আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
শান্ত সুন্দর প্রতিবেশ, আন্তরিক, স্নিগ্ধ চোখের প্রতিবেশীরা হারিয়ে গেছে ব্যস্ত গাড়িঘোড়া আর এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠা দালানকোঠা দ্বারা অধিগৃহীত শহর গুলো থেকে। উধাও হয়ে গেছে বাচ্চাদের সমাগমে হাসিখুশি প্রতিবেশের উপর নির্ভর করে থাকা বিভিন্ন জীবন ও জীবিকাও। শিশুদের কাছে খাবার সামগ্রী বিক্রি করতে আসা সেই ফেরিওয়ালাদের এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। চোখে পড়ে না তাঁদের হাতে বানানো হরেক রকমের অদ্ভুত সব খাবার সামগ্রী যা কিনা তারা ফেরি করে ফিরত রাস্তায় রাস্তায়। ক্ষুদে খরিদ্দারদের স্বাধীন আনাগোনার অভাবে সেই ফেরিওয়ালারা হয়ত আজ পেশা বদলে ভিন্ন কোনও উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করছে, অথবা তাদের মৃত্যুর পর উত্তরসূরিরা আর অনুসরণ করেনি তাঁদের পেশা।
কি সব অদ্ভুত মজার খাবারই না তাঁরা তৈরি করতে পারতেন! বোধ করি এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল “কটকটি”। টাকার বিনিময়ে কেনা গেলেও ফেরিওয়ালারা মূলত পুরনো কাগজপত্র, ছেড়া স্যান্ডেল, জুতা, নষ্ট সরঞ্জামাদির বিনিময়ে কোনরকম মাপজোক ছাড়াই বাচ্চাদের কাছে এই খাবারটি বিক্রি করত। না হত কাগজপত্রের ওজন, না হত খাবারের কোনও পরিমাপ! অবশ্য তা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। কটকটি দেখতে অনেকটা ছাতার ডাঁটের মত। সরু এবং লম্বা।
আবার এর মধ্যে আরেকটি ধরন ছিল যেটা একটা অবিন্যস্ত ক্যারামেলের কেকের মত ছিল দেখতে। কিন্তু মৌমাছির চাকের মত ফুটো ফুটো। ফেরিওয়ালারা সেটা নিয়ে আসত একটা টিনের বাক্সে করে। চাইলে, বাক্স খুলে কোনা ভেঙে হাতে দিত টুকরো করে, একটা কাগজে। কটকটি খেতে কেমন ছিল বা আদৌ স্বাস্থ্যকর ছিল কিনা সেটা বর্ণনা করা আমাদের, সেইসময়ের শিশুদের, পক্ষে অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ; কিন্তু এটা বলা সম্ভব যে সেটা খেতে ছিল এক কথায় অসাধারণ! একই ভাবে ফেরি করে আরও বিক্রি হত একপ্রকারের ঘরে বানানো শন-পাপড়ি।
আজকাল বাজারে প্যাকেট-জাত অবস্থায় যেসব শন-পাপড়ি পাওয়া যায়, তেমন ছিল না সেটা মোটেও। অপেক্ষাকৃত কম মিষ্টি কিন্তু অনেক বেশি সুস্বাদু ছিল! হাতে দেওয়ার আগে ফেরিওয়ালা চাচা যখন কাগজের ঠোঙাটা খুলত, শন পাপড়ির গুড়ো ওটার ভেতর ধোঁয়ার মত ভেসে বেড়াতো। কি অপূর্ব সুন্দরই না লাগত সেটা দেখতে!
