আপাতত কিছু বলবোনা
গ্রামের কাগজ সংবাদ - ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল এক বছরেও ঘুরে দাড়াঁতে পারেনি। আজ আইলার' এক বছর পূর্তিতে বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে আজকের এই দিনে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, সাতীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার কয়েক লাধিক মানুষ নতুন করে বাঁচার চেষ্টা শুরু করেছে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের এ উদ্যোগ অনেক স্থানে সফলও হয়েছে। কিন্তু কয়রার জোরশিং, দণি বেদকাশি, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, সাতীরার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী এবং প্রতাপনগরে এ উদ্যোগ প্রাথমিকভাবে সফল হলেও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে তা ধরে রাখা যায়নি।
কাজী শামীম আহমেদ খুলনা ব্যুরো থেকে জানান, গত বছর আইলায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকার গ্রাম-জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয় সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ উপজেলা, সাতীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই চারটি উপজেলার দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুসহ পাঁচ লাধিক মানুষ তিগ্রস্ত হয়। এছাড়া লাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত ও ৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৫৪ একর ফসলি জমি লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। তিগ্রস্ত হয় ৬ শতাধিক শিা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
এলাকার শিার্থীদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া পাঁচটি ব্রিজসহ ৯৯৯ কিলোমিটার রাস্তা ও ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জোয়ারের তোড়ে ভেঙ্গে যায়। এদিকে আইলার পর দীর্ঘ এক বছর অতিবাহিত হলেও এখনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। এরমধ্যে জোয়ারের পানির তোড়ে নতুন করে বেড়িবাঁধ, রিংবাঁধ ও কোজার ভাঙ্গতে শুরু করেছে। বাড়িঘর হারানো সহায়-সম্বলহীন হাজার হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
নদীর জোয়ার-ভাটা ও অতিবৃষ্টির কারণে ভাঙনকবলিত এলাকার আয়তন বড় হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে দেয়া মাটি ভেসে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের পাঁচ লাধিক মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে ওয়াপদার বেড়িবাঁধে এবং তার আশপাশের উঁচুস্থানে বিভিন্ন সড়কের ওপর ঝুপড়ি বেঁধে, প্লাবিত এলাকায় বাঁশের মাচা করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে তিগ্রস্ত হওয়ার এক বছর অতিক্রান্ত হলেও উপকূলীয় অঞ্চল দাকোপ কয়রার এলাকায় আজও জোয়ারের পানি ওঠানামা করছে। তিগ্রস্ত এলাকার অসহায় ছিন্নমূল মানুষ তাদের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে পারছে না। এখনো এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রাস্তার ওপর বসবাস করছে।
তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত বলে তারা জানিয়েছে। তবে প্রশাসনের দাবি, তিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফিরে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে। গত ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার জলোচ্ছ্বাসে এসব এলাকা পাবিত হয়। সেই থেকে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ঘরবাড়ি হারিয়ে আকাশের নিচে বসবাস করছে।
দীর্ঘ এক বছরে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ আটকানো সম্ভব না হওয়ায় নদীর সঙ্গে জনবসতি এলাকা একাকার হয়ে জোয়ারভাটার সঙ্গে মিশে গেছে। প্রতিনিয়ত পানি ওঠানামা করছে। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। দিন-দিন মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এলাকার মানুষ ঢাকা খুলনা সদর, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকেই সহায়-সম্বল বিক্রি করে ও জমানো অর্থ দিয়ে জমি-জায়গা ক্রয় করেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পেয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেকেরই।
