এই এক মাসের ভিতরে আমার চুলেচুলে চেনা হয়ে গেল সেলিম ছেলে হিসেবে কোন প্রকৃতির, বয়সের দিক থেকে আমার সমবয়সী। তাই ঘনিষ্ট হতে বেশী সময় লাগল না। এই গ্রামেরই ছেলে। বিএ পাশ করেছে। আমি যে স্কুলে চাকরী পেয়েছি সেখানেই মাস্টারী করছে।
পাঁড়াটেক প্রাইমারী স্কুল। কানাঘুষো চলছে খুব অচিরে এটি হাইস্কুলে পরিণত হবে। ফান্ড্ েটান পড়ায় বাড়তি ঘর তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই শুভ কাজটি আরম্ভ হয়েও হঠাৎ থেমে যায়। তবে আমাদের হেডমাস্টার সাইফুল ইসলাম ভূইয়া সাহেব এই ব্যাপারে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খুব দৌড়াদৌড়ি করছেন।
আমি এখানে ঢাকা থেকে এসেছি।
মেসের এক সকালে চা-নাস্তা খাওয়ার সময় চোখ বুলাচ্ছিলাম সংবাদপত্রে। এক বেকারের সবচেয়ে প্রিয় বিজ্ঞাপনের পাতা। আমার-ও; চোখে পড়ল ‘শিক্ষক চাই’ কলামটি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য একজন শিক্ষক আবশ্যক।
হাস্যকর এক বিজ্ঞাপন! সাড়ে চার হাজার টাকার বেতনে শহর ছেড়ে কোন বোকা যাবে ওখানে চাকরী করতে? অন্যদের চোখে এটা কেমন আকর্ষণীয় ছিল আমি জানি না, তবে আমার মত ঘা খাওয়া বেকারের জন্যে একটি চাকরীই ছিল যথেষ্ট। আমি আমার পরিজিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ আলাদা হতে চাই। এক কথায় বলা যায় আজ আমি পালাতে চাই বহুদূরে। যাক সে কথা, চাকরীটা আমার হয়ে গেল। ওরা যেনো আমার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল।
পাঁড়ারটেকে এসে দেখলাম আমার উপযুক্ত চাকরী হলেও, উপযুক্ত বাসস্থান জুটেনি। আমাকে অনেক দিন থাকতে হল মাহবুব স্যারের বাড়ীতে। কিন্তু অচিরেই আমাকে ঝামেলা পড়তে হল। মাহবুব স্যারের একমাত্র মেয়ে আর মেয়ের জামাই বেড়াতে এসেছে, ঘরটা এখন তাঁর প্রয়োজন তা আমি জানি। তাই আমাকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে সরে যেতে হবে বিকালের মধ্যে।
তবে মাহবুব স্যারের বাড়ীতে আরও একটি বাড়তি ঘর আছে, ওই ঘরটা গোয়ালঘরের সংলগ্ন। সেখানে আমার মত এক শহুরে ছেলে একরাতেই গরমে আলুসেদ্ধ হয়ে যাব।
হেডমাস্টার ভূইয়া সাহেবের কাছে আমার সমস্যা নিয়ে আমি অভিযোগ জানালাম। এখন আমাকে তাঁর নিজের বাড়ীতে স্থান দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তা আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু এভাবে কুঁচুরীপানার মত ভাসতে পারছি না আর আমি।
আমার এখন স্থায়ী কিছু একটা প্রয়োজন। তাই আমি খ্রীস্টান কবরস্থানের পাশের ঘরটা বেছে নিলাম। ওখান কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে আছে। আমি থাকতে অসুবিধা কি?
স্কুলের দারোয়ান হাবিবকে পাঠিয়ে দিলাম ঘর পরিস্কার করার জন্যে।
আমার কথা শোনে দারোয়ান যেনো আকাশ থেকে পড়ল। আমি ওকে কড়া ধমক দিয়ে কাজে পাঠালাম। আমি ঢাকা থেকে এসেছি, তাই আমাকে ছাত্র-ছাত্রীরা আর অন্যান্য অধস্তন কর্মচারীরা ভয় পায়। আমার কথা শোনে হেডমাস্টার সাইফুল ইসলাম ভূইয়ার চেহারা অকারণে ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। কিছু একটা তিনি লুকাতে চাচ্ছেন।
‘একরাত্রিও আপনি কবরস্থানের পাশের বাড়ীটায় থাকতে পারবেন না,’ অকৃত্রিম সদুপদেশে স্বরে বললেন তিনি। কিন্তু এটা তার মনের কথা না।
তারপর তিনি জড়তার সঙ্গে বললেন, ‘আপনি শহুরে ছেলে ভূত দেখে ভয় পেয়ে যাবেন। তা ছাড়া আপনি এখানে নতুন, তাই এখানকার অনেক কিছুই আপনার অজানা আছে। ’
আমি তাজ্জব বনে যাই একজন শিক্ষিত হেডমাস্টারের মুখ থেকে এমন কথা শোনে, শহরের ছেলে বলে আমাকে ভূত দেখে ভয় পেতে হবে? এই জ্বালাতন তো সহ্য হয় না।
এতো পুরো ধূঁমোয় অন্ধকার অবস্থা!
আমি সামান্য রাশভারী কন্ঠে বলি, ‘আমার সঙ্গে যদি কবরস্থানের কোনো ভূতের সাক্ষাৎ ঘটে, তাহলে ওকে আমি সোজা মিরপুর চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেব। ভূত এক প্রকার চিড়িয়াই বটে। জনগণ খুব পছন্দ করবে খাঁচায় বন্দি এক ভূতকে দেখতে। মিরপুরের চিড়িয়াখানা লোকারণ্য হয়ে উঠবে। আমিও ভালো কমিশন পাব।
তখন আমাকে আর এখানে কষ্ট করে চাকরী করতে হবে না। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন, স্যার?’
