সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইনের বিরুদ্ধে ১৩টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে তাঁকেই চিঠি দিয়েছেন কমিশনের একজন সদস্য। চিঠিতে পিএসসির অচলাবস্থার জন্য চেয়ারম্যানকে দায়ী করে বলা হয়, ‘আপনার একনায়কসুলভ আচরণ ও কর্মপদ্ধতি পুরো সরকারি কর্মকমিশনকে (পিএসসি) গ্রাস করে ফেলেছে। আপনার কারণে কোনো ব্যাপারেই এখন কমিশনের সদস্যদের কোনো ভূমিকা নেই। ’
পিএসসির আরও কয়েকজন সদস্য একই রকম চিঠি দিয়েছেন চেয়ারম্যানকে। সব কটি চিঠিতে পিএসসির অচলাবস্থার জন্য চেয়ারম্যানকে দায়ী করা হয়।
‘বাংলাদেশ কর্মকমিশনে স্থবিরতা’ শিরোনামে পিএসসি চেয়ারম্যানকে লেখা কমিশনের সদস্য এ টি আহমেদুল হক চৌধুরীর ওই চিঠির অনুলিপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পিএসসির প্রধান কাজ রাষ্ট্রের জন্য যোগ্য কর্মকর্তা নির্বাচন করা। কিন্তু পিএসসির বর্তমান অবস্থায় সেই কাজটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে প্রজাতন্ত্রের চাকরিপ্রার্থী নির্বাচন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
নন-ক্যাডার পরীক্ষাতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
চিঠিতে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলা হয়, ‘...আপনার দ্বিমুখী নীতির কারণে শত শত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার চাকরি ও সামাজিক জীবন তছনছ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পিএসসিতে আপনার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই সাংবিধানিক পদটির মর্যাদা রক্ষার্থে আপনি নিজেই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করছি। ’
অভিযোগের ব্যাপারে সা’দত হুসাইনের বক্তব্য জানার জন্য গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তাঁর কার্যালয়ে ফোন করলে জানানো হয়, তিনি বৈঠকে আছেন।
আধা ঘণ্টা পর ফোন করতে হবে। আধা ঘণ্টা পর ফোন করলে জানানো হয়, তিনি দুপুরের খাবার খেতে বাসায় গেছেন। বিকেলে চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব মনজুর হোসেনের মাধ্যমে আবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান কথা বলেননি। সর্বশেষ বিকেল পাঁচটায় ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শেখ শরীফুল ইসলামকে ফোন করলে তিনি চেয়ারম্যান স্যারকে দিচ্ছি বলে সংযোগ দেন।
এই প্রতিবেদককে চার মিনিট টেলিফোন লাইনে রাখেন তিনি। একপর্যায়ে এ প্রান্ত থেকে শোনা যায়, তিনি ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বলছেন, ‘ওকে বলে দাও আজ (গতকাল) কথা বলব না। কাল (আজ) আমার অফিসে আসতে বলো। ’ এরপর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফোন ধরে প্রতিবেদককে একই পরামর্শ দেন। বিষয়টি জরুরি জানিয়ে গতকালই কথা বলতে তাঁর মোবাইলে সংক্ষিপ্ত বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়।
কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এর আগেও পিএসসি-সংক্রান্ত একাধিক সংবাদের জন্য বক্তব্য জানতে সা’দত হুসাইনের সঙ্গে যোগযোগ করা হয়েছে। কোনোবারই তিনি কথা বলেননি। তবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেই তিনি পরে জনসংযোগ দপ্তরের মাধ্যমে বিশাল প্রতিবাদপত্র পাঠান।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন চালাতে গেলে সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকতে হবে।
আর পিএসসির মতো একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে তো গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো বিকল্পই নেই। এখানে যেকোনো বিষয়ে সব সদস্যের সঙ্গে কথা বলে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তা না করে একক ক্ষমতায় সিদ্ধান্ত নিলে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সাবেক এই চেয়ারম্যানের দাবি, সব সদস্যের সহযোগিতার কারণে তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ১৮ থেকে ২৩তম মোট ছয়টি বিসিএস পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পেরেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নানা অভিযোগের কারণে সরকার চাইছে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করুক।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে চায়ের দাওয়াতও দিয়েছেন। তবে চেয়ারম্যান তাঁর পদে বহাল আছেন। জানা গেছে, সম্প্রতি তাঁর বাসার নিরাপত্তা শিথিল করা হয়েছে।
চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১৩ অভিযোগ: কমিশনের সব কর্মকাণ্ড ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে নির্দেশিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয় না, শেষও হয় না।
কমিশনের প্রতিটি সভায় আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্ত শুধু চেয়ারম্যানের ইচ্ছাতেই হয়। সদস্যরা শুধু উপস্থিত থাকেন। প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এককভাবে লিখিত ও মৌখিক আদেশ জারি করে পুরো প্রক্রিয়া জটিল করে তুলেছেন চেয়ারম্যান।
কমিশনের সদস্যের চিঠিতে বলা হয়, চেয়ারম্যানের একনায়কসুলভ আচরণ চলতে থাকলে কমিশন জনস্বার্থে কাজ করতে পারবে না। যেমন—চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় ২৭তম বিসিএস নিয়ে কর্মকমিশন মামলায় লিপ্ত হয়েছে।
প্রার্থী নির্বাচন কিংবা সাচিবিক কাজ কোথাও চেয়ারম্যান ছাড়া কমিশনের অন্য কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। ফলে চাকরির প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নকর্তা, সমন্বয়কারী, পরীক্ষক-নিরীক্ষক প্রভৃতি দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ছাড়া কারও ভূমিকা নেই। এমনকি পরীক্ষার হলের পরিদর্শক নিয়োগও হয় তাঁর একক কর্তৃত্বে।
পিএসসির একটি ইউনিটের উদাহরণ দিয়ে ওই সদস্য বলেছেন, খাদ্য, যোগাযোগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এই কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ১৮ শ্রেণীর ২৬০টি শূন্য পদের বিপরীতে এ পর্যন্ত মাত্র ২৯টি পদে প্রার্থী বাছাই করা সম্ভব হয়েছে।
চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে নন-ক্যাডার পদে তিন ঘণ্টায় ২০০ নম্বরের পরীক্ষা চালু করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পিএসসির ১২টি ইউনিটের সবগুলোতেই একই অবস্থা চলছে।
আলোচনা ছাড়াই একজনকে ৩০তম বিসিএসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে সদস্যদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি ও বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কমিশনের সদস্য সৈয়দ হাসিনুর রহমান, ইকরাম আহমেদ, ফরিদা আদিব খানম ও মুহাম্মদ লিয়াকত আলী খানকে কোনো দায়িত্ব না দিয়ে বিভিন্নভাবে অপদস্থ করে তাঁদের কর্মহীন করে রেখেছেন চেয়ারম্যান।
এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
চিঠিতে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলা হয়, ‘আপনি নিজেকে নিরপেক্ষ বলে প্রচার করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে আপনি তা নন। ... আপনার দ্বিমুখী নীতির কারণে শত শত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি ও সামাজিক জীবন তছনছ হয়ে গেছে। ’
পিএসসির দুজন সদস্য গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই, পিএসসির অচলাবস্থা কাটুক। চাকরিপ্রার্থীরা হতাশ না হোক।
সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পাওয়া কেউ অপমানিত না হোক। তাই এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।