আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে মিডিয়া ইভটিজার তৈরী করে, সেই মিডিয়া এবং সেই সাথে খুনী র‌্যাবকে সাথে নিয়ে হবে ইভটিজিং দমন?

ইভটিজিং বিরোধী গেরিলা বাহিনী উদ্যোগটির কথা শুনে খুব ভালো লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো যাক ভার্চুয়াল দুনিয়ায় চিল্লাচিল্লি, সেমিনার, টক শো ‘র বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে আসল কাজ করা যাবে। কিন্তু স্টিকি পোষ্টের বক্তব্য, কমেন্টে প্রদত্ত মতামত, গণমাধ্যমের ভূমিকা, র‌্যা পুলিশের সংযুক্ততা, সর্বোপরি ইভটিজারদের মনে “ভয় ঢুকিয়ে” তাৎক্ষণিক ভাবে ইভটিজিং দুর করার বাসনা দেখে উল্টো আমার মনে ভয় ধরে গেল - এইটাও কি কিছু মিডিয়ার সেল্ফ ব্র্যান্ডিং এর অংশই হবে কেবল, কেবল প্রচার প্রচারণাই সার হবে, এইটাও কি র‌্যাবের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমণের উদ্যোগের মতোই টার্গেট করা মানুষদের ঘায়েল করার হাতিয়ার হবে? ইভটিজিং বিরোধী গেরিলা বাহিনীর কনসেপ্টটার কথা শুনলে প্রথমেই কমিউনিটি উদ্যোগের কথা মনে হয়, মনে হয় এলাকায় এলাকায় গঠন করা লাঠিবাশি সমিতির কথা। সেই হিসেবে এইটার পিছনে না দাড়ানোর কোন কারণ নাই। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইভটিজিং পুরোপুরি নির্মুল না হইলেও- বর্তমান পুজিবাদি, ভোগববাদি সমাজ ব্যাবস্থায় যতদুর সম্ভব, ততদুর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হইলেও হয়তো সম্ভব--- যদি কমিউনিটি একশন এই উদ্যোগের প্রাণ হয়, যদি কমিউনিটির শক্তিকে জাগায়া তোলা যায়, যদি রাষ্ট্র বা ব্যাক্তির পেশি শক্তির বদলে সামাজিক শক্তিরে এই কাজে মোবিলাইজ করা যায়, যদি দীর্ঘ মেয়াদে যে মূল কারণগুলা পুরুষদেরকে ইভটিজার বানায় সেইগুলাকে আস্তে আস্তে এড্রেস করা যায়। এই ইভটিজিং বিরোধী গেরিলা বাহিনীতে এলাকায় এলাকায় গেরিলা গ্রুপ গড়ে তোলার কথা বলা হলেও সেই গ্রুপের শক্তি কিন্তু এলাকায় বা স্থানীয় সমাজের সচেতন অংশের মধ্যে না, এর শক্তি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে : “কোথাও ইভটিজিংয়ের খবর পাওয়া গেলে, ফোনে জানালে গেরিলা গ্রুপের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হবে।

” দেখা যাচ্ছে ফিফা’র আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-র‌্যাব, পুলিশের উপর ব্যাপক আস্থা! গেরিলা গ্রুপের সদস্যারা বললেই রেব-পুলিশ হাজির হবে ঘটনা স্থলে? তাদের নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্ব নাই? সেই রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্বে কি ইভটিজিং দমন আছে? থাকলে তারা এখনই সেটা পালন করছে না কেন? গেরিলা বাহিনীকে আলাদা করে তাদেরকে নিয়ে যেতে হবে কেন? যারা এখন তাদের দ্বায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেনা, গেরিলা বাহিনী বললে তারা সেটা সঠিক ভাবে পালন করবে? আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সার্বক্ষণিক ইভটিজিং দমন করতে সক্ষম হবে? রেব যেমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড করে কালা ফারুক, মুরগী মিলন ইত্যাদি লেবেল লাগিয়ে, এক্ষেত্রেও ইভটিজার লেবেল লাগিয়ে নিরীহ তরুণদের শাস্তি দেয়া যে হবে না, ঘুষ বাণিজ্য ইত্যাদি হবে না তার নিশ্চয়তা কি? অবশ্য ক্রস ফায়ারর মাধ্যমে ছিচকে সন্ত্রাসীদের “জানে মেরে” অপরাধ দমণে রেবের সাফল্য সারাদেশেই বিতর্কিত থাকলেও পোষ্ট লেখকের ব্যাপক আস্থা র‌্যাবের উপর, কাঙ্গাল মুরশীদের (স্টিকি পোষ্টের ৬৮ নং মন্তব্য) “দুইচারটারে জানে মেরে ফেললে এই টাইপের ক্রাইমের চিন্তা মাথায় আসবে না বাকিগুলার” জাতীয় পরামর্শের জবাবে বলেছেন: “ঠিকই বলেছেন। অনেক বড়ো বড়ো অপরাধী এখন জেলখানা বেরোতে চায় না, রেবের ক্রসফায়ারের ভয়ে। ইভটিজারদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে না পারলে এর তাৎক্ষণিক সমাধান মিলবে না। ” অর্থাৎ তিনি ইভটিজারদের জানে মেরে, ক্রস ফায়ার জাতীয় ততপরতার মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন। যে কোন কমিউনিট উদ্যোগকে সমর্থন করলেও, যে উদ্যোগের পেছনে এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতা কাজ করে সেটা দিয়ে ইভটিজিং সমস্যার কোন সমাধান হবে না বলেই মনে করি।