আমার কথা শোনার পর ভূইয়া সাহেবের চেহারা কালো হয়ে এল। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আপনি কি ধরে নিয়েছেন আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করছি? স্কুলে বসে স্যারদের সঙ্গে খোশগল্প করার বদভ্যাস আমার নেই। ’
আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম তিনি ইচ্ছে করলে ওই বাড়ীটা আমাকে থাকার জন্যে দিতে পারেন কিনা। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এটা তাঁর বড় ভাইয়ের সম্পক্তি।
এখন তিনি সপরিবারে রাজশাহীতে বসবাস করছেন। বছরের একবার তিনি এখানে আসেন। বাড়ীটা তাঁর আবর্জনার মত পড়ে আছে। কারো কাছে বিক্রি করেননি। কেউ এখানে থাকেও না।
এখন ভূইয়া সাহেব ইচ্ছে করলেই আমাকে থাকার অনুমতি দিতে পারেন । স্কুলের দারোয়ান হাবিবের কাছে চাবি থাকে। সেই মাঝেমধ্যে বাড়ীটার দেখাশোনা করে।
‘আপনি কি করে কবরস্থানের পাশে বাড়ীটায় একা একা থাকবেন,’ তিনি চিন্তিত মুখে জানালেন তিনি। ‘ওখানে রাত-বিরাতে আজেবাজে কত কিছুই দেখা যায়।
শুধু আমি একা নই, এই গ্রামের সবাই বলে। আমার বড় ভাইও অদ্ভুদ কিছু একটা দেখে ছিলেন কবরস্থানে। এই কারণেই তার ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে থাকা সম্ভব হয়নি। রাজশাহীতেই সেটেল হয়েছেন। সেলিম তুমি তো সবই জানো? বল কিছু।
’
আমার পাশের চেয়ারে বসা সেলিম নড়েচড়ে বসে বয়স্কদের মত মাথা নাড়ল। আমি সকৌতুকে সেলিমের দিকে ঘুরে গভীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি দেখেছ তুমি? ভূত? আত্মা? মাই মিন ঘোস্ট্?’
সেলিম সঙ্কোচ নিয়ে মাথা নাড়ল।
মনে মনে আমার সেলিমের উপরে প্রচন্ড রাগ হলেও আমি নিজেকে শান্ত রাখলাম যথাসম্ভব। তবে আমার কন্ঠস্বরে চাপারাগ প্রকাশ পেল। আমি সরাসরি ভূইয়া সাহেবকে প্রশ্ন করি, ‘আপনিও কি স্যার ভূত বিশ্বাস করেন? এই পৃথিবীতে কোনো মানুষ কী সত্যিকার অর্থে ভূত দেখেছে?’
আমার কথা শোনে অস্বস্তিতে পড়লেন ভূইয়া সাহেব।
অস্থিরতা নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারের উপরে। সাহায্যের জন্যে সেলিমের দিকে তাকালেন। ওর চোখেমুখেও হতাশার দৃষ্টি।
তারপর তাকালেন আমার দিকে। আমাকে তিনি ঠিক বুঝাতে পারছেন না, এমন হালছাড়া অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল তাঁর ভিতরে।
সেলিমও ছোট কোরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাল মিলাল হেডমাস্টারের উদ্দেশ্যে।
তা দেখে আমার রাগটা ভিতরে ভিতরে আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এবাড়ী ওবাড়ী ঘুরে যা-ও একটা জায়গা পেলাম, না, এখানেও বাধা হয়ে দাঁড়াল গ্রাম্য কুসংস্কার! ভূতের ভয়! ভূতের খ্যাঁতা পুড়ি আমি।
আমি নিরাশ স্বরে বলি, ‘আপনার মত একজন শিক্ষিত লোক ভূতপ্রেত বিশ্বাস করবে। তা আমি ভেবে পাচ্ছি না স্যার।
’
‘আকাশ সাহেব, আপনি এই যুগের ছেলে। যথেষ্ঠ স্মার্ট, বুদ্ধিমান, সাহসী আর অত্যন্ত যুক্তিবাদী। আপনি এই দুই মাসে এখানকার সবার মনজয় করে ফেলেছেন। এখন আমরা আপনাকে আমাদের খুব কাছের একজন ভাবি,’ বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন ভুইয়া সাহেব।
‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝেন- জানা অজানার মাঝে পুরানো এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যা বুদ্ধি আর যুক্তি দিয়ে কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না।
তাই আমি এখানকার এমন কিছু এক অশরীরীর অস্তিত্ব আপনাকে ঠিক বুঝাতে পারব না। আপনি এখানে অনেক কষ্ট করেছেন। এবার আর ক’দিন আমার বাড়ীতে কষ্ট কোরে অপেক্ষা করুন। সামনের মাসেই ঘর তোলা হবে। আপনার মত একজন ভালো ছেলের কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না।
’
আমি সারামুখে হাসি ফুটিয়ে বলি, ‘যতদিন আমার ঘর না হচ্ছে ততদিন আমি খুব আরামে কবরস্থানের পাশে আপনার বড়ভাইয়ের পরিত্যক্ত বাড়ীতে খুব আরামে কাটাতে পারব। আমার জন্যে ঘর তুলে বাড়তি খরচের কোনো কারণ আমি দেখছি না। আমি ওখানে মানিয়ে নিতে পারব। আমার একা একা থাকার অভ্যাস আছে। এই জীবনের বেশীর ভাগ সময় আমি একা কাটিয়েছি।
তাই আপনি কোনো দুঃচিন্তা করবেন না। ’
হেডমাস্টারের শত অনুরোধেত্ত আমার জেদ বজায় থাকল। একসময় তিনি আমার প্রতি অসামান্য বিরক্ত আর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। আর কি করবেন, আমার ইচ্ছায় মত প্রকাশ করলেন। আমি কেন এমন আচরণ করলাম তা আমি জানি না।
