আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শহীদুল জহিরের গল্প 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' : কাকের কেরামতি এবং বৈকুণ্ঠপুরের আকালু...

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

[শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) গল্প বলেন অসাধারণ যাদুকরী ভাষায়। তাঁর গল্পের বয়ন প্রক্রিয়ায় থাকে দ্বিবাচনিক প্রতিবেদন। এজন্য পাঠক অনেক সময়ই খেই হারিয়ে ফেলেন গল্পের ঘটনা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাথে। 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' তাঁর 'ডুমুরখকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প' সংকলনের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গল্প। এ গল্পটির পাঠপ্রতিবেদন নিম্নরূপ করা যেতে পারে।

এজন্য যে, অবশ্যই ভিন্ন পাঠকের কাছে এই গল্পের ম্যাসেজ ভিন্নভাবে পৌঁছায় এবং তার মানসলোকে হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্নতর ইমেজ তৈরি করবে গল্পটি। ] সিরাজগঞ্জ জেলার বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের আকালু এবং তার স্ত্রী টেপির জীবনে দাঁড়কাক বিষয়ক আশীর্বাদ এবং তাদের সারাল্য নিয়ে যাপিত জীবনের অলৌকিক ঘটনার সমহারে এ গল্পের আখ্যান জমজমাট হয়ে ওঠার আগেই আকালু কাঠ কাটতে গিয়ে যে একশ’ টাকার দশটি বাণ্ডিল সমেত ব্যাগটি পেয়েছিল তা শহুরের ধূর্ত উকিল এবং সিগারেটওয়ালা এবং অবশিষ্ট বাকি দুই বাণ্ডিল ডাকাতি হয়ে গেলে স্ত্রীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পুলিশী হেনস্তার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে বৈকুণ্ঠপুর ত্যাগ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। দয়াগঞ্জের চান্দুর ভ্রম হয় ভূয়াপুরের বাস থেকে নামা আকালুকে জয়নাল ভেবে, এতে অবশ্য আকালুর অনির্দিষ্ট গন্তব্য ঠিকানা পেয়ে যায় চান্দুর সহায়তায় দয়াগঞ্জ বস্তিতে। এবং চান্দুর কৃপায় রিকশা চালানটাও রপ্ত করে ফেলে কাঠুরে আকালু। কাঠুরে আকালু ঢাকা শহরে রিক্শা চালকের জীবন শুরু করার পর পুনরায় দাঁড়কাক বিষয়ক ঝামেলা আকালু-টেপির জীবনে কেন্দ্রীভূত হয়।

আবারো দেখা যায় টেপিকে কাকের সাথে কথা বলতে যেমনটি বৈকুণ্ঠপুরে কাকের সাথে কথা বলত। কাক তাদের জীবনে আসার পরপরই একদিন এক যাত্রী আকালুকে তার ভাড়া না দিয়ে গুলিস্তান মোড় থেকে চলন্ত বাসের পেটের ভিতর ঢুকে পড়লে আকালু লক্ষ্য করে যাত্রীটির পকটে থেকে মানিব্যাগ পড়ে গেছে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে তার মধ্যে ৭১ টাকা পায় আকালু। কিন্তু মানিব্যাগের টাকা নিজের কাছে রাখার সাহস পায় না সরল আকালু। সে তার ভাড়া একটাকা নিয়ে বাকি টাকাসহ মানিব্যাগটা থানায় জমা দিতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে সহজ মানুষ আকালু।

পুলিশী নির্যাতন এবং কাক বিষয়ক ঝামেলা থেকে রক্ষার উপায় জানায় চান্দু, জ্যোতিষ বাবার পরামর্শে শানির দশা কাটাতে একটি নীলা পাথর বাহুতে ধারণ করে। এরপর দুদিন যেতে না যেতেই জ্যোতিষী বাবার আস্তানার পাথর চুরির অপরাধে আকালু এবং তার স্ত্রী টেপি ধৃত হয়। তাদের দেড় বছর জেল হয়। জেলখানায়ও কাকের আগমন ঘটে। জ্বরতপ্ত শরীরে সেদিন আকালু মেঝেতে শুয়ে ছিল তখন একটি চমৎকার স্বর্ণের আংটি তার গায়ের ওপর পড়ে।