আমাদের দাকোপ উপজেলা প্রতিনিধি জানান, আইলায় সহায় সম্বল হারানো অসহায় বিপন্ন মানুষের খোঁজ কেউ রাখেনি। আইলায় বিধ্বস্ত বেড়ীবাঁধ নির্মানের নিমার্নের সিংহভাগ অর্থ লুটপাত সহ ত্রাণ বিতরণের অনিয়ম দূর্নীতি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
দীর্ঘ ১ বছরেও বিধ্বস্ত বেড়ীবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় খোলা আকাশের নিচে ওয়াপদা বেড়ীবাঁধের উপর পচা দূর্গন্ধ ও লবনাক্ত পানির সাথে নিরন্তর লড়াই করে চলেছে দূর্গত এলাকার লাধিক লোক।
মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল, গাবুরা থেকে ফিরে জানান, জলোচ্ছাসে ভেসে গিয়েছিল ৫৯ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। আজ আইলার এক বছর পূর্ন হল। কিন্ত দু:খ, দুর্দশা লাঘব হয়নি ভুক্তভোগিদের। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হলেও আইলা কবলিত শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগরের তিগ্রস্ত এলাকাসমুহের বেড়ী বাঁধ মেরামতের কাজ এখনও শেষ হয়নি।
হাজার হাজার কর্মহীন মানুষ এখনও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়ে অপোয় আছে বসত ভিটায় ফেরার। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য চলছে হাহাকার। অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা আর অন্ন বস্ত্রের অভাবে এখন আইলা দুর্গতরা দিশেহারা। গত এক বছরে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও এমপিসহ গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা একাধিকবার দুর্যোগ কবলিত এলাকা পরিদর্শনে এলেও আইলা'য় তিগ্রস্তদের পুনবার্সন এবং তিগ্রস্ত এলাকার অবকাঠামো পুনর্গঠনের কার্যকর কোন পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়নি। ব্যাপক য়তির পরও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী একটি বারের জন্য দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে না আসায় এলাকাটিকে দুর্গত ঘোষণা সংক্রান্ত স্থানীয়দের দাবি কোনো কাজে আসেনি।
আইলা'র আঘাতে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয় সাতীরার সুন্দরবন উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা,পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালীনি, আটুলিয়া, মুন্সীগঞ্জ এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর,আনুলিয়া, দরগাপুর, ইউনিয়ন। এছাড়া দুটি উপজেলার আরও ১০ টি ইউনিয়ন ব্যাপক ভাবে তিগ্রস্ত হয়। আইলার আঘাতে উপকূলীয় জনপদ আট থেকে দশ ফুট উঁচু হয়ে আসা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে গাবুরা,পদ্মপুকুর,আটুলিয়া ও মুন্সীগঞ্জের ৯০ কিলোমিটারেরও বেশী বেড়ী বাঁধ সম্পুর্ণভাবে ধ্বসে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। শিশু ও নারীসহ ৫৯ জন মানুষের প্রাণহানীর পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে উপজেলার ৯০ হাজার কাঁচাঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। তিগ্রস্ত হয় ৬৭ হাজার পরিবার ।
জলোচ্ছ্বাসের সময় ডুবে যাওয়া বাড়ী হতে নৌকা যোগে নিরাপদে যাওয়ার পথে ইমান আলীর পরিবারেরই পাঁচ শিশুসহ ৯ সদস্যের সলিল সমাধি হয়। আইলা'র তান্ডবে ৩৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা তিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার গবাদী পশু,দুই শতাধিক হেক্টর জমির ফসল এবং বত্রিশ হাজার একর জমির প্রায় ছয় কোটি টাকার চিংড়ী সম্পদ সম্পদ বিনষ্ট হয়। ১৮০ শিা প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ মন্দির ও আড়াই শত কিলোমিটার কাঁচা পাকা রাস্তা ধ্বংস হয় আইলা'র তান্ডবে। আইলা'র এক বছর অতিক্রান্ত হলেও অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে গাবুরা ও পদ্মপুকুরের ৫০ হাজারের বেশী মানুষ এখনও বেড়ী বাঁধের ওপর পলিথিনের মধ্যে বসবাস করছে।