তখন আমার ভিতরের কিছু একটা ভর করেছে। আমি একাকী থাকতে চাই। এই পৃথিবীতে আমরা সবাই একা।
পাঁড়ারটেক গ্রামটাকে এককথায় বলতে হবে পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের কবিতার মত কিংবা জীবানানন্দ দাশের কবিতার মত সৌন্দর্যময় অপূর্ব একটি গ্রাম। তিন বছর হলো বিদ্যুৎ এসেছে।
তিন মাইল দূরে কালিগঞ্জ বাজার। ওখানে কলেজ, সিনেমাহল, থানা আর পোস্ট অফিস আছে। রেলপথে কমলাপুর হতে দূরত্ব তিন-চারঘন্টা। পাঁড়াটেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটি দেওয়া হল সাড়ে তিনটায়। অন্যান্য দিনে ছুটি হয় চারটায়।
আমি যখন স্কুল থেকে বের হলাম, আমার সঙ্গেসঙ্গে সেলিমও বের হয়ে এল। আমি কোনো কথা না বলে মাঠের ওপাঁড়ে পুকুরের দিকে হনহন কোরে হাঁটা দিলাম।
সেলিম চুপচাপ আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করল।
গ্রামীন ফোনের নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এখানে ভালো লোক নেই। সাভির্স সেন্টার অনেক দূরের পথ। যাই যাচ্ছি বলে যাওয়া হচ্ছে না আর ফোনটাও সারছে না। ঢাকায় ফোন করার কথা। ফোন করতে আমার তেমন ভালো লাগে না।
নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না বলে মোবাইল পকেটে রেখে দিলাম।
মেঘলা আকাশ, রৌদ্রের কোনো আনাগোনা নেই। চারিদিকে ছায়াময় শান্তির আমেজ। ছাত্র-ছাত্রীদের জটলার কোলাহল ছাড়িয়ে দূরে সরে এলাম।
স্কুলের মাঠের পাঁড়ে পুকুরটা বড়, কলাগাছের সারিতে বৃক্তাকারে ঘেরা, পাশে বাঁশের ঝাড়, ফসলের ক্ষেত, বাড়ীঘর ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।
পুকুরের পাঁড়টা খুব নির্জন। এখানে আমি আসি বলে সচরাচর কেউ এখানে আসবে না। আমি এখানে একা বসে সিগারেট ফুঁকি আর অতীতের নানা আনন্দবেদনার সুখ দুঃখদের কথা ভাবি। তখন আমার আশেপাশে কেউ থাকে না, শুধু তখন মাথার উপরের পড়ত্ব বিকালের রূপালীধূসর শান্ত রৌদ্র পরম বন্ধুর মত কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় আমারি মত নিঃসঙ্গ! কিংবা, তালপাকা খাখা রৌদ্রেও আমার কোনো অসুবিধা হয় না; পুকুরের পাঁড়ে বড় জামগাছটার তলে সব সময় ছায়া পড়ে থাকে। মাটির উপরে বের হয়ে আছে বড়বড় শিকড়।
ওখানে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা যায় পুকুরের টলমল কাজল কালো আয়নার মত পরিস্কার জলে।
আমি নির্জনতা খুব পছন্দ করি। তাই ভোরে, কিংবা পড়ন্ত দুপুরে, কিংবা রাতে-প্রায় প্রতিদিনই আমাকে এখানে আসতে হয়। পুকুরের কালো টলমল আয়নার মত পরিস্কার জলের দিকে আনমনা হয়ে যতটুকু সময় তাকিয়ে থাকি তারচে’ বেশী সময় আমি হৃদয়ের গভীর শূন্যতার কথা ভাবি একা বসে।
জামগাছের এক শিকড়ের উপরে বসলাম আমি।
আমার পাশে আর এক শিকড়ে সেলিম বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললে যে কবরস্থানের পাশে বাড়ীটায় তুমি আজ থেকে থাকবে?’
‘হ্যাঁ,’ বসাবস্থায় আমি শরীরটা সামান্য সামনের দিকে মুচড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতে করতে জবাবে দেই। একটা সিগারেট আমি এগিয়ে দেই ওর দিকে।
‘নাও। ’
সেলিম নীরবে সিগারেট নিল। আমরা দুজনে নীরবে আরও কিছুক্ষণ সিগারেট ফুঁকছি।
আমি বুঝতে পারছি সেলিম আমাকে কিছু বলবে। মনে মনে তাই গুছিয়ে নিচ্ছে। সময়ও নিচ্ছে। আমিও অপেক্ষা করছি। আমার কোনো তাড়া নেই।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এবার সেলিম বলল, ‘তোমাকে তাহলে পুরো কাহিনী খুুলে বলা আমার প্রয়োজন কেন আমরা তোমাকে নিষেধ করছি ওই খ্রীস্টান কবরস্থানের পাশে বাড়ীটায় একা একা থাকার জন্য। ওখানে তুমি রাতে শান্তিমত ঘুমাতে পারবে না। ’
আমার সারামুখে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ল। আবার-ছেলে ভুলানো কাহিনী বানিয়ে ফেলল নাকি? আমার ছেলেবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস ছিল। আমি প্রচুর বই পড়েছি।
ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ ছাত্রজীবনে আমার এত ভালো লেগেছিল যে, আমার এখনও মনে আছে ওই বইটা আমি কত করে একশ বার পড়েছিলাম। এক সময়ে আমি হরর সিনেমার মহাভক্ত ছিলাম। কিন্তু সময় আর জীবনের স্রোতে আমাকে অনেক পরিবর্তন কোরে দিয়েছে। এখন আর এসব ভালো লাগে না।
সেলিম শান্ত স্বরে বলল, ‘তোমার উচিত রেগে না উঠে আমার পুরো গল্পটা মনোযোগ দিয়ে শোনা।
’
‘ঠিক আছে,’ কাঁধ নাড়লাম আমি। ‘গল্প শোনার মত আগ্রহ আমার আছে। ছাত্রজীবনে আমার লেখালেখি করার খুব ঝোঁক ছিল। কিন্তু বাস্তবতার তলে আমার অন্যান্য স্বপ্নের মত ওই স্বপ্নটাও চাপা পড়ে যায়। কেন জানো?’
