মিডিয়া এবং আওয়ামী লীগ পাশাপাশি চলতে পারে না-অপবাদ মুছনের দায়িত্ব আওয়ামী সরকারের --
গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত হচ্ছে বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল করার স্বাধীনতা, সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্ত যারা বাকশাল কায়েম করেছিল, ৪টি রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিল তাদের কাছে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নেই। আর যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয় তাহলে মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তা বুঝাই যায়। মিডিয়া ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক এতে কোন সন্দেহ নেই। দলটির ইতিহাসই হচ্ছে মিডিয়াকে দমন-পীড়ন।
তারা কখনোই সমালোচনা সহ্য করে না। তারা সব সময় মিডিয়াকে শিকল দিয়ে বেuঁধ রাখতে অভ্যস্ত। যেসব সাংবাদিক তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছে তাদেরকে অতীতে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, এখনও সহ্য করতে হচ্ছে। তবে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আ'লীগ বেশিদিন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের মুক্ত চিন্তার বহি:প্রকাশকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না।
অতীত ঐতিহ্যের অনুসরণ করতে গিয়ে আ'লীগ এবারো একটি পত্রিকা (আমার দেশ) ও একটি টিভি চ্যানেল (চ্যানেল ওয়ান) বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো এই দু'টি প্রচার মাধ্যমই দেশের শীর্ষস্থানীয় ও জনপ্রিয় মিডিয়ায় পরিণত হবে। আ'লীগ একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতন করছে আর সংবাদপত্র বন্ধ করে দিচ্ছে অথচ তারা বলছে গণমাধ্যমের ওপর তারা কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ করেনি। তাদের মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে সঠিক কথা বলছেন না। আ'লীগের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অতীতে যেভাবে বিরোধীদল ও দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিল, এখনো সবাই সেভাবে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
২০১০-২০১১ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী তার দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার মধ্যে সংবাদপত্রের ওপর তার সরকারের অবস্থান বিষয়ে মিথ্যাচার করে গেছেন। তিনি বলেছেন, আমি আমার গত বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রবাহের অবাধ চলাচল নিশ্চিত হলে সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। একথার সূত্র ধরে বলতে চাই, আমাদের সরকার এ যাবত গণমাধ্যমের ওপরে সবিশেষ হস্তক্ষেপ করেনি অথবা আইনের বরখেলাপে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সাংবাদিকরা আমাদের সরকারের সকল কর্মকান্ডের খবর কোনরূপ হস্তক্ষেপহীন ভাবেই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তুলে ধরতে পারছেন। অথচ সরকারের দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এমন অনেক মিডিয়াকে তাদের সংবাদ কাভার করতে পর্যন্ত দেয়া হয় না।
আর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলে গেলেন, সাংবাদিকরা আমাদের সরকারের সকল কর্মকান্ডের খবর কোনরূপ হস্তক্ষেপহীনভাবেই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তুলে ধরতে পারছেন। তারা আবারো প্রমাণ করলে তাদের কথা ও কাজে কোন মিল নেই।
দৈনিক আমার দেশ'-এর ডিক্লারেশন বাতিল, প্রেস সীলগালা করা, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে পত্রিকা অফিস ঘেরাও করে মধ্যরাতে পুলিশী অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার এবং পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারীদের আসামী করে মামলা দায়ের করার পরও তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ জাতীয় সংসদে জঘন্য মিথ্যাচার করে বলেছেন, ‘‘এখন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া যে স্বাধীনতা ভোগ করছে, তার নজির পৃথিবীতে নেই। তথ্যমন্ত্রীর কথা বাদ দিলেও খোদ প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া বিষয়ক সর্বশেষ বাতচিত আমাদেরকে আরও হতবাক, হতাশ ও আতঙ্কিত করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে প্রধানমন্ত্রী একই ধরনের কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন, ‘‘দেশের সংবাদ মাধ্যম সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। '' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দুনিয়ার তাবৎ ফ্যাসিস্ট শাসকদের আত্মপক্ষ-কৌশল থেকে আলাদা নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা-সমিতির স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ যত গালভরা বুলি আওড়িয়েছিল, ক্ষমতায় আসার পর তার সবগুলোই তারা একে একে গিলে খাচ্ছে। দৈনিক ‘ইত্তেফাক' এবং তার সম্পাদক মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের আক্রোশ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানে না। অব্যাহতভাবে জুলুমের যাঁতাকলে ইত্তেফাক এবং মরহুম মানিক মিয়া নিস্পেষিত হয়েছেন বলেই আজ মানিক মিয়া মরেও অমর এবং দৈনিক ইত্তেফাক পেয়েছে এক শক্ত ভিত।
বাংলাদেশের যতগুলো সড়ক রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্ত রাজপথ হলো মানিক মিয়া এভিনিউ। ইত্তেফাক ও মানিক মিয়াকে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে দেয়ার জন্য মানিক মিয়ার ধৈর্য এবং সংগ্রাম যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দমন-নিপীড়ন। অনেকের মতে, মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাককে অমর করেছে পাকিস্তানী সরকারের জুলুম এবং নির্যাতন। মনে হচ্ছে, এসব ইতিহাস আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে। সেদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ, ইত্তেফাক এবং মানিক মিয়া বলতে গেলে একীভূত হয়েছিলেন।
