আমরা করবো জয়, নিশ্চয়!
আমরা দুই ভাই। ছোটভাই আর আমার বয়সের পার্থক্য খুব কম। আমরা প্রায় সব কিছুই একসাথে করতাম। স্কুলে যাওয়া, টিভিতে কার্টুন দেখা, দুপুরে হুজুরের কাছে আরবী শেখা, বিকালে খেলতে যাওয়া, রাতে পড়তে বসা, ঘুমানো সব কিছুই। আর সব কিছুতে মা সারাক্ষন আমাদের দেখে রাখতো।
স্কুলে নিয়ে যেতেন মা, আনতেন মা। বিকালে খেলতে গেলে সুন্দর জামা কাপড়, জুতা পরিয়ে তৈরী করে দিতেন মা, পুরো বিকেল বারান্দায় বসে আমাদের দেখে রাখতেন মা। রাতে আমাদের পড়াতেন মা, ভাত খাইয়ে দিতেন মা, ঘুমাতে গেলে দুইভাইকে গল্প শুনাতেন মা।
ছোটবেলায় বাসায় এক মৌলভি আমাকে আর আমার ছোটভাইকে পড়াতেন। তিনি অনেক ভাল ভাল উপদেশ দিতেন।
শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই নয়, অনেক সামাজিক/নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কেও তিনি বলতেন। কৃতজ্ঞ বোধ করি উনার কাছে।
এক দুপুরে হুজুর পড়াচ্ছেন। আমাদের বেহেস্তের গল্প বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, বেহেস্তে আমরা সবাই অনেক ভাল থাকবো।
সবাই সব কিছু পাবো। যা ইচ্ছা হবে তাই পাবো। সব, সব কিছু। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি না যেতে পারি, তাহলে কি আমার সাথে আমার ভাইয়ের দেখা হবে কিনা। হুজুর আমাকে বললেন, পরিবারের একজন গেলেই সে বাকীদের নিয়ে যেতে পারবে।
শুনে খুশি হয়েছিলাম। এরপর জানতে চাইলাম, তাহলে আমার সাথে আমার বাবা মা সবার সাথে দেখা হবে কিনা। হুজুর বললেন, বেহেস্তে যাবার পর কেউ কাউকে চিনতে পারবেনা। সেখানে সবাই চির তরুন থাকবে। আমি আমার ছেলে মেয়েকে চিনবোনা, আমার মাকেও চিনবোনা, আমার মাও আমাকে চিনবেন না।
হুজুরের সামনে অবাক হয়ে বসে সব শুনলাম।
হুজুর চলে গেলেন, পড়ানো শেষ করে। পড়া শেষ হলে মায়ের আদেশে দুই ভাই ঘুমাতে গেলাম।
দুইভাই বিছানায় শুয়ে গল্প করছিলাম। একসময় আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বেহেস্তে যাবা? “
ও বললো, “ হ্যা যাবো।
”
আমি বললাম ,” তাহলে তো আম্মুকে চিনবানা, আম্মুকে ছাড়া থাকতে হবে। ”
এত্ত কঠিন কথা ওর সহ্য হলোনা, ও কাঁদতে শুরু করলো।
কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললো, “ আমি মরবোনা ভাইয়া। বেহেস্তে যাবোনা। তুমি পারবা থাকতে আম্মুকে ছাড়া?”
মাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে, এইটা ভেবে আমারো বুকের মধ্যে বিশাল চাপ পড়লো।
ভয়ে কান্না পেয়ে গেলো।
আমি বললাম,”আমিও মরবোনা, পৃথিবীতেই থাকবো। ”
দুইভাই শুয়ে শুয়ে উপুর হয়ে কাঁদছি, এমন সময়ে মা এলেন ডাকতে বাইরে খেলতে যাবার জন্যে। দুইভাইকে টেনে তুলে দেখেন, দুইজনের চোখে পানি ভর্তি। বালিশ ভিজে গেছে।
তাড়াতাড়ি দুইজনকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? কেউ বকেছে কিনা?
আমার ছোটভাই ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো, “বেহেস্তে গেলে আমাদেরকে চিনবানা না, আম্মু?”
এইটা শুনে মার চোখেও পানি চলে এসেছে। মা কিছু না বুঝে দুইজনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি যেখানে যাবো সেইখানে আমার ছেলেমেয়েরা থাকবে। ”
আমি বললাম, “তাহলে হুজুর বললো যে?”
মা কঠিন স্বরে বললেন, “আমি আমার ছেলেমেয়ের সাথে থাকবো। হুজুর কি জানে?”
মনে আছে, সেদিন দুইভাই আর বাইরে খেলতে যাইনি।
মায়ের সাথে বারান্দায় বসে ছিলাম।
এখনো জানিনা, বেহেস্তে গেলে মাকে পাবো কিনা।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, মাকে ছাড়া যাতে থাকতে না হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।