সেলিম এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘থাক সেলিম, আজ আমার কথা বাদ দাও। যেগুলো এখন ভুলে থাকার চেষ্টা করছি সেগুলো মনে করার ইচ্ছে জাগছে না আমার। ’
‘ইচ্ছে না হলে বলার প্রয়োজন নেই আমি তোমাকে জোর করব না,’ হাসিমুখে বলল সেলিম। আন্তরিকতার সঙ্গে আমার দিকে ঝাড়া কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে তাকিয়ে সিগারেট টানল সেলিম। ‘আমার মন তোমার সম্পর্কে কি বলে জানো?’ বলল সেলিম।
‘না,’ নিরুওাপ স্বরে বলি আমি।
সেলিম বলল, ‘তোমার জীবনে এমন কিছু ঘটে গেছে সেজন্য আজ বড্ড ঠান্ডা, উদাসিন আর কঠিন। ’
আমি চুপ হ’য়ে যাই।
‘আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা,’ পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে বলছে সেলিম। পুকুরের কালো টলমল জলে ঘাঁই মারছে মাছ।
আমারও দৃষ্টি চলে যায় সেদিকে। ‘ওখানকার এক কবর দূষিত!’
আমি ওর কথা শোনে আশ্চর্য হই। তারপর আমার হাসি পায়; আমি বলি, ‘কবর আবার দূষিত হয় নাকি?’
সেলিম শ্লেষমাখা স্বরে বলল, ‘কবরে শুয়ে থাকা মানুষটা যদি দূষিত হ’য়ে থাকে তবে সে কবরও দূষিত হবে। ’
আমি ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা বিস্তার কোরে বলি, ‘তোমার কাহিনীটা ইন্টারেস্টিঙ্, তাই আমি আগ্রহবোধ করছি। বলে যাও।
’
সেলিম বলল, ‘এখানে রবার্ট সাহেব নামে একজন ভদ্রলোক বাস করতেন। বাঙালীদের মত বাঙ্লা কথা বলতে পারতেন। কালিগঞ্জের মিশনারী স্কুল আর গির্জা তাঁর দান। ঘটনা ঘটেছিল তাঁরই বারো বছর বয়সী ছেলে ডিককে নিয়ে। মাঝে মধ্যে ছেলেটার উপর শয়তান ভর করত।
রবার্ট সাহেবের স্ত্রী ছেলেটাকে জম্ম দিয়েই মারা যায়। শোনা যায় ডিক আসলে কোনো মানব সন্তান ছিল না, সেছিল শয়তানের পুত্র। সেসময় এ-গ্রামের ওর বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরী হঠাৎ কোরে উধাও হয়ে যেতো গ্রাম থেকে। তাদের খোঁজ যখন পাওয়া যেতো, তখন তাদের একজনও জীবিত অবস্থা থাকত না। শুধু রক্তশূন্য মৃতদেহ পাওয়া যেতো।
শয়তানের পুত্র ডিক ওদের রক্তপান করার পর মেরে ফেলত। যখন এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেল তখন রবার্ট সাহেবকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলেন এক পাদ্রী। ডিককে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করার পরও সব ব্যর্থ হল। ডিকের সব শয়তানি শক্তি কেড়ে নেওয়ার পর ওকে কবর দেওয়া হয় ওই কবরস্থানে। তুমি কি ডিকের কবর দেখতে চাও? যদি তুমি দেখো তবে লক্ষ করবে যে এপিটাফে লেখা আছেঃ এখানে শুয়ে আছে শয়তানের পুত্র, ডিক রবার্ট, সন ১৯৬৭।
’
‘কবর দেখে কি লাভ?’ জিজ্ঞেস করি আমি। ‘আজ থাক অন্য একসময় দেখব। ’
সেলিম কাঁধ উঁচিয়ে শ্রাগ প্রকাশ করল। তারপর বলল, ‘প্রতি বছর এই মাসে একবার ডিকের দেখা পাওয়া যায় পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায়। ’
আমি হাঁপ ছেড়ে বলি, ‘সে কি ড্রাকুলার মত রক্তচোষা ছিল?’
সেলিমের মুখের উপরে হতাশার এককালো ছায়া পড়ল।
সে বলল, ‘তুমি যদি একান্ত থাকতে চাও তাহলে আমি বাধা দেবার কে? আমি জানি তুমি আমার বাধা মানবে না। আসলে সত্যকথা বলতে কি আমি তোমার মত সাহসী নই। তুমি কি আমার শেষ একটি কথা রাখবে?’
‘বল,’ সিগারেটের পোঁড়া টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি বলি। ‘রাখার চেষ্টা করব। ’
সেলিম বলল, ‘আমি তোমাকে একজনের কাছে নিয়ে যেতে চাই।
’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কার কাছে?’
