প্রজাতন্ত্রের শক্তি, গণমানুষের স্বাধীনতা
ফকির ইলিয়াস
======================================
যে কোন প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রশাসকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কি না তা একটি দ্রষ্টব্য বিষয়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, এই তত্ত্বই যদি সত্য হয় তবে কোনভাবেই শাসককুলের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল কাম্য নয়। তারপরও আমরা দেখি সরকারের মন্ত্রীরা মাঝে মাঝেই ক্ষমতার গরমে বেশ তপ্ত হয়ে উঠেন। আর তখনই রাষ্ট্রে নেমে আসে অশনি সঙ্কেতের ধ্বনি।
সম্প্রতি দেশের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ আলোচিত হয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি একটি ব্যাংকের এমডিকে অপহরণের জন্য গানম্যান পাঠিয়ে ছিলেন। এ বিষয়ে মন্ত্রীর একটি তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম। তাতে মন্ত্রী বলেছেন, মন্ত্রী নাকি ওই ব্যাংকের এমডিকে ফোন করে ছিলেন একটি তদবিরের জন্য। এমডি, মন্ত্রীকে চিনতে পারেননি। তাই মন্ত্রী তার কার্ড পাঠিয়ে ছিলেন, তার গানম্যান দ্বারা।
বিষয়টি আমাদের কাছে কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়েছে। কারণ একজন মন্ত্রী যখন নিজ রাষ্ট্রীয় আসনে বসে কাউকে ফোন করেন, তখন প্রথমে ফোনটি করেন মন্ত্রীর সচিব। অন্য পক্ষকে জানিয়ে দেন, মন্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে চান। অন্যপক্ষও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। এটাই বিশেষ নিয়ম।
ব্যক্তিগত ফোনালাপ ছাড়া। প্রশ্নটি হচ্ছে, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কি ওই ফোনটি ব্যাংকের এমডিকে করে ছিলেন? তিনি কেন করতে গেলেন? প্রতিমন্ত্রী টিভি চ্যানেলে বলেছেন, তিনি 'কিডন্যাপ' করার দায়িত্ব নেবেন কেন? প্রজাতন্ত্রে মন্ত্রী এমন কাজ করতে পারেন না।
হ্যাঁ, প্রজাতন্ত্র তো রাষ্ট্রের প্রজাদের শক্তি কেন্দ্র। তাই তারা কোন অবৈধ পেশি শক্তি দেখাতে যাবে কেন?
কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে কি তেমন নীতি পালন করা হচ্ছে? না হচ্ছে না। ইডেন কলেজে যা ঘটে গেছে তা ইতিহাসের নির্মমতম লজ্জা।
যা লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। সোজাসাপটা কথা হচ্ছে নিরীহ সাধারণ ছাত্রীরা দলীয় রাজনীতির শিকার হবে কেন? তারা কেন গ্রুপিংয়ের বলি হবে?
আমরা একটি কথা বারবার শুনছি, সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামোতে ষড়যন্ত্রকারীরা ঢুকে পড়েছে। এরা কারা? কীভাবে ঢুকল? এসব প্রশ্ন খুঁজে দেখা দরকার।
দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলছেন, মোটা চালের দাম ২৪ টাকা।
আর খদ্দেররা বলছেন, ২৮ টাকা কিংবা তারও বেশি। সবচেয়ে ভয়াবহ কথা হচ্ছে, সরকারের মুখপাত্ররা বলছেন, বাজার নাকি প্রধান বিরোধীদলের একটি সিন্ডিকেট অস্থিতিশীল করছে। আর বিরোধীদল বলছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারিদলের সিন্ডিকেট। এই যে, নিয়ন্ত্রণ পাল্টা নিয়ন্ত্রণের মহড়া তা হতাশ করছে সাধারণ মানুষকে।
মনে রাখা দরকার দোষারোপ করে বাঁচার কোন পথই কোন সরকারের থাকে না।
সমস্যা সমাধানের জন্যই জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার পানিতে বিষাক্ত জীবাণু আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। পান করা পানিতেও জীবাণু। এমন চরম হতাশা আর শঙ্কা নিয়েই বেড়ে উঠছে এ প্রজন্ম। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
লজ্জাজনকও বটে। ওয়াসার এমন কর্মকা- চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই।
দুই.
