আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুজিব বাহিনী-রক্ষীবাহিনী : বাঙালির বিচ্ছিন্নতার প্রথম ধাপ

মুক্তস্বর

লোকে বলে, গরীবের লোভটা একটু বেশি থাকে। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশের রাজনীতিটা দেশকেন্দ্রীক না বলে বরং দলকেন্দ্রীক হয়ে ওঠে। দেশ কী পাবে বা পাচ্ছে- সেটার চেয়ে দল কী পাবে বা পাচ্ছে- সেটাই প্রধান হয়ে ওঠে আমাদের রাজনীতিকদের কাছে। ফলে ঐক্যের বদলে তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যবধান ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে।

এটা আজকে যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেখা গেছে। স্বাধীন দেশের জন্য সম্মিলিতভাবে আমরা সংগ্রাম করতে পারি নি। প্রথম থেকেই আমরা প্রশাসনের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলাম। এর সূত্রপাত হয় মুজিব বাহিনী ও রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদয়ে নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন সৈয়দ আলী আহসান।

তিনি লিখেছেন, দেশের ভিতরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা এবং বিভেদ ছিল, বিদেশেও সে বিভেদ বিদ্যমান ছিল। সেভাবেই মুক্তিযুদ্ধের কর্মপন্থা গড়ে তুলেছিল। এই বিভাজনটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। দলগতভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মুক্তিযোদ্ধা গড়ে তুলতে তৎপর ছিলেন এবং এক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই বিছিন্নতাকে সমর্থন জানিয়েছিল। যেমন আমাদের মুক্তিবাহিনী ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সমন্বয়ে গঠিত।

এর মধ্যে এসে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশের শত শত তরুণ ছাত্রদল। এটাই ছিল আমাদের যথার্থ মুক্তিবাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারত সরকার মুজিব বাহিনী বলে একটি ভিন্ন বাহিনী গঠনে সহায়তা করে। এভাবে একটি সংঘষের সূত্রপাত হয়। যারা ভারতের সাহায্য নিয়ে মুজিব বাহিনী গড়ে তুলতে তৎপর হয়েছিল, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তি বাহিনী বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা।

তাদের বক্তব্য ছিল যে, মুক্তিবাহিনী মূলত সেনাবাহিনী সদস্যদের নিয়ে গঠিত সুতরাং দেশ স্বাধীন হলে সৈনিকরাই এদেশের অধিকার নিয়ে নেবে। পূর্বাহ্নেই এই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়ার জন্য মুজিব বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা তাদের মনে দেখা দেয়। আমার জন্য এ ঘটনা ছিল অত্যন্ত বেদনার এবং দুঃখের। ভারত কি চেয়েছিল জানিনা। কিন্তু মনে হয় তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে সবসময়ের জন্য বিচলিত রাখা যেন চিরকাল বাংলাদেশ তার দ্বারস্থ থাকে।

ভারতের সাহায্য নিয়ে এবং নির্দেশ নিয়ে বাংলাদেশ চিরকাল পরিচালিত হবে সম্ভবত এটাই ছিল ভারতের ইচ্ছা। ভারতের পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরাও নিজেদের সততা সে সময় প্রমাণ করতে পারিনি এবং ভারতের বিভাজন নীতিকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড গঠন করার অনুমতি দিয়ে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানিয়ে।

তৃতীয়ত, ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুর্ণ মানসিকতায় একত্রিত হতে পারেনি। ( যখন সময় এলো : সৈয়দ আল আহসান) 'বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব বাহিনী ভেঙে দেয়া হয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর বিপরীতে একটি রক্ষী বাহিনী গড়ে ওঠে। রক্ষী বাহিনী গড়ে উঠতে ভারত সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিল। রক্ষীবাহিনীর পূর্ণ প্রশিক্ষণও দিয়েছে ভারত। আমার মনে আছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমে রক্ষীবাহিনীর একটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে ওঠে।

প্রশিক্ষন যারা দিতেন তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এদের ক্যাম্প সংযুক্ত থাকায় অনেক ব্যাপারে রক্ষীবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রধান নির্ভরতা ছিল পানির। আমাদের পানির ট্যাঙ্কটি রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের কাছে ছিল। প্রতিদিন সকাল এবং বিকেলে কিছুটা সময় এই পানি ব্যবহারে অনুমতি তাদের দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও হঠাৎ একদিন গোলমাল লাগে, কিছুটা মারপিটও হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমি গোলমাল মিটমাটের চেস্টা করি এবং প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দু'জন অধিনায়ককে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলি। যে দু'জন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো তারা দু'জনই ভারতীয়-একজনের বাড়ি কুর্গ এবং অন্যজনের বাড়ি লক্ষ্ণৌতে। এদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বুঝতে পারলাম যে, রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছে ভারতের সাহায্যে। এবং তাদের উপযুক্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে ভারত সরকার।

(প্রগুক্ত) এ সময় মওলানা ভাসানী 'হক কথা' বলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকায় রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা ছাপা হতো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.