সেলিম ওঠে দাঁড়াল। আমার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘চলই না। ’
আমি আর কিছু না বলে নীরবে মাথা নাড়লাম। যাই ওর সঙ্গে ঘুরে আসি। জানি না আবার কোনো অদ্ভূত ব্যাপারের সাথে পরিচিত হব কে জানে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি, সারাটা পথে সেলিম আমাকে কিছুই বলল না; আমি বার কয়েক জিজ্ঞেস করলে ও জানাল-আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে গেলেই সবকিছু জানতে পারব আমি।
আমি অবশ্য কোনো উচ্চবাক্য করলাম না। যাবার পথে ওসমান মিয়ার চা-স্টলে আগুন গরম শিঙারা আর চা খেয়ে, সিগারেট জ্বালিয়ে আমরা দুজন হাঁটা শুরু করলাম গ্রামের পশ্চিম দিকে। প্রায় একমাইল পথ ভেঙ্গে আমরা হাজির হলাম কানা ফকিরের বাড়ীতে। এখানে আসার পর আমার মানসিক অবস্থা কি রূপ লাভ করল সেটার বর্ণনা দেবার মত সাধ্য আমার নেই, সেলিমকে নিয়ে আমি কি করব বোঝতে পারছি না।
ওর মত লেখাপড়া জানা শিক্ষিত সচেতন যুবকের এমন ছেলেমানুষী ফ্যান্টাসী মানায় না। সমস্ত পাঁড়াটেকবাসী হয়তো এই কুসংস্কার এখনও বিশ্বাস কোরে যে, প্রতি বছর একবার ডিক নামে শয়তানের পুত্রটি কবর ছেড়ে বের হয়ে আসে, তখন ওর চোখ যার উপরে পড়ে তার আর রক্ষা নেই।
সেলিম কানা ফকিরের সামনে এগিয়ে গিয়ে ওর মুুখ নামিয়ে এনে কানে কানে কি যেন বলল নীচুস্বরে। ওদের কথাবার্তা আমার কানে পৌঁছল না। অদ্ভুদ কানা ফকির আমার মনে কোনো আগ্রহ জম্মাতে পারল না।
কানা ফকিরের দৈহিক উচ্চতা খুব বেশী হলে পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির মত, গায়ের রঙটা কালিগোলা কালো, টকটকে লাল রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি পরনে, একি রঙের এক চাদরে পিঠ আর কাঁধ জড়ান। একমাথা তেলহীন রুক্ষ চুলের জটা বটগাছের শিকড়ে মত পাকিয়ে পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পিঠের উপর, বাম চোখটা আবার শাদা পাথরের। যারজন্যে চেহারায় এক ধরনের বুনো ভয়ঙ্কর ভাব।
এই জাতীয় ফকির-ওঝাদের চেহারা ভয়ংকর না হলে ব্যবসা বোধহয় ভালো জমে না। কানা ফকির একটি হরিণের ছালের উপর ব’সে আছে।
ওর দু’পাশে কিছু বিশ্বস্ত ভক্ত আর সামনের সারিতে গুটিসুটি মেরে আছে অনেক অনুগত ভক্তবৃন্দ।
সেলিমের কাছ থেকে কিছু একটা শোনার পর কানা ফকিরের মুখখানা আষাঢ়ের কালো মেঘের মত গুরুগম্ভীর আর থমথমে হয়ে উঠল। আমার দিকে তাকালে আমি সম্পূর্ণ উদাসিনতা প্রকাশ করলে, কানা ফকিরের সারামুখে হতাশার ভাব ছড়িয়ে পড়ল। আমি কানা ফকিরের চোখের ভাষা পড়ে ফেললাম, আমাকে একনজর দেখেই কানা ফকিরের মনে এই ধারণার জন্ম নিয়েছে যে, আমাকে সে উল্টোপাল্টো কিছু বলে বোঝাতে পারবে না ।
‘এখানে আমাকে কেন এনেছ সেলিম?’ আমার কন্ঠস্বরে কঠিন কিছু যা ওকে আঘাত করল।
সেলিম মনমরা গলায় বলল, ‘তোমার ভালোর জন্য। ’
আমি বলি, ‘এই ধরণের ছেলেমানুষি আমি একদম পছন্দ করি না। ’
সেলিমের সারামুখটা থমথমে হয়ে গেল। আমি বোধহয় ওকে বেশী আঘাত কোরে ফেলেছি। কানা ফকির আসন ছেড়ে উঠে কুটিরের ভিতরে চলে গেল কিছু একটা আনার উদ্দেশ্যে।
হয়তো আমার জন্য কোনো তাবিজ-টাবিজ নিয়ে আসবে যা আমি গলায় ধারণ কোরে থাকব যতদিন এই পাঁড়াটেকে ততদিন ভূত প্রেত রক্তচোষা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
এভাবে যদি ভূত প্রেত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব মানুষকে গলায় কানা ফকিরের তাবিজ পরতে হবে। তখন ব্যবসা ভালো জমবে আর আমিও মাস্টারি চাকরী ছেড়ে তাবিজের সেলস্ম্যান বনে যাব।
আমি সেলিমের মন রাখার জন্যে বলি, ‘দুঃখিত সেলিম, আমি তোমার কোনো কাজে বাধা দেব না। ’
ও মুখে কিছু না বললেও নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কানা ফকির কুটিরের ভিতর থেকে বের হয়ে আসল। তার হাতে শুকনো একটি মালা। কাছে নিয়ে আসতে পরিচিত এক ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে এল। রসুনের গন্ধ! কানা ফকির আমার জন্যে একটি রসুনের মালা নিয়ে এসেছে। ওদের কি ধারণা আমি ট্রানসিলভেনিয়ার কাউন্ট ড্রাকুলার দূর্গে যাত্রা করছি!’
