আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুরাইনে মা ও দুই সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু : হত্যা না আত্মহত্যা?



রাজধানীর জুরাইনের একটি বাড়িতে মা ও দুই সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে পূর্ব জুরাইনের আলমবাগ এলাকার বাসার বেডরুম থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হচ্ছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের প্রবীণ সাংবাদিক সফিকুল কবিরের ছেলে রাশেদুল কবীরের স্ত্রী ফারজানা কবির রিতা (৩৫) এবং তার দুই সন্তান কবির ইশরাত পাবন (১৩) ও মেয়ে রাইসা রেশমি পায়েল (১১)। তবে এটা খুন না আত্মহত্যা এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, লাশের পাশে একটি চিরকুট ও বেডরুমের দেয়ালে লেখা পড়ে মনে হচ্ছে দাম্পত্য কলহে মা ও দুই সন্তান বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে।

ময়নাতদন্তের পর মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। জানা গেছে, সকালে ২২৯, আলমবাগের তিনতলা সোনার তরী ভবনে যায় গৃহকর্মী জিন্নাত আরা। দরজা খোলা পেয়ে সে বাসায় প্রবেশ করে। এরপর ডাকাডাকি করেও কারও সাড়া না পেয়ে তার সন্দেহ হয়। সে দেখতে পায় খাটের ওপর মা ও দুই সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে।

গৃহকর্মী তাদের শরীর স্পর্শ করে। তাদের মৃত মনে করে রিতার মামা আব্বাসকে ফোনে খবর দেয়। আব্বাস বাসায় এসে তাদের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হলে তারা এসে লাশ উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। নিহতদের আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেন, রিতার স্বামী রাশেদুল কবীর দেড় বছর আগে রিতার মামাতো বোন স্মৃতিকে বিয়ে করে।

এ নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়বার বিয়ের ঘটনাটি ছয় মাস আগে পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতে পারে। দুই মাস আগে রিতা ও তার সন্তানদের ভরণ-পোষণের খরচ দিতে রাশেদুল অস্বীকার করায় তাদের মধ্যে কলহ তীব্র আকার ধারণ করে। এরই জের ধরে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রিতা একদিন তার শাশুড়িকে চড় দেয়। পরে স্থানীয় অনির্বাণ ক্লাবে এ ঘটনার বিচার হয়।

বিচারে সিদ্ধান্ত হয় আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত রিতা ও তার দুই ছেলেমেয়ে এ বাসায় থাকতে পারবে। এরপর তাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। ৩০ জুন আসার আগেই তারা চিরদিনের জন্যই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পারিবারিক সূত্র জানায়, লাশের পাশে একটি মোবাইল ও চিরকুট পাওয়া গেছে।

দেয়ালে তাদের আত্মহত্যার কারণ লিখে রাখা হয়। তারা তাদের মৃত্যুর জন্য দাদা-দাদী, দুই ফুফু সুখন ও কবিতা এবং বাবা রাশেদুল কবীরকে দায়ী করেছে। স্বজনরা আরও জানান, গত ১০ জুন দুপুর ৩টা পর্যন্ত তারা বেঁচে ছিলেন। বাসার গৃহকর্মী জিন্নাত আরা জানিয়েছে, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সে অন্যদিনের মতোই বাসায় যায়। কিন্তু ৩ তলার বাড়ির দোতলার যে ফ্ল্যাটটিতে রিতা তার দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সে ফ্ল্যাটের দরজা ছিল খোলা।

জিন্নাত আরা জানায়, রিতা আপার শুয়ে থাকা দেখে তার সন্দেহ হয়। গায়ে ধাক্কা দিয়ে দেখে তার কোনো সাড়া নেই। পাশের বাচ্চা দুটিও নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে। ভয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে সে প্রতিবেশীদের ডাকে। কয়েকজন প্রতিবেশী এসে পুলিশে খবর দেয়।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মর্মান্তিক এই ঘটনাটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার কিছু কিছু লক্ষণ হত্যাকাণ্ডকেই সমর্থন করছে। যেমন-গৃহকর্মী সকালে বাসায় প্রবেশ করে রিতা, পবন ও পায়েলকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায় এবং সে রিতার ভাই আব্বাসকে খবর দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহকর্মী বাসায় প্রবেশ করল কীভাবে? ঘরের দরজা খোলা রাখল কে? কদমতলী থানার ওসি কাজী আয়ুবুর রহমান বলেন, পুলিশ পুরো বিষয়টিই তদন্ত করে দেখছে। সকালে কাজের বুয়া জিন্নাত আরা এসে ঘরের দরজা ধাক্কা দেয়ার পরও দরজা না খুললে সে বিষয়টি প্রতিবেশীদের জানায়।

