...একজন সাদা-মাটা, ছোট-খাটো লোক।
মেঘ কেটে বেরিয়ে আসা সূর্যের লালচে আলো দেখে পাখির ছানা পোনারা যখন দোনো মোনো করছে ডাকবে কি ডাকবে, ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে রমনার সকাল। চারদিক থেকে বয়ে চলা হাল্কা বাতাস গায়ে লাগতেই গাছ গুলো সরব হচ্ছে। একজন আরেকজনের গা ঘষটে ঘষটে সর - সর আওয়াজ তুলছে নারকেলের চিরল বিরল পাতা। চক্রা বক্রা রং মাখানো ফড়িং দোল খেতে ব্যাস্ত গাছের ডালেই।
ঠিক যেমন ছোট বাচ্চারা দোল খায় রমনার দেলনায়। আসলে প্রত্যেকটাদিন রমনার সকাল কাটে ভয়ানক ব্যাস্ততায়। সূর্য ওঠার সাথে সাথে পায়ে কেডস কিংবা ক্যাম্বিসেরi জুতো চাপিয়ে হাটতে আসেন মাঝ বয়সী বুড়ো বুড়িরা। ঘাম মোছবার জন্য ঘাড়ে ঝুলতে থাকে লাল - নীল তোয়ালে। কারো কারো হাতে বোতল ভরা খাবার পানি।
সাস্থ্য রক্ষার হাটা দিতে আসেন তারা। আর কটা দিন বেশী বাঁচবার চেষ্টা আরকি। হাটনেওয়ালাদের ভেতর যারা একটু নিয়মিত, তারা হয় অন্যদের নিয়ে একটা দল গড়ে ফেলেন। কিংবা নিজেরাই ভিড়ে যান কোন একটা দলে। বাঙালীর ‘সংগঠন প্রিয়’ টাইটেল অক্ষুন্ন রাখতে এখানে বেশ কয়েকটা হাটাহাটির সংগঠনও আছে।
সদল বলে তারা যখন হাটতে শুরু করেন দুর থেকে দেখলে একটু ভয়ই লাগে। হাটতে হাটতেই চলতে থাকে আলোচনা। উস্তের দরদাম থেকে শুরু করে প্যালেষ্টাইন সংকট কোন কিছুই বাদ পড়ে না। মাঝে মধ্যে এক আধটু কথা কাটাকাটি কিংবা মনমালিন্য যে হয় না তা নয়। তবে সেটা মিটেও যায়।
পরদিন সকালে আবার সেই দলে বলে হাটা হাটি। শেষ বয়সের বন্ধু বলে কথা, এতো অল্পতে কি আর আড়ি নেয়া যায়। মহিলাদের বেশীর ভাগ অবশ্য ¯স্বামীকেvgx‡K সাথে করে হাটতে আসেন। হাটা হাটির ফাকে ফাকে ঘর সংসারের আলাপটাও সেরে নেন। হাটতে হাটতেই কথা হয় রমনার হাটনে ওয়ালাদের একজনের সাথে।
তার নাম আমিনুর রহমান। বিশাল ঢাকা শহরে এতো জায়গা ফেলে এখানে কেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন - ‘ ঢাকা শহরে আর সুন্দর জায়গা কই যে যাবো। রমনাপার্ক আছে বলেই কিছুটা সবুজ দেখতে পাই। এটাও কতদিন থাকবে কে জানে। একবারতো শুনলাম সরকার কি একটা বানাবার অসিলায় গাছ টাছ কেটে ফেলবে।
আপনারা পত্রিকাওয়ালারা শক্ত করে কিছু বলেন না কেন? ঢাকা শহরটা এখনও সুন্দর আছেতো এই গাছগুলোর জন্যই নাকি। ’
পার্কে ঢোকার মুখে পার্ক কর্র্র্তৃপক্ষের দশ বারোটা আদেশ উপদেশ লেখা একটা আধা জং ধরা টিনের নোটিশ বোর্ড টাঙানো আছে। সবাই এসব নিয়ম কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে নিয়মিত । এই যেমন পার্কে ফেরিওয়ালাদের প্রবেশ নিষেধ। অথচ পুরো পার্কে অসংখ্য ফেরিওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এদের কেউ চা বিক্রি করে কেউ পানি। কেউ আবার কফি ছাড়া অন্য কিছু বেচে না। কয়েকজন আছে কান চুলকে দেয় মাত্র দু টাকার বিনিময়ে। চাইলে দু একজন ঘামাচি গালানোর লোকও পাবেন। মাত্র পাঁচ টাকা দিলেই এরা ঝিনুক দিয়ে সারা পিঠের ঘামাচি গেলে দেয়।