সেই শেখ মুজিবেরই কন্যা হলেন শেখ হাসিনা। মানিক মিয়ার সংগ্রামে ইত্তেফাকের প্রতি শেখ মুজিবের সহমর্মিতা তার কন্যা শেখ হাসিনা মনে হয় ভুলে গেছেন। তা না হলে ‘দৈনিক আমার দেশ' এবং তার সংগ্রামী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের প্রতি এই সরকার কেন এতো খড়গহস্ত? উলঙ্গভাবে দৈনিক আমার দেশের ডিক্লারেশন বাতিল করা হলো, যেরূপ নগ্নভাবে আমার দেশের প্রকাশক হাশমত আলীকে গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়া হলো, যেরূপ ন্যক্কারজনকভাবে হাশমত আলীকে দিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত করা কাগজে তাদের কথামত তার স্বাক্ষর নেয়া হলো, সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে, আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে আরেকটি সাহসী পত্রিকার জন্ম দিচ্ছে। সেই পত্রিকারটির নাম আমার দেশ। মনে হচ্ছে শেখ হাসিনাই জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আরেকজন মানিক মিয়ার জন্ম দিচ্ছেন।
আর সেই নতুন মানিক মিয়া হতে যাচ্ছেন মাহমুদুর রহমান। আমার দেশ বন্ধ করার ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ পাশাপাশি চলতে পারে না। অনুরূপভাবে মতামত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং আওয়ামী লীগও এক সঙ্গে চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস গণতন্ত্রকে হত্যা করার ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের ইতিহাস।
এই দলটি যখন বিরোধীদলে থাকে তখন গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতার জন্য তার স্বরে চিৎকার করে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সর্বপ্রথম সেই স্বাধীনতাকেই হরণ করে। আওয়ামী লীগের দুই চেহারা দেখা গেছে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের আমলে। দেখা গেছে শেখ হাসিনার শাসনকালের প্রথম আমলে এবং এখন দেখা যাচ্ছে বর্তমানে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনকালে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
রয়ে যায় শুধু একটি মাত্র দল। তার নাম বাকশাল। তিনি সমস্ত সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রয়ে যায় শুধু সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক পত্রিকা। সমস্ত রাজনৈতিক শ্লোগান বন্ধ করা হয়।
আবার সেই বাকশালী দুঃশাসনের কালো দিনগুলো যেন ফিরে আসছে এবার আরো ভয়াবহরূপে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন আমার দেশ বন্ধ করা হলো। সারাবিশ্ব যখন উদার গণতন্ত্র এবং বিশ্বায়নের পথে এগুচ্ছে তখন আওয়ামী সরকার দুয়ারগুলো সব বন্ধ করে দিচ্ছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার, স্বাধীন সাংবাদিকতা, মত প্রকাশের সাংবিধানিক-নাগরিক অধিকার পদদলিত করার নব্য বাকশালী পদচারণা হিসেবেই গণতান্ত্রিক সমাজ একে বিবেচনা করছেন।
সবাই বলছে, অঘোষিত বাকশাল তো চলছেই।
এদিকে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, সরকারের নির্দেশে তাদের মক্কেলকে রিমান্ডের নামে অজ্ঞাত স্থানে নেয়া হয়েছে এবং হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। আইনজীবীরা আরও অভিযোগ করেছেন, ম্যাজিস্ট্রেট বেআইনীভাবে মাহমুদুর রহমানের রিমান্ড মঞ্জুর করে রিমান্ড সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছেন। আমার দেশ সম্পাদককে রিমান্ডে নেয়া যাবে, তবে তাকে নির্যাতন করা যাবে না, হাইকোর্টের এই সবশেষ রায় সরকার পক্ষ পালন করেনি। হাইকোর্ট মাহমুদুর রহমানকে জেলগেটে তার আইনজীবীদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছে।
কিন্তু সরকারের অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসাররা উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেছেন। দু'দফায় একজন সম্পাদককে ১২ দিনের পুলিশী রিমান্ডের উদ্দেশ্য যে অশুভ এবং সরকারের ক্ষমতা জাহিরের নমুনা, সেটা সবাই বোঝেন।
বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সংসদের বিরোধীদলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, রিমান্ডে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের মাধ্যমে আওয়ামী বাকশালী সরকার মাহমুদুর রহমানকে মেরে ফেলতে চায়। তাকে চোখ বেঁধে গভীর রাতে ৫/৬ জন লোক তাকে বিবস্ত্র করে নিষ্ঠুর ও মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালাচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বেগম জিয়া হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, নির্যাতনের ঘটনার জন্য মাহমুদুর রহমান যাদের হেফাজতে ছিলেন কেবল তারাই দায়ী নন, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যাদের হুকুমে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তারা এ দায় এড়াতে পারবেন না। ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদকারীদের পরিণাম ভাল হবে না। বেগম জিয়া বলেছেন, এ সরকার ইতোমধ্যে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করেছে। অনেক সাংবাদিককে বেকার করেছে। অপছন্দের টক-শোগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
সংবাদ ও মতামত ফ্যাসিবাদী কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করছে। সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, এই ফ্যাসিস্ট হিংস্রতার মুখে আজ মাহমুদুর রহমান কেন, কোনো নাগরিকই নিরাপদ নয়। কোনো সাংবাদিকের পক্ষে আজ নিজের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে কাজ করা অসম্ভব।
এ নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমি জানি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নীতিমালা লঙ্ঘনের এই কুৎসিত নজিরের বিরুদ্ধে তারা নিজ নিজ দেশে সোচ্চার হবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।