মিজানুর রহমান আকন, বাগেরহাট থেকে জানান, বাগেরহাটের আইলা দূর্গত সহস্রাধিক ছিন্নমূল মানুষ এখনও তাদের মাথা গোঁজার ঠাই পায়নি।
তারা এখনও খোলা আকাশের নীচে চরম ঝুঁকির মধ্যে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বলেশ্বর পাড়ের এ ছিন্নমূল মানুষের ঘরবাড়ী পুনঃনির্মাণের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের অবস্থা সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তারা সহায়-সম্পদ হারানোর বেদনা নিয়ে খোলা আকাশের নীচে এখনও বাঁচার সংগ্রামে ঝুপড়ি ঘর তুলে চরম ঝুঁকির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বৃষ্টিতে তাদের অবস্থা আরও করুণ হয়ে পড়ে।
বর্ষায় আবারও তাদেরকে বানের পানিতে ভাসতে হবে এ আশংকায় কাটছে তাদের দিন। সরকার বা স্বেচ্ছসেবী সংগঠন কেউই তাদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে দুর্গতদের জন্য গৃহনির্মাণসহ পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি।
শেখ মনিরুজ্জামান মনু কয়রা (খুলনা) থেকে জানান, গত এক বছরে উপকুলীয় মানুষের মন থেকে আইলার ত বিন্দুমাত্র শুকিয়ে যায়নি। প্রতি অমাবশ্যা পূর্ণিমা তিথিতে অস্বাভাবিক জোয়ারে আইলার ত আরও দগদগে হচ্ছে।
অবস্থা এমনই হয়েছে যে, গত এক বছরেও বাঁধ পুরোপুরি মেরামত না হওয়ার কারণে আইলা পরবর্তী পরিস্থিতি প্রতি অমাবশ্যা পূর্ণিমা তিথিতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করছে। দীর্ঘ এক বছরেও সবকিছু হারানো অসহায় এ সকল মানুষ ঘরে ফিরতে পারেনি।
গনেশ পাল, মোরেলগঞ্জ থেকে জানান, ঘূর্নিঝড় আইলায় মোরেলগঞ্জের ৩ জনের প্রাণহানী সহ ১৬ ইউনিয়নের ৪২৬ বর্গ কিলোমিটারের উপজেলা আইলার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে পানির নীচে নিমজ্জিত হয়। এক বছর অতিবাহিত হলেও আইলায় নিখোঁজ ৫ জেলের সন্ধান এখনো মেলেনি। এখনো এলাকার মানুষ আইলার ব্যাপক তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
পর্যাপ্ত পরিমান ত্রাণ আসলেও তার যথাযথ ব্যবহার হয়নি। লুটপাট হয়েছিল অধিকাংশ ত্রান সামগ্রী। আইলায় মৃতের সংখ্যা কম হলেও তির পরিমাণ ছিল সিডরের চেয়ে অনেক বেশি।
শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী তীরের রায়েন্দা বাজার পূর্বমাথার সাড়ে চার'শ পরিবার সহ সাউথখালী ইউনিয়নের বগী, গাবতলা, সোনাতলা ও তাফালবাড়ী এলাকার এক হাজারেরও বেশি পরিবার সামান্য পলিথিন ও ঝুপড়ির নিচে বসবাস করছে। খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের সবকিছু আইলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
বেড়ি বাঁধের বাইরের তিগ্রস্ত এ পরিবার প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানিতে ভাসছে। এরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা তিগ্রস্তদের গৃহ সহায়তা দিলেও হতভাগ্যদের কপালে ঘর জোটেনি। নিজস্ব জমি নেই সে কারণে সরকার এবং এনজিও কেউই তাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেনি। অনেক এনজিও তাদের ঘর দেয়ার কথা বলে ছবি, নাম নিয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এস. এম আলাউদ্দিন সোহাগ পাইকগাছা (খুলনা) থেকে জানান, গত ১ বছরে য়-তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপজেলার হজার হাজার মানুষ। মানবেতর দিন যাপন করছে প্রায় ৩০ হাজার লোক। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পাড়ি জমিয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে শত শত নারী পুরুষ। য়-তির পরিমান অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ না হওয়ায় এবং দলীয় প্রভাব, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম, দুনীতির কারণে আইলায় তিগ্রস্ত পাইকগাছার হাজার হাজার মানুষ গত ১ বছরে তাদের য়-তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।