আর বাদাম চানাচুর ওয়ালারাতো আছেই। শশা গাজর নিয়েও বেচা কেনা করতে আসে অনেকে।
আগে অবশ্য নানান জায়গা থেকে কলসি কাখে করে পানি বেচতে আসতো মেয়েরা। প্রতি গ্লাস একটাকা। ইদানিং বোতলের পানি আসায় ওদের ব্যাবসায় ভাটা পড়ে গেছে।
তবু দু একজনকে দেখা যায় কলসি কাখে করে পানি নিয়ে ঘুরতে। পানি বিক্রেতা আমিনার কাছে ব্যাবসা কেমন জানতে চাইলে তিনি বললেন- আমি হেই ছুডু কাল থেইক্যা পানি বেচি। পানি বেইচ্যা বেইচ্যা ঘর সংসার চালাইছি। অনে সবতে হুদা বোতল পানি খায়। বেচা কিনি আর আগের মতন হয় না।
নিষেধ হওয়ার পরও বেচা কেনা করেন কি করে? প্রশ্নটা শুনে লাজুক হাসলেন কফি বিক্রেতা আসলাম। উত্তর দিলেন - ইতা কেউ শুনে নি? হ্যারার কওনের কাম হ্যারা কয়,আমরার ব্যাচনের কাম আমরা বেচি।
ব্যাবসা কেমন চলছে জানতে চাইলে বাদাম বিক্রেতা মাইনুল জানালেন - আল্লাহর রহমতে ভালা হইতেছে। বাইরে সারাদিন বাদাম বিক্রি করলে ডেলি আশি নব্বই টাকা লাভ থাকে, খাটনিও বেশি হয়। আর পার্কের মইধ্যে বেচা কেনা যেমুন ভালা খাটনিও কম।
সকালে বাদাম আনলে হাঞ্জিলা লাগনের আগে বেচা শ্যাষ।
- এতো বাদাম খায় কে?
মাইনুল হেসে জবাব দিলেন- ক্যান পেরেম পার্টি। হ্যারাই বাদামের আসল কাষ্টমার।
হ্যা, কথা সত্য। সারা ঢাকা শহরের প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে সম্ভবত রমনার চেয়ে জনপ্রিয় কোন ডেটিং স্পট নেই।
যেখানে যাওয়া যায়, যেদিকে তাকানো যায় কেবলই জোড়ায় জোড়ায় বসা কপোত কপোতী। কাধে মাথা ঠেকিয়ে,কোলে মাথা রেখে তারা কুট কুট করে বাদাম চিবোয় আর গল্প করে। সামান্যতেই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ে। সকালের ‘ব্যায়াম পার্টি’ চলে যাবার পর একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত কম বেশি পুরোদিনটাই ‘পেরেম পার্টির’দের দখলে থাকে রমনা। পার্কের চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ আর শুন শান নির্জনতায় তাদের প্রেম যেন আরো, আরো গাঢ় হতে থাকে।
তবে উনারা যে শুধুই বেড়িয়ে আর দুটাকার বাদাম চিবিয়েই চলে যান সেটা ভাবাটা ঠিক হবে না। যাবার আগে নিদেনপক্ষে নিজেদের প্রেমের একটা স্মৃতি চিহ্ন রেখে যেতে হবে তো নাকি? হাজার হোক প্রেম বলে কথা। কাজটা অবশ্য তেমন কঠিন কিছু না। বাংলা কিংবা ইংরেজীতে নাম দুটো লিখে মাঝ খানে একটা যোগ চিহ্ন বসিয়ে দিলেই হল। পুরো নাম লিখতে না পারলেও সমস্যা নেই,নামের প্রথম অক্ষর লিখে চারপাশে একটা হার্ট একে দিলেও হয়ে যায়।