আমি হাসব না কাঁদব বোঝে উঠতে পারছি না।
শুধু কয়েক মুহূর্ত ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকলাম সেলিমের দিকে। কানা ফকির আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্য রকমের শান্ত রাশভারী কন্ঠে বলল, ‘আমি জানি তুমি শিক্ষিত আর সচেতন এক শহুরে ছেলে। গ্রামের অনেক কুসংস্কার তুমি বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমরা তোমার শক্রু না, তাই তোমার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের।
তাই বলি আজ রাত্রে যখন একা থাকবে তখন নাহয় রসুনের মালাটা গলায় পড়ো। ভোর না হওয়া পর্যন্ত এটা গলায় রেখো। যাই ঘটুক না কেন তুমি এটা গলায় রেখো। আজ রাতটা ভালো যাবে না। ডিক আজ কবর ছেড়ে উঠবেই।
কবরস্থানের দিকে মুখ করা জানালাটা খুলো না। রাত্রে কবরস্থনের দিকে তাকিওয়ো না। আবারও বলি-তোমার চোখের সামনে যাই ঘটুক না কেন মালাটা গলা থেকে খুলো না। আজকের মধ্যেই তোমার জন্যে এক রক্ষাকবজ বানিয়ে রাখব আমি কাল এসে নিয়ে যেও। সেলিম তোমার হাতের তাবিজটা দেখাও ওকে।
’
সেলিম শান্ত ভাবে শার্ট সরিয়ে আমাকে ডানহাতের বাহুতে বাঁধা ছোট রূপোর তাবিজটা দেখালে আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
কানা ফকির আবার বলল, ‘এই গ্রামের সবাই এটা কোরে এই তাবিজ পড়ে আছে। সেজন্যে শয়তানের পুত্র ডিক আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আমিও এই তাবিজ পড়ে আছি। ’
‘তাবিজ পরার পর কি আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে শয়তানের পুত্র আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না?’ আমি চাপা হেসে বলি।
কানা ফকির অস্থিরতার সঙ্গে মাথাটা এপাশ ওপাশ করল।
‘তাহলে তো আপনার কাছে তাবিজের স্টক্ থাকার কথা,’ আমি হেসে ফেলি। ‘হঠাৎ কোরো আমার মত কোনো হতভাগার প্রয়োজন হতে পারে। ’
কানা ফকির রসুনের মালাটা সেলিমের হাতে গুঁজে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘চলে যাও সেলিম, কিছু কিছু মানুষকে তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। ’
আমাকে নিয়ে সেলিম তড়িঘড়ি কোরে কানা ফকিরের কুটির ত্যাগ করল।
মাথার উপরে গড়িয়ে যাচ্ছে বিকালটা। চারিদিক ধূসর আলোতে ভরা আর পাখ-পাখালিদের বাড়ী ফেরার কাকলিতে মুখর। আমারও পাখিদের ডাক খুব ভালো লাগছে। আজ কেন জানি পৃথিবীটা নতুনের মত লাগছে, আরও যাদুময়!
সেলিম এখনও রাগ কোরে আমার সঙ্গে একটিও কথা বলেনি, আমি ওকে কোনো প্রশ্ন করছি না। আমি চাই ওর কিছু বলার থাকলে নিজের থেকে বলুক আর না বলার থাকে তবে চুপ কোরে থাকুক।
আমি ওকে সিগারেট অফার করলাম। মাথা নেড়ে জানার ইচ্ছে নেই। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলি, ‘চল,গিয়ে দেখে আসবে শওকত ঘরটা কেমন গোছগাছ করেছে। ’
সেলিম কিছু না বলে আমার সঙ্গে সঙ্গে এল। ঘরটা দেখে আমার পছন্দ হল।
স্কুলের দারোয়ান হাবিব অল্প সময়ের ভিতরে যÍ কোরে পরিস্কার করেছে। এই বাড়ীতে অনেক দিন কেউ বাস করে না তাই বিদ্যুতের লাইন কাটা। এখন আমি এখানে থাকব তাই কালকে মিস্ত্রী এসে লাইন দিয়ে যাবে। আজ বিদ্যুৎ ছাড়া থাকতে হবে। দুটো হারিকেনে তেল ভরে আনা হয়েছে।
আমাকে জানাল রাতের খাবার নিয়ে আসবে। সারা ঘরে একবার চক্ক্র দিতে আমার চোখে পড়ল যে ঘরের বড় জানালাটা পেরেক মেরে বন্ধ কোরে রাখা; আমি রাগ চেপে রাখলাম। এমনিতে গরমের দিন, রাতে বাতাস না পেলে তো দমবন্ধ হয়ে মারা যাব। তাছাড়া সারাঘরে একটি মাত্র জানালা। আমি নিজেকে শান্ত রাখলাম।
কাল নাহয় পেরেক খোলা যাবে।
বাড়ীটার পিছনে এসে দাঁড়ালাম। অদূরে জমিনের বুক ভেদ কোরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রুশের সারি চোখে পড়ল। আমার কাছে কবরস্থান কোনো ভয়ের জায়গা না। সবাইকে একদিন না একদিন এখানে শুয়ে থাকতে হবে।
এখানেই সবাইকে চিরশান্তির নিদ্রায় ঘুমাতে হয়। আসন্ন সন্ধ্যায় ধূসর আলোছায়ায় রহস্যময় কোরে তোলেছে কবরস্থানটাকে।
সেলিম ঘরের একটেবিলের উপর রসুনের মালাটা রেখে উঠে দাঁড়াল।
‘আমি যাচ্ছি,’ শুকনো মুখে বলল সেলিম। ‘রাতে মালাটা পড়তে ভুলো না।
কবরস্থানের দিকে তাকিওয়ো না, আজ ভরা পূর্ণিমার রাত। এমন একটি সুন্দর রাতে মানুষ অনেক চোখের ভুল দেখে। জানালা খুলে ঘুমাবে না আর বাইরে যেওনা। যাই ঘটুক না কেন-তুমি মালাটা ফেলে দিও না। মনে রেখো একমাত্র এই রসুনের মালাই ওই পিশাচকে দূরে রাখতে পারে।
’
আমি সুবোধ বালকের মত মাথা নেড়ে বলি, ‘আচ্ছা। ’
সেলিম আমার মুখের দিকে কয়েক মূহুর্ত চেয়ে থাকল। মনেমনে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সে বড্ড নিরাশ ভঙ্গিতে কাঁধ নেড়ে বিদায় নিল। আমি ওকে কিছু দূরে এগিয়ে দিলাম।
মাহবুব স্যারের বাড়ী থেকে আমার মালপত্র গুলো হাবিব এনে রেখেছে আমার কথামত। আমি আমার বই গুলো এনে টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখলাম। টেবিলের মধ্যস্থলে পড়ে আছে রসুনের মালাটা।