আর ক'দিন পরই পালিত হবে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা বার্ষিকী। প্রায় চার দশক সময় পার করল বাংলাদেশ। এই চার দশকে দেশটি কি স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে।
না পারেনি। কেন পারেনি? এর কারণগুলো খুঁজে দেখা খুবই দরকার। যে মৌলিক চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। ভোগবাদী মানসিকতা হরণ করেছে গোটা রাষ্ট্রের মানুষের লালিত স্বপ্নকে। এই বেদনায় আক্রান্ত বর্তমান প্রজন্ম।
যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশ নিয়েছিলেন তারা কি খুব বেশি চেয়েছিলেন এই রাষ্ট্রের কাছে? না চাননি। আমি সেই '৭২ সালে দেখেছি যুদ্ধ-ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের রিলিফের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকতে। পরে ক্রমশ সামান্য রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েও মান-সম্মান বাঁচাতে পারেননি এসব বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ দেশে হাজার হাজার মানুষ কোটিপতি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। পরাজিত ঘাতক আলবদর, রাজাকার শক্তি, প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের আখের।
পরবর্তী সময়ে এরাই বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
এখনও তল্লাশি করলে দেখা যাবে দেশে অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, শিল্পকারখানা, মিল ফ্যাক্টরিতে রাজাকার-আলবদররা প্রগতিশীল রাজনীতিকদের 'পার্টনার' হিসেবে রয়েছে। তারা জানে, নিজেদের অতীত অপকর্ম ঢাকতে হলে একটা ঢালের প্রয়োজন। এই ঢাল হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাদী শক্তিরা ব্যবহৃত হচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার শক্তির হাতে।
দীনতা কাটিয়ে উঠে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে প্রগতিশীল রাজনীতিকরা কতটা ঐক্যবদ্ধ তা প্রমাণের সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে।
আমরা প্রগতিশীলদের নগ্ন বিভক্তি দেখছি। অথচ মৌলবাদী জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন লেবাসে। আর তাদের শিকড় থেকে যাচ্ছে ওই একই।
বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য বদলানোর জন্য হঠাৎ করে কোন দেবদূত আবির্ভূত হবে না। বদলাতে হবে এদেশের মানুষকেই।
এজন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। আর সেই নেতৃত্ব হতে হবে সৎ এবং সত্যবাদী।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঙ্গনে মননশীল, দানশীল মানুষের একটি মোর্চা গঠিত হওয়া খুবই প্রয়োজন মনে করি। যারা শুধু সরকারি সাহায্যের দিকে না তাকিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রের সব মহৎ কাজগুলোতে হাত বাড়িয়ে দেবেন। বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে স্কুল, কলেজ, প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য, মেধাবী দরিদ্র ছাত্রসমাজকে সাহায্য, দুঃস্থ রোগীদের সাহায্য করার বৃহৎ পরিকল্পনা দানশীল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত হতে পারে।
এই দেশটি একটি সম্মিলিত স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। সেই স্বপ্নটি আজ গোষ্ঠীর কাছে বন্দি। এই বন্দিত্বের অবসান প্রয়োজন। আর এজন্য বিত্তবানদের উদার হস্ত বাড়িয়ে দেয়া খুবই প্রয়োজন। স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে স্বাবলম্বী হওয়া।
প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে নিতে অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টির গুরুত্ব অপরিসীম।
নিউইয়র্ক, ১৭ মার্চ ২০১০
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ১৯ মার্চ ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- ফিলো সহো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।