আবার স্টিকি পোষ্টে মিডিয়ার অংশগ্রহণের কথা বলা হইছে, বলা হইছে এটিএন নিউজ, এবিসি রেডিও ইত্যাদি কর্পোরেট মিডিয়ার বিভিন্ন প্রোগ্রামের কথা। মিডিয়া ইভটিজিং বিরোধী নাকি ইভটিজিং সহায়ক সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে। বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে সব মূল্য বোধ/নারীর সম্পর্কে ইভটিজিং বাড়ানোর পিছনে ভূমিকা পালন করেছে/করছে, মিডিয়া সেগুলোকে নানান ভাবে পুরুষদের মধ্যে চাষাবাদ করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। মিডিয়ার সেইসব তৎপরতা চালূ রেখে অন্যদিকে ইভটিজিং বিরোধী তৎপরতায় সহায়তা মিডিয়ার বদমাইসি জায়েজ করারই চেষ্টা এবং এর মাধ্যমে সমস্যার গোড়া না উপরে ডালপালা ছাটার মতোই ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। যেমন: মিডিয়ায় ইভটিজিং সহায়ক যেসব মতাদর্শ শক্তিশালী করে: ক) নারী পুরুষের সম্পর্ক মাত্রই হইলো প্রেমের সম্পর্ক/ যৌনতা তাড়িত সম্পর্ক খ) পুরুষের একমাত্র কাজ হইল প্রেম করা/প্রেমের চেষ্টা করা/একটা ছাইড়া আরেকটা প্রেম করা/গলির মোড়ে খাড়ায়া থাকা/ ভাইঙা যাওয়া সম্পর্কের লাইগা হা হুতাশ করা/প্রতিশোধ লওয়া ইত্যাদি।

এর ফলে একজন তরুণের মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে,প্রেম ছাড়া জীবনে কিছুই নাই। ফলে একটা প্রেম না করলে জীবন ব্যার্থ। ফলে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যদি প্রেম করার কোন সুযোগ সেই তরুণটির না থাকে, তাইলে সে উইঠা পইড়া লাগে জোর কইরা সম্মতি আদায় করতে। গ) আর নারীর একমাত্র কাজ হইলো প্রেম করা/অতি সহজেই হুটহাট প্রেমে পড়া/একটা ছাইড়া আরেকটা প্রেম করা/ চাইনিজ ,গিফট, ফ্লেক্সি লোডের মাধ্যমে পুরুষের মানিব্যাগ খালি করা/ সাজগোজ করা/ ডেটিং/মোবাইল টকিং ইত্যাদি। এইসবের মধ্যে দিয়া মিডিয়ার নাটক/সিনেমা/বিজ্ঞাপণ/রিয়েলিটি শো’তে নারীর যে চেহারা ফুইটা উঠে তাতে নারী যে একজন অনুভূতিশীল মানুষ, তার যে আত্মমর্যাদা বোধ বলে কোন বিষয় আছে, নারী যে কেবল পুরুষের ভোগের বস্তু নয়--- এইটা বোঝার কোন উপায় নাই।

ফলে মিডিয়া নারীর প্রতি কেবল অশ্রদ্ধাই উৎপাদন করে। এইভাবে, একদিকে নির্বিচার ভোগের বস্তু হিসেবে নারীর ভাবমূর্তি নির্মাণ আর আরেকদিকে সেই বস্তুটিকে ভোগ করার উপযুক্ত ভোক্তা হিসেবে তরুণদেরকে তৈরী--- এই দুইটা কাজই মিডিয়া সফল ভাবে করছে, যে সাফল্যের ছাপ সাম্প্রতিক মডেলের যৌন নিপীড়ণের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠছে। সেই ছাপ ঢাকার জন্য মিডিয়া ইভটিজিং বিরোধী প্রচারণা করবে, ইভটিজিং বিরোধী সামাজিক আন্দোলণ করতে জনগণতে নসিহত করবে আর অন্যদিকে ইভটিজিং বা নারীর প্রতি যৌন আগ্রাসনের সকল ধরণের বাস্তব ভিত্তি উৎপাদন/পুরুৎপাদনের বাণিজ্যিক কারখানাটি চালু রেখে দিবে তা মেনে নেয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলেই মনে হয়। যদি এই ইভটিজিং গেরিলা বাহিনী কুংফু কারাতে প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মকান্ডের পাশাপাশি ইভটিজিং এর মূল কারণ গুলো, সমাজের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীকে পণ্য হিসেবে মিডিয়ায় উপস্থাপন, নারী-পুরুষ সম্পর্কে নিয়ে মিডিয়ার রগ রগে বাণিজ্য, এইসব সমস্যাকে এড্রেস না করে, যদি সামাজিক শক্তির উপর ভরসা না করে রাষ্ট্রের পীড়নকারী শক্তি র‌্যাব –পুলিশের তৎপরতার উপর নির্ভর করে তাহলে এই উদ্যোগের পেছনে যতই মহৎ উদ্দেশ্য থাকুক, এই উদ্যোগ কিছু ব্যাক্তি গোষ্ঠীকে ইভটিজিং বিরোধী দিন বদলের এজেন্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করতে পারবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.