আমার হাতে কোনো কাজ নেই। বাইরে গাঢ় সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
ঘরের একটি মাত্র বড় জানালাটা পেরেক মারা বলে আলোবাতাস আসছে না। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। হারিকেন দুটো জ্বালালাম।
আজ কয়েক হপ্তা হয়ে গেল ঢাকায় কোনো মোবাইলের যোগাযোগ নেই। মাকে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে।
অলস সন্ধ্যাবেলাটা নাহয় চিঠি লেখার কাজেই ব্যয় করি। আর কাকে চিঠি লেখা যায়। আজকাল তো চিঠি লেখাই হয় না।
হৃদয়ের গভীরে শূন্যতার হু হু করা বিষাদ অনুভব করলাম। এখন আর আমার জীবনে এমন কেউ নেই যাকে ভালোবেসে চিঠি লেখা যায়।
জীবনে একদিন প্রকৃতির নিয়মে প্রেম এসেছিল, যাকে রাত জেগে কত চিঠি লেখা হয়েছে। আজ আর সেই প্রেম নেই, প্রেমটা ধীরে ধীরে মুছে গেছে। শুধু স্মৃতি মুছে ফেলা গেল না, স্মৃতি বোধহয় মানুষের ছায়ার মত, বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মাকে যতটুকু না-লিখছি তারচে’ বেশী ভাবছি একজনের কথা। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি।
মনে পড়ল কতদিন ধরে মাকে দেখি না। আজ কেন জানি মন চাচ্ছে এই হতচ্ছাড়া চাকরী ছেড়ে ঢাকায় চলে যাই। মাকে একবার দেখতে। কেন জানি বারবার মনে হল মাকে আর কখনো দেখাই হবে না।
সময় চলে যায় নিঃশব্দে, রাত আটটা বাজতে হাবিব আমার জন্য খাবার নিয়ে এল ভূইয়া সাহেবের বাসা থেকে।
আমার ঘরের বেশীক্ষণ বসল না। ওকে এখন ভীতু প্রাণীর মত দেখাচ্ছে। বাড়ী ফিরে গেল। আমিও ওকে কোনো প্রশ্ন করিনি।
আমি হাবিবকে বিদায় দিতে দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম!
রূপকথার মত সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে।
রূপালী আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। নি®প্রাণ নিথর এক সৌন্দর্যতার মাঝে কবরস্থানটা প’ড়ে আছে একা আর আমারি মত নিঃসঙ্গ!
সমস্ত পবিত্রতা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে কবরস্থানটা। অথচ বিশেষ এক কবর-কে এখানকার সব মানুষগুলো ভয় পায়। কিন্তু কেন?
আগামীকাল সময় কোরে নাহয় দেখা যাবে একবার শয়তানের পুত্র ডিকের কবর। কথাটা মনে হতেই বারবার একটা ভাবের উদয় হয় আমার ভিতরে।
আচ্ছা এমন একটি সময় লেখালেখির কাজে ব্যয় করছি না কেন আমি?
ছাত্র-জীবন থেকে আমার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করা অভ্যাস ছিল আর লেখা প্রকাশও হত। বছর তিনেক আগে আমার পরপর তিনটে উপন্যাস বাজারে বের হয়েছে, অথচ আমি জীবনের ব্যস্ততায় লেখার অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারিনি। আবার নাহয় পুরানো অভ্যাসটা ঝালাই করা যাক।
আমরি চারিদিকে চমৎকার গল্পের প্লট্ ছড়িয়ে আছে। আজ রাতেই কলম নিয়ে বসব।
মাথায় যা আসবে লিখে যাব, তারপর ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়ব। আমার লেখা আবার নতুন কোরে ছাপা হবে কিনা আমি জানি না; এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে অপরূপ চাঁদ আর জোছনার শোভা দেখলাম কিছুক্ষণ। গ্রাম্য অঞ্চল, তাই এখানে রাত নামে দ্রুত।
হাবিব রাতের খাবার এনেছে চমৎকার! সরু চালের ভাত আর মুরগীর মাংশ , সঙ্গে ডাল ফ্রী! আমি আবার পাখিদের মত খাই।
অল্পতে আমার পেট ভরে যায়। তবে কেন যেন আমি আজ পেট ভরে খেলাম বহুদিন পর।
ভারী পেটে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আমি নড়বড়ে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম টেবিলের সামনে। খাতা আর কলম টেনে নিলাম। এখনও রসুনের মালাটা টেবিলের উপর পড়ে আছে।
অসহ্যকর গন্ধ ছড়াচ্ছে। রসুনের গন্ধ এত ভয়াবহ হয় আগে জানা ছিল না। মালাটা সরিয়ে রাখলাম বইগুলোর পিছনে। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাঁড়াটেকবাসীর উদ্দেশ্যে খাতায় লিখতে শুরু করেছি : ‘শয়তান ধ্বংশের উপায়!’ যেহেতু আমার ‘ড্রাকুলা’ পড়াছিল, তাই মনমত কিছু লিখতে পারছি।
‘প্রথমে শয়তানের লাশটা কবর থেকে তোলে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো কোরে জ্বলত্ব অগ্নিকুন্ডে ফেলে দাও। তাহলে শয়তান চিরতরে ধ্বংশ হবে। কিন্তু দেখা গেল কবরে কোনো লাশ শুয়ে নেই, আছে শুধু একটা কঙ্কাল; তাহলে? চিন্তার কিছু নেই। কঙ্কালটাকে জ্বালিয়ে দাও। শয়তানের প্রভাব দূর হবে।
’
খসড়া কয়েক লাইন লেখার পর, কিভাবে গল্পটা শুরু করব বোঝতে পারছি না। মাথায় কিছু আসছে না। বিছানায় শুয়ে একটা বই টেনে নিলাম, হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিতে বই পড়তে আমার কোনো অসুবিধা হল না।
আহ্! বাইরে কি চমৎকার পূর্ণিমা!
জানালার পেরেক খোলা গেলে অবশ্য জানালার পাট খুলত। তাহলে জোছনা আর বাতাস প্রবেশ করত।
ঘর ভর্তি অসহ্যকর গরম। তালপাখা দিয়ে সারারাত নিজেকে বাতাস করলে ঘুমাব কখন?