কিন্তু তাদের এই প্রেমের ঠেলায় রমনার একটা গাছেরও ছাল বাকল আস্ত নেই। চিত্র বিচিত্র সব লেখা জোখায় ভরপুর রমনার বৃক্ষরা। একজনতো আবার ভাবের অতিশয্যে বেঞ্চের গায়ে চক দিয়ে লিখেছে ‘রোজি তোমারে ভালাপাই- রাসেল ’। কাগজের দাম যে বাড়তি রমনার গাছগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়। দুঃখের বিষয় হল বহু চেষ্টা করেও এদের কারো সাথে কথা বলা যায় নি।
এরা কারো সাথে কথা বলেন না। কারন কি কে জানে।
এই দুই দল ছাড়াও রমনায় আরেক ধরনের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। হয় তাদের কোন কাজ নেই, নইলে যাবার কোন জায়গা নেই। পায়ের স্যান্ডেল মাথার নিচে দিয়ে পার্কের বেঞ্চে পড়ে পড়ে ঘুমানো ছাড়া ইনারা অন্য কিছু করেন না।
কেউ কেউ আবার খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে বসে থাকেন সারাদিন। এরকম একজনের সাথে কথা হয় পার্কের ভেতর। তার নাম মোঃ আকরাম আলী। বয়স ষাটের উপরে। সদ্য ঘুম ভাঙায় হাই তুলতে তুলতে বললেন- আগে চাকরি করতাম একটা ফার্মে।
মাস দুয়েক হইলো রিটায়ারমেন্টে গেছিগা। প্রথম এক সপ্তাহ ঘরেই ছিলাম ,দেখি ভালো লাগে না। বাইরে বাইরে থাইকা অভ্যাসতো। আর ঘরে থাকলে বউ সারাদিন ক্যাচর ম্যাচর করে। তাই সকালে নাস্তা কইরা বার হয়ে যাই।
সারাদিন পার্কের বেঞ্চ ঘুম পাড়ি। মাঝে সাঝে কাকরাইল মসজিদে গিয়া নামাজ পড়ি। এই আরকি।
স্কুল পলাতক কয়েকটা ছেলে পার্কের দোলনায় মহা আনন্দে দোল খাচ্ছিল। কয়েকজন আবার ঢিল মেরে জাম পাড়তে ব্যাস্ত।
তাদের মধ্য থেকে শিপলু জানালো , এখানে দল বেধে ঘুরতে আসার মজাই অন্যরকম। সারাদিন ঘোরা ঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে গেলেই হল। কেউ কিচ্ছু টের পায় না।
সন্ধ্যার পর রমনার চেহারাটা পাল্টে যায়। আস্তে আস্তে কমতে থাকে মানুষের আনা গোনা।
বাস্তুহারারা সপরিবারে হাজির হয় সারাদিনের কামাই নিয়ে। পলিথিনের ছাউনির নিচে রাত কাটনোর দারুন বন্দোবস্ত। তিনটে ইটের পরে পাতিল বসিয়ে রান্না চড়ায় গিন্নী। চুলো ঘিরে ওত পেতে থাকে আধা ন্যাংটো শিশুরা। আধবুড়ো বাপটা আঙুলে চেপে ধরা বিড়িতে একটা সুখ টান দেয়।
সবাই অপেক্ষায় থাকে কখন রান্না শেষ হবে। বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটা। রান্না শেষে তাকে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে তুলে দেয় মা। তারপর বড় রাস্তার নিয়ন আলোয় শুরু হয় ভোজ।
রাত নামলে এদিক সেদিক থেকে আসতে শুরু করে নিশি কন্যারা।
পরনে ইন্ডিয়ান শাড়ি, পায়ে চপ্পল। গালে ল্যাপ্টানো ¯স্বস্তা পাউডার তীব্র ঘ্রান ছড়ায়। ঠোটের উগ্র লাল লিপষ্টিক জ্বলজ্বল করে অন্ধকারেও। ফুটপাথ ধরে হাটার সময় হুট করে তাদেরই একজন পথ আগলে দাড়ায়।
- ঐ ছ্যামড়া কিছু লাগবো?
মেয়েটা তারপর চোখে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সোজা।
সেই চোখ জোড়ায় প্রেম নেই, কাম নেই। বেচে থাকবার আকুতি ছাড়া সেখানে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।