আরেক প্রকারের মিষ্টি জাতীয় খাবার ফেরিওয়ালারা বিক্রি করত যেটা কিনা তারা একটা তৈলাক্ত লাঠির আগায় মণ্ড আকারে লাগিয়ে, কাপড়ে ঢেকে ফেরি করত। খাবারটি লাল-সাদা চুইংগামের মত ছিল দেখতে কিন্তু মুখে চুইংগামের মত দীর্ঘস্থায়ী হত না। গলে যেত দ্রুত।
ক্ষণস্থায়ী হওয়ার কারণেই হয়তো এর স্বাদের আবেদনটি অনেক বেশি জোরালো ছিল। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি ছিল সেটি হল, এটা বিক্রি হত কে কিরূপে খাবারটি চাচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে। যেমন এটা পাওয়া যেত ফুল, আংটি, ঘড়ি, ছাতা, পাখি, বাঁশি ছাড়াও বিভিন্ন বস্তুর আকারে। এবং এভাবেই এর দাম নির্ধারিত হত। যেমন ফুল হলে দাম কম, পাখি হলে দাম বেশি, এইভাবে।
ফুল চাই না পাখি চাই, মুখ ফুটে বললেই ফেরিওয়ালা চাচা চোখের পলকে লাঠি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক তাল মিষ্টিকে অদ্ভুত দক্ষতায় ফুল, পাখি ইত্যাদি বানিয়ে ফেলতে পারতেন। বাচ্চাদের কবজিতে ঘড়ি, আঙ্গুলে আংটি তৈরি করে পড়িয়ে দিতেন। ঐভাবে হাতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই বাচ্চারা আঠালো মিষ্টি দিয়ে তৈরি ঘড়ি কিংবা আংটি চেটেপুটে খেয়ে ফেলত। কোনও কোনও ফেরিওয়ালা হাতে বানানো এক প্রকারের মিষ্টি পাঁপড় বায়ুনিরোধক বাক্সে ভরে বিক্রি করত বাচ্চাদের কাছে। পাঁপড় বলতে আমরা সাধারণত যেটাকে বুঝি, ওটার ধরন ঠিক তেমন ছিল না।
কমলা রঙের চ্যাপ্টা রুটির মত ছিল সেটা দেখতে। খেতে মচমচে নয়, আবার ওদানোও নয়। এ দুটোর ঠিক মাঝামাঝি একটা অবস্থা! হয়ত অবস্থানটির নামকরণ করতে বলা হলে আমি বলব “অসাধারণ” একটা অবস্থা! এই পাঁপড়ও বিক্রি হত পুরনো হাবিজাবি জিনিসপত্রের বিনিময়ে। তবে টাকা দিয়েও কেনা যেত। ওভেনের মত দেখতে টিনের একটা বাক্সে ভরে হালকা গোলাপি রঙের এক প্রকার মিষ্টি বিক্রি করত ফেরিওয়ালারা; যেটাকে বলে কিনা হাওয়াই মিঠাই।
বাংলাদেশে এই খাবারটি চিনে না এমন কেউ আছে কি? মুখে দিলে হাওয়া হয়ে না গেলেও গলে এত বড় মিষ্টিটা এতটুকু হয়ে যেত! আইসক্রিম ওয়ালারা ঠেলায় করে বিশালাকারের মাটির পাতিলের মত দেখতে বরফে পূর্ণ একটা ড্রাম ভরে অপূর্ব স্বাদের একপ্রকারের আইসক্রিম বিক্রি করত যেটা রাবারের ছাঁচের ভেতর ঢোকানো অবস্থায় থাকত। কেনার সময় ছাঁচ খুলে বরফের পিণ্ডটার ভেতরে একটা কঞ্চি ঢুকিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত বাচ্চাদের। ওটাই আইসক্রিম! এটা অবশ্য পহেলা বৈশাখের দিন এখনো কিছু কিছু মেলায় চোখে পড়ে। তবে সেটাকে ঘিরে থাকা খরিদ্দারদের আকার বড় হয়ে গেছে।
আজকাল, বাচ্চাদের ব্যস্ত মা-বাবারা বাইরের অসুস্থ রকম ব্যস্ত পরিবেশে শিশুদের একা ছাড়ার সাহসই পান না।
স্কুলকেও অনুমতি দেন না। কে দেবে নিরাপত্তা? ফলে বাইরে একা স্বাধীন ঘুরে বেড়ানো হয় না বাচ্চাদের। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই পথেঘাটে বাচ্চাদের আনাগোনার অভাবে তাদের ঘিরে গড়ে উঠা চমৎকার একটা প্রতিবেশ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে হাওয়াই মিঠাই, কটকটি, টিনের বাক্সের শন-পাপড়ি, পাঁপড়; হারিয়ে গেছে ফেরিওয়ালারাও। অবশ্য ফেরিওয়ালাদের অনেকে না হারিয়ে গিয়ে শিশুদের পরিবর্তে খরিদ্দার হিসেবে বেছে নিয়েছে বড়দেরকে। আজও আইসক্রিম, এটা ওটা ফেরি করে বিক্রি হয়।
কিন্তু ছোটদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খায় বড়রা। তাই সব হারিয়ে গেছে আসলে শিশুদেরই। কিন্তু তারাতো শিশু! নিজেদের অধিকারের কথা জানা নেই তাদের। তাই তাদের এখনকার যে জীবন তার চেয়ে যে অনেক বেশি সুখী, সুন্দর, স্বাধীন একটি জীবন তাদের প্রাপ্য ছিল সেটা তারা সেই জীবন হারিয়ে ফেলার আগে টের পায় না।
http://www.notun-din.com/?p=6359
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।