ঘর জুড়ে ভ্যাপসা গরমের কারণে রসুনের কটু গন্ধটা নাকে ঝাঁঝাল লাগছে, মনে হয় সারাঘরে রসুন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। ডানামেলে রাত বাড়ছে। চোখের ক্ষতি হবে জেনেও বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উবু হয়ে শুয়ে একটি জমজমাট নভেল পড়ছি। জেমস্ হেডলী চেজে’র থ্রিলার উপন্যাস ‘সাডেন ডেথ’।
উপন্যাসটা পড়তে পড়তে আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এল। অখন্ড নীরবতা ভেঙ্গে ডাকছে ঝিঝি পোকা আর শিয়াল। এসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। জঙ্গল আর কবরস্থান থাকায় এখানে শিয়ালের উপদ্রব একটু বেশী তো হবেই। আমি জোরাল হাই তুলি।
খাটের নিচে হারিকেনটা রেখে দিলাম সল্তে কমিয়ে। বিশাল কালো বাদুড়ের মত অন্ধকার নেমে এল ঘর জুড়ে।
বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিড়ালের মত গড়াগড়ি কোরেও আমার গাঢ় ঘুম এল না। চোখের পাতা ভারী হয়ে এলেও ঘুমটা আজ কেন জানি পুরোপুরি হচ্ছিল না ঝিঝি পোকার ডাকে, শিয়ালের ডাকে আর নিশাচর প্যাঁচার ডাকে।
আজ অদ্ভুদ কোনো কারণে আমার সমস্ত সওা অনুভব করছে প্রকৃতিকে।
ব্যাপারটা ঠিক ব্যাখ্যা কোরে বুঝানো যাবে না। এমনি এক চাপা অস্বস্তি!
তাছাড়া বাতাসহীন ভ্যাপসা গরম ঘরে অসহ্যকর রসুনের গন্ধটা পাক খাচ্ছে। ওটা যদি আমি গলায় পড়ে ঘুমাতাম তাহলে সারারাত গন্ধে পাক খেত আমার পেট।
ঘুমে জড়িয়ে এসেছে আমার চোখ। রাত এখন কত হতে পারে আমার কোনো ধারণা নেই।
ঘড়ি দেখছি না। কেমন যেন এক অস্বস্তি!
কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে- কে যেন দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে। ঠিক তখুনি অশুভ গলায় ডেকে উঠল উল্টো স্বরে কাতারে কাতারে শিয়ালের দল। সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ উবে গেল।
বালিশের তলে রাখা আমার ঘড়িটা বের করলাম।
অন্ধকারে জ্বল্জ্বল্ করছে কাঁটাগুলো। রাত এখন দেড়টা বাজে। পাক্কা দু’ঘন্টার মত আমি বিছানার উপরে আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মধ্যে ছিলাম।
বিছানার উপরে ওঠে বসে তাকালাম সারাঘরে। ঘরের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের ভরা আলো চুইয়ে চুইয়ে ঢুকছে।
এতে যেন সারাঘরটা কেমন বীভৎস দেখাচ্ছে। তাই আমি খাটের ত’লে সলতে কমিয়ে রাখা হারিকেনের ম্লাণ আলোতে ঘরের বীভৎস ভাবটা মোটেও দূর হল না। বরং আরো বাড়িয়ে তোলেছে।
সারাঘরের একাকিত্ব গ্রাস করল আমাকে। কেমন যেন এক ছমছমে অনুভূতি আমাকে বারবার শীতল কোরে দিচ্ছে।
নাহ্! আমাকে আসলে বনের বাঘ নয়, আমাকে মনের বাঘে খাচ্ছে।
পেরেক মারা জানালার ওপাশে আসলে কিছু নেই। বাইরের বাতাস জানালার উপরে আছড়ে পড়ে এমন আওয়াজ দিচ্ছে। আর আমি এই শব্দেই কেমন শীতল হ’য়ে যাচ্ছি। কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছে কেউ একজন জানালা নক্ করছে।
সারাঘর জুড়ে কবরের মত নীরবতা নেমে এসেছে। উল্টোস্বরে ডাকছে কেন শিয়ালের পাল?
এটা তো অশুভ লক্ষণ!
হঠাৎ আমাকে আশ্চর্য কোরে দিয়ে সম্পূর্ণ থেমে গেল শিয়ালের ডাক। আমার ম’নে হল কেউ যেন ওদের গলা টিপে ধরেছে।
আমার আবার একবার ঘুম ছুটে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না সারারাত। আমি ঠিক নিশাচরের মত।
যাদুময় এই চাঁদনী রাত আর ছমছম্ েনিরবতা ভয়ঙ্কর সব কল্পনা এসে ভীড় কোরে মনে এই অস্বাভাবিক ভৌতিক পরিবেশে।
আমি এখানে একা আর প্রিয়জনেরা আজ কতদূরে, তাদের ফেলে এখানে একটা কবরস্থানের পাশে পরিত্যক্ত বাড়ীর একঘরে আমি নিসঃঙ্গ প’ড়ে আছি। এভাবেই বুঝি জীবনের তাগিদে পৃথিবীর প্রিয়জনে’রা একদিন না একদিন সবাই দূরে স’রে যায়। উবু হয়ে খাটের তলে রাখা হারিকেনের সলতের চাবি ঘুরিয়ে বাড়িয়ে দিলাম আলোটা। ঘরের সমস্ত অন্ধকার কেটে ছড়িয়ে পড়ল হলদে আলো।
বালিশের পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচটা নিলাম।
সিগারেট জ্বালিয়ে আপন মনে কয়েকটা টান দিতেই অস্বাভাবিক এক আওয়াজ আমার কানে এল। নিজের অজান্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম বন্ধ জানালার দিকে। অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে আমি থ’মকে যাই, অদৃশ্য এক চুম্বকের আকর্ষণে পেরেকগুলো খুলে আসছে, পটাপট্ ঠং কোরে একটা একটা কোরে পেরেক খ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।