দেশকে ভালবাসা
উপনির্বাচন ও একটি কাঙ্ক্ষিত পরাজয়!
খেলায় জয়-পরাজয় আছে। জয়-পরাজয় আছে যুদ্ধেও। এমনকি ছোটদের যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, সেখানেও আছে জয়-পরাজয়। এক দল জিতবে, অন্য দল হারবে_এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এই যে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল টি-২০ বিশ্বকাপ খেলতে গেল, তারাও অন্তত দুটি ম্যাচে জয়ের স্বপ্ন দেখছে।
জয়ের স্বপ্ন সবাই দেখে। পরাজয় সবার কাছেই দুঃস্বপ্ন। কিন্তু তার পরও সবাই জয়ী হতে পারে না। ভোট কিন্তু খেলা নয়, যুদ্ধ। কাজেই ভোটযুদ্ধে সবাই জয় চায়।
কিন্তু জয় পায় একজন। ভোলা উপনির্বাচন নিয়ে যে দোলাচল ছিল, তার অবসান হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনকে জয়ী ঘোষণা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পরাজিত হয়েছেন বিএনপির অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মদ।
ভোলা উপনির্বাচন যদি একটা খেলা হয়, সে খেলায় হেরে গেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন।
হেরে গেছে তাঁর দল বিএনপি। খেলা তো আমরা সবাই উপভোগ করি। আমরা খেলার মাঠে খেলা দেখতে যাই। খেলা দেখি টেলিভিশনের পর্দায়। মাত্র শেষ হওয়া আইপিএল দেখলাম আমরা।
প্রিয় খেলোয়াড়ের আউট হওয়ায় আহা-উহু করেছি। প্রিয় খেলোয়াড় ছক্কা হাঁকালে টেলিভিশনের সামনে বসেই হাততালি দিয়েছি। ফুটবলে-হকিতে খেলোয়াড়দের হাত ও পায়ের কেরামতি দেখেছি, দেখছি। ঢাকার মাঠে কাজী সালাহউদ্দিনের খেলা এখনো অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। খেলোয়াড়রা খেলা দেখান।
কিন্তু 'খেল দেখানো?' খেল দেখানো লোকেরও অভাব নেই আমাদের চারপাশে। চলতে-ফিরতে আমরা কত রকমের 'খেল' যে দেখছি! 'খেল দেখা' আর খেলা দেখা এক নয়। কেউ খেল দেখতে যায়, কেউ যায় খেলা দেখতে। ভোলা উপনির্বাচনের খেলা শেষ হয়েছে, খেল শুরু হয়েছে।
কত রকমের খেলা আছে।
কত রকমের খেলা হারিয়ে গেছে। একসময় ষাঁড়ের লড়াই হতো। কলকাতায় হতো বুলবুলির লড়াই। এখনো পুরান ঢাকায় পায়রায় লড়াই হয়। দূরে কোথাও নিয়ে কবুতর ছেড়ে দেওয়া হয়।
যে কবুতর আগে উড়ে আসতে পারে, সেই কবুতর চ্যাম্পিয়ন হয়। ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা এখনো পুরান ঢাকায় দেখা যায়। আগে তো আরো বর্ণাঢ্য ছিল এই ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা। এখন 'সে দিন হয়েছে বাসি'।
পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে সবাই জেনেছেন, ভোলার উপনির্বাচনে হাফিজউদ্দিন পরাজিত হয়েছেন।
জয়ী হয়েছেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। আপাতদৃষ্টিতে এই জয় শাওনের বা আওয়ামী লীগের হলেও বিএনপি জয়ী হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেন? রহস্যটা এখানেই। এই রহস্যের একটি গল্প আগে বলে নেওয়া যাক।
পাড়ার মাঠে রোজ খেলা হয়।
অনেক দর্শক। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই বিকেলে মাঠে আসেন, খেলা উপভোগ করেন। পাড়ার ওই খেলার মাঠে সেরা খেলোয়াড় গোবর্ধন। সে খুব ভালো খেলোয়াড়। পায়ে বল পেলে একছুটে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে।
সবাই তাকে বাহবা দেয়। এই গোবর্ধন একদিন খেলতে খেলতে দেখতে পেল, মাঠের সামনের বাড়ির একটি মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে তার খেলা। রোজ মেয়েটি জানালায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। আর গোবর্ধন মেয়েটিকে দেখে। দেখে আর অন্যমনস্ক হয়।
খেলার মান নেমে যায়। ফাঁকা পোস্ট পেয়েও বাইরে বল মেরে দেয়। ভুল পাস দেয়। বল পায়ে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটতে ভুলে যায়। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।
সেন্টার ফরোয়ার্ড গোবর্ধন পজিশন বদল করে। সেন্টার ফরোয়ার্ড থেকে নেমে আসে ডিফেন্সে। এখানে এলে অন্তত কিছুটা সময় পাওয়া যায়। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকা যায়। গোবর্ধনের পজিশন চেঞ্জ করার রহস্য সবার অজানা থেকে যায়।
যেমন অজানা রয়ে গেছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিনের পরাজয় রহস্য। সংস্কৃতে একটা কথা আছে, 'যাদৃশি ভাবনার্যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশি'। বাংলা তরজমা_'যার যেমন ভাবনা তার তেমন সিদ্ধি বা সাফল্য। ' অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিনের পরাজয়ে বিএনপির ভাবনা সিদ্ধিলাভ করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। পরাজিত হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মদ।
কিন্তু জয়ী হয়েছে তাঁর দল। একটি পরাজয় বড় প্রয়োজন ছিল বিএনপির। সেই কাঙ্ক্ষিত পরাজয়টি দলকে উপহার দিতে পেরেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মদ। ভোটের খেলা শেষ হয়েও তাই একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। খেলা যেখানে শেষ, সেখান থেকেই হয়তো শুরু হবে নতুন খেল।