কিন্তু আকালু পুনরায় ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে সে সহ হাজতী আবুলকে সেটি দিয়ে দেয়; কিন্তু সেই আংটি পাচার করার সময় আবুলের স্ত্রী ধরা পড়লে আবারো আকালুকে জেলারের মুখোমুখি হতে হয়। তবে নির্মোহ সহজ সরল আকালু সত্য বলে আংটিখানা জেলারকে দিয়ে দিলে যখন তাদের সাজা শেষ হয় তখন জেলার আকালু-টেপিকে নয়াটোলার বিলের বিস্তৃত দেয়ালঘেরা একটি স্থানে থাকার জায়গা দেয়। জেলারের দেয়া ঝুপড়ির পাশেই বড় একটি তাল গাছ ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে আগমন ঘটে দাঁড় কাকের। এবারে আকালু আর টেপি কাকের সাথে তাদের অবিচ্ছেদ্য এবং অনিবার্য সম্বন্ধের সূত্র অনুমান করে কাকেদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।

দেখতে দেখতে হাজার হাজার কাকের বসতি গড়ে ওঠে আকালু-টেপির ঝুপড়ির ওপরে। এরপর কাকের বাসা ভেঙে আকালু একদিন আঠারো মণ সাইকেলের স্পোক ও বিভিন্ন ধরনের লোহার তার, ইস্পাতের খণ্ড বিক্রি করলে মহল্লাবাসী গ্রামীণ আকালুর ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে হতবাক না হয়ে পারে না : তখন নয়াটোলা মগবাজার এলাকার অনেক লোক কবুতর পোষা ত্যাগ করে তাদের কবুতরের খোপ এবং প্রাঙ্গনের বাঁশের উঁচু মাচা কালো কাকের জন্য খালি করে রাখে। কিন্তু ক্রমাগত ছমাস চেষ্টা করে তরা কাকের আবাদ করতে ব্যর্থ হয়, তখন একদিন সন্ধেবেলা তরার আকালুর বাসায় পাঁচিলের বাইরে গেটের সামনে এসে জড়ে হয় এবং আকালুকে ডেকে বার করে বলে, তুমি ঝাড়–দারনীরে সোনার দুল দিছ, আমাগোও দেওন লাগব। [ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প, পৃ.৩২] কিন্তু কোথায় পাবে তারা আরো সোনার দুল! এভাবে মহল্লাবাসীর সাথে আকালু-টেপির প্রতিবেশীর সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এক পর্যায় ঈর্ষান্বিত মহল্লাবাসী তাদেরকে অবরোধ করে।

কিন্তু এই দুই নরনারী এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও বাইরে বের হয় না। তখন তারা আকালু-টেপির ঝুপড়িতে অগ্নি সংযোগ করলে শেষ রাতের দিকে আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে দাঁড় কাকেরা তাদের বাসা ছেড়ে উড়ে চলে। কেউ কেউ দেখে যে কাকের ঝাঁকের মাঝে দু’জন মানুষের মতো, তবে মহল্লাবাসী আগুন নির্বাপিত হলেও ঝুপড়িতে প্রবেশ করে আকালু কিংবা টেপির কোথাও দেখা পায় না। তাহলে কি সত্যিই দাঁড় কাকেরা আকালু-টেপিকে তাদের সাথে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল-- এমন এক অমিমাংসিত জায়গা গল্পকার শহীদুল জহির তাঁর পাঠকদের ছেড়ে দেন। যেখানে পাঠক কুলকিনারা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়, কিন্তু কখনো সমাধান করতে পারে না-- দাঁড় কাকের অতিলৌকিক আচরণের।

এই অসাম্ভব্যতার মাঝেই গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন শহীদুল জহির। কারণ, মানুষ অনেক কিছু পারলেও এমন কিছু কিছু বিষয় আছে, যার কোনো ব্যাখ্যা সে করতে পারে না। এই যে মানুষরে অসহায়ত্ব সেই অসহায়ত্ব তখন মূত্য হয়ে ওঠে অলৌকিক ঘটনারাশির মধ্য দিয়ে। এমনি এক ঘটনা যে, কিছু সংখ্যক দাঁড়কাক একদা এলাকাবসীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী আকালু ও টেপিকে নিয়ে ভোরের আকাশ অন্ধকার করে নিরুদ্দেশের পানে যাত্রা করে। আসলে এখানে এসে গল্পের শেষ নয়, এখান থেকে শুরু হয়েছে কাহিনী... যে কাহিনী লেখা হবে ভবিষ্যতে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.