিবসের বিশেষ সংখ্যায়। তপন দেবনাথ,মাহমুদা নূপুর,সালমা রহমান বাবাকে নিয়ে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন কবিতার ছন্দে। বাবাকে নিয়ে আরো কিছু কবিতার সংযোজন ঘটানো গেলে ভালো হতো।
স্বল্প সংখ্যক কবিতার সংযোজনকে বাবা দিবসের বিশেষ সংখ্যার দূর্বল দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সাংবাদিক সেরীন ফেরদৌস বরাবরের মতোই তার সম্পাদনার মুন্সীয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন বাবা দিবসের বিশেষ সংখ্যাতেও। লেখা বাছাইয়ে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র এবং সুখপাঠ্যতা দুটোকে বিবেচনায় রেখে পাঠককে বিশেষ সংখ্যার পাতায় ধরে রাখার কৌশল নিয়েছেন তিনি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার চেষ্টা সফল হয়েছে। যে কোনো পাঠক এই সংখ্যাটিতে ঢুকলে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে তাকে খানিকটা কষ্ট করতে হবে।
বাবা দিবসের বিশেষ সংখ্যা করতে গিয়ে বাবাকে নিয়ে চমৎকার কিছু লেখাকে একত্রে সংকলিত করেছেন তিনি। সাহিত্যের মানদণ্ডে বিশ্লেষন করলেও এই লেখাগুলো বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন হয়ে থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। http://www.notundesh.com এ ক্লিক করে যে কোনো পাঠকই বাবাকে নিয়ে ভিন্ন স্বাদের এই সংকলনটি পড়ে দেখতে পারবেন। আমরা চমৎকার একটি সংকলন উপহার দেওয়ার জন্যে নতুনদেশ ডটকমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।