না, সে আমলের 'মাদারির খেল' নয়। রাজনীতির 'খেল'। ভোলা উপনির্বাচনের দোলাচল পেরিয়ে প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন পরাজিত হলেও নতুন একটি খেলার জন্য এই পরাজয়টিই কাঙ্ক্ষিত ছিল বিএনপির। কাঙ্ক্ষিত সেই ফল, অর্থাৎ পরাজয় পেয়েছে বিএনপি। দলের নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের কথা থেকে সেটাই স্পষ্ট হয়।
তিনি বলেছেন, 'এই নির্বাচনে আসলে বিএনপি জিতেছে। ভবিষ্যতের আন্দোলন-সংগ্রামকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে এই নির্বাচন। ' সেই আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিএনপি 'সরকার নয়, ইসির বিরুদ্ধে আন্দোলন' ঘোষণাও করেছে।
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করেছিলেন মেজর হাফিজ। '৯১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
এরপর যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০১ সালেও বিএনপির হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। রাজনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অনেকের মতো রাজনীতিতে তিনি নবিশ নন। কাজেই তিনি নিজেও জানেন, এই পরাজয় চেয়েছিল তাঁর দল।
তিনি দলের সেই চাওয়া পূরণ করতে পেরেছেন। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো অবস্থা হলেও তিনি সেটা সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছেন, করেছেন। ১/১১-র পর অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিনের গায়েও সংস্কারপন্থীর তকমা লেগেছিল। সেই তকমা মুছে ফেলতে একটা বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার প্রয়োজন ছিল তাঁর। ভোলা উপনির্বাচন সংস্কারের কুসংস্কার থেকে অন্তত রক্ষা করতে পারবে।
ভোলা উপনির্বাচনে অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিনের পরাজয়ের অনেক কারণ আছে। তাঁর নিজের দলের মধ্যেই কোনো সমন্বয় ছিল না। বিএনপির রানিং মেট জামায়াত বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কোনো কাজ করেনি। হাত গুটিয়ে বসে ছিল। লালমোহন উপজেলা জামায়াতের আমির সংবাদ মাধ্যমকে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, তাঁরা এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামছেন না।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহম্মদ জামায়াতের সমর্থন চাননি, তা নয়। কিন্তু জামায়াত কথা দিয়েও নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির পাশে থাকেনি। সবাই জানেন যে সব এলাকায়ই জামায়াতের কিছু না কিছু রিজার্ভ ভোট আছে। ভোলা-৩ আসনেও রিজার্ভ ভোট আছে জামায়াতের। জামায়াত নিশ্চুপ থাকলে সেই রিজার্ভ ভোট ভোটের বাক্সে পড়বে না, এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপি এই নির্বাচনের হেরে যাবে, এটা বোধ হয় নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছিল তারা। বুঝতে না পারার কোনো কারণও ছিল না। বুঝতে পেরেছিল বলেই নিজেদের বিরত রেখেছিল নির্বাচনী প্রচার থেকে। সংস্কৃতে একটি কথা আছে, 'নির্বাণদীপে কিমু নিবেদনম?' অর্থাৎ নির্বাপিত বাতিতে তেল দিয়ে লাভ কি? হিসেবটা ভালোভাবেই করেছে জামায়াত। নিজেদের সরিয়ে রেখেছে নিরাপদ দূরত্বে।
শুধু যে জামায়াতের কারণেই বিএনপি হেরে গেছে এমনটিও মনে করার কোনো কারণ নেই। জামায়াত বিএনপিকে কোনো সহযোগিতা করেনি_এটা ভোটযুদ্ধে বিএনপির পরাজয়ের অন্যতম কারণ। আবার ঘরের শত্রু বিভীষণও কি ছিল না? ছিল। বিএনপির স্থানীয় এক শীর্ষ নেতা তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে, হাফিজউদ্দিন আহম্মদের পতন কে ঠেকায়, তা তিনি দেখে নেবেন। এ ছাড়া আছে জোট আমলের নির্যাতনের স্মৃতি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিগত জোট সরকারের আমলে ওই এলাকার লোকদের ওপর যে হারে নির্যাতন হয়েছে, তা ওই এলাকার কেউ ভুলে যাননি। সেই সময়ের নির্যাতনের জবাব এলাকার মানুষ ব্যালটের মাধ্যমেই দিয়েছেন। ব্যালটের ভেতর দিয়ে এমন একটি জবাব আসবে_সেটা যে বিএনপির জানা ছিল না, তা নয়। জানা ছিল। কিন্তু তার পরও নির্বাচনে গেছে বিএনপি।
কারণ, বিএনপির একটি পরাজয় দরকার ছিল। 'লাভের আশায় অনেকের যোগফল লোকসান' হয়। বিএনপিরও সে রকম হয়েছে। একটি ইস্যুর জন্য বিএনপির এমন একটি পরাজয় বড় প্রয়োজন ছিল। ভোলা-৩ উপনির্বাচন বিএনপির হাতে সেই সুযোগটি এনে দিয়েছে।
ভোটের তিন দিন আগে যে হাফিজউদ্দিন আহম্মদ ভোটের দিন পিছিয়ে দেওয়ার বায়না ধরেছিলেন, তিনিই আবার পরদিন সে অবস্থান থেকে ইউ টার্ন করেন। এ থেকেই অনুধাবন করা যায়, দলের ইঙ্গিতটা তিনি ততক্ষণে পেয়ে গেছেন। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই নিজেকে বলি করেছেন। তবু কাঙ্ক্ষিত পরাজয় পেয়েছে বিএনপি। এই কাঙ্ক্ষিত পরাজয় কতটা কাজে লাগাতে পারে, তার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।