স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মুখরিত সারা দেশ। সর্বস্তরের মানুষই লড়ছে ঘাড় থেকে এই জগদ্দল পাথর নামানোর জন্য। বরাবরের মতো তরুণরাই সব থেকে এগিয়ে। জনগণ এই নি:স্বার্থ তরণ তুর্কীদের কাছেই সবচেয়ে বেশী আশা করে। আমি এক ছাপোষা কেরাণী।
সারাক্ষণ চাকরী যাবার ভয়ে তটস্থ। তরুণদের সংগ্রামের প্রতি আকর্ষণ যতোই থাক প্রকাশ্যে জ্বী হুজুরীর বিরাম নেই। অফিসে যাওয়া আসার পথে মিছিলের জন্য প্রায়ই ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাই। আশেপাশের আটকেপড়া লোকদের নানা মন্তব্য কানে আসে। বেশীরভাগই মিছিলের ছেলেদের পক্ষে।
বিভীষণ, মীরজাফরদের দু'চারটে বংশধরের দেখাও মিলে যায় মাঝেমধ্যে। স্বৈরাচারের প্রতি তাদের ঈমানের বয়ান বেশ জোরের সাথেই দেয় তারা। আমি মনে মনে বিরক্ত হই। প্রকাশ্যে ভয়ে কথা বলি না। মাঝে মাঝে ছাত্রপুলিশ মারামারির মধ্যে মধ্যে পড়ে বেহাল দশায়ও পড়ে যাই।
এক বিকেলে অফিস থেকে রাস্তায় নেমেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় পড়ে গেলাম। কাছের এক গলির ভেতর দিয়ে দৌড়ে আরেকটা রাস্তায় উঠলাম। সেখানেও সবাই প্রাণপনে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। শিশু আর মহিলাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। রাস্তা টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।
দু'চোখ জ্বলছে। ছুটন্ত এক লোক পাশকাটাবার সময় জানালেন পুলিশ গুলীও ছুঁড়েছে।
বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। কী করবো না করবো ঠিক করতে পারছিলাম না। এমন সময় এক তরুণ আমার কাছে এসে বললো, ''ভাই, একটু সাহায্য করুন, প্লিজ ! আমার প্যান্টের বাঁ পকেটে একটা রুমাল আছে।
সেটা বের করে আমার কবজিতে বেঁধে দিন। ''
দেখলাম ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কবজি ধরে আছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি দ্রুত তার পকেট থেকে রুমাল বের করে তার কবজিতে বাঁধলাম। কিন্তু রক্ত থামানো গেলো না।
তাড়াতাড়ি আমার রুমালটাও বের করে তার হাতে বাঁধলাম। বাঁধা শেষ হতেই সে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার রাস্তায় ছুটলো।
আমি পিছু ডাকলাম, ''এই যে শুনুন। '' সে থমকে জিজ্ঞেস করলো, ''কিছু বলবেন ?'' বললাম,''ওদিকে যাবেন না। এখন ওদিকে যাওয়া নিরাপদ না।
''
''ও !'' এটুকু বলেই আমার আশঙ্কাটাকে বিন্দুমাত্র মূল্য না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো সে।
মাসখানেক পর আমার এক অসুস্থ বন্ধুর সাথে দেখা করে পিজির গেট দিয়ে সবে বেরিয়ে এলাম। দেখি, বিরাট এক মিছিল চলেছে শাহবাগ থেকে বাংলামোটরের দিকে। অসংখ্য মানুষের স্লোগানে যেন সারা ঢাকা শহর কাঁপছে। মুগ্ধ হয়ে মিছিল দেখছিলাম।
হঠাৎ একটা ছেলে মিছিল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। তার বাঁ হাতটা কনুইয়ের নীচ থেকে নেই। অবাক হয়ে দেখলাম সে আমার দিকেই ছুটে আসছে। কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারলাম। সেই ছেলেটা।
যার গুলীবিদ্ধ বাঁ কবজিতে আমি রুমাল বেঁধেছিলাম।
সে আমার কাছে এসে একটা রুমাল হাতে দিয়ে বললো,''এই নিন আপনার রুমাল। আপনাকে অনেক খুঁজেছি। '' এটুকু বলেই আবার মিছিলের দিকে ছুটলো।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম,''শুনুন।
''
সে থমকে দাঁড়িয়ে বললো,''বুঝেছি। এভাবে নিতে মন চাইছে না, এই তো ?''
আমি হাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
''আচ্ছা, তাহলে মনে করুন এটা আমার উপহার। '' একথা বলেই ছুটে গিযে আবার মিছিলের সঙ্গে মিশে গেলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।