তারা ঘরের দরজা ভেঙে তিনজনের লাশ দেখে পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও র্যাব ঘটনাস্থলে যায়। তারা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। এগুলো পরীক্ষার পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। দেয়ালে যা লেখা—দেয়ালের একপাশে অত্যন্ত কাঁচা হাতে লেখা আছে, ‘আব্বু তুমি বলছিলা যে, ৫০ বছরেও তুমি স্মৃতিকে বিয়ে করবে।

মাকে তুমি এটাও বলছিলা যে, পবন ও পায়েল তোমার পেটে আসছে বলে ঘৃৃণা হয়। আসলেই ঘৃণা লাগে যে, তোমার মতো বাবা আমরা পাইছি। আর তুমি তো তোমার কমিটমেন্ট রাখছ। তুমি ৪৪ বছরেই স্মৃতিকে বিয়ে করে দেখাইছ। তুমি এটাও বলেছিলা যে, তুমি স্মৃৃতিকে ছেড়ে দিবা।

আবার আম্মুকেও ছেড়ে দিবা। কিন্তু তুমি ছাড় নাই। আর কখনও ছাড়বা না। কারণ, তুমি তোমার মেয়ের মুখের ওপর বলছ, আমি স্মৃতিকে ছাড়ব না। তোমার জন্য একটা মেয়ের শরীর এত ইমপরট্যান্ট যে, তুমি তোমার ছেলেমেয়ের দিকে একবার তাকাইয়া দেখ নাই।

তোমরা সবাই স্বার্থপর যে, তিনটা জীবন নষ্ট করে ফেলছ। ’ সংশ্লিষ্টরা এই লেখা ছেলে-মেয়ের বলে মনে করছে। দেয়ালের আরেক পাশে অনেকটা সুন্দর হাতের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পবন ও পায়েলের মৃত্যুর জন্য রাশেদুল কবীর অবশ্যই দায়ী। ১০ বছর স্মৃতিকে নিয়ে খেলা না করলে জীবনটা এমন হতো না। তোমার বাবা মা-বোনরা যত কিছুই করুক, তুমি স্মৃতির জন্য যে মিথ্যা বলেছে তা প্রমাণিত।

যে ১টা মিথ্যা বলে সে ১০টা মিথ্যাও বলতে পারে। তুমিই একমাত্র পাবন ও পায়েলের খুনি’। এই লেখাটা রিতার বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। মৃত্যুর আগে রিতা তাদের আত্মহত্যা ও পারিবারিক বিরোধের বিভিন্ন অভিযোগের কথা ঘরের দেয়ালে ও কাগজে লিখে রেখে যান। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে রিতার কোনো আপত্তি নেই, একথা লেখা একটি কাগজে জোরপূর্বক তার স্বামী স্বাক্ষর নিয়েছে, এরকম একটি অভিযোগও দেয়ালে লেখা রয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা জানান।

যে ফ্ল্যাটটিতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ওই ফ্ল্যাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাসার লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আলামত হিসেবে বিভিন্ন জিনিসপত্র পরীক্ষা করছে সিআইডি। ওয়ারী বিভাগের ডিসি তৌওফিক মাহবুব চৌধুরী জানান, লাশের পাশে একটি পানির জগ ও একটি গল্গাস পাওয়া গেছে। পানির জগটির অর্ধেকটায় তরল পদার্থ ছিল। সেগুলো বিষ কিনা তা নিশ্চিত হতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে।

তবে তিনি বলেন, ঘটনা প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা মনে হচ্ছে। সাংবাদিক সফিকুল কবির জানিয়েছেন, এ মৃত্যুর সঙ্গে তার কোনও সম্পৃক্ততা নেই। নিহত রিতার আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। এর আগেও একাধিকবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ গত ৬ মে আমার স্ত্রী অর্থাত্ রিতার শাশুড়িকে রিতা শারীরিকভাবে আহত করে।

এরপর থেকেই আমি জুরাইনের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমার গ্রামের বাড়ি সোনারগাঁওয়ে চলে গেছি। এ ঘটনায় আমাকে জড়ানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ব্যাপারে কদমতলী থানার সাব-ইন্সপেক্টর গোলাম মোস্তফা জানান, এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.