সাভারে এখন আর লাশের গন্ধ নেই। চকচকে রানা প্লাজা বা তার ধ্বংসস্তূপেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। তিন বিঘার মতো জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে টুকরা কংক্রিট, ছিন্নভিন্ন কাগজ-কাপড়-প্লাস্টিক। আর আছে মানুষের হাহাকার, বুকের ভেতর জমে থাকা কান্না আর শঙ্কা।
গত ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে নয়টার দিকে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত নয়তলা রানা প্লাজা।
ধসে পড়ার সময় ভবনে স্থাপিত পাঁচটি কারখানায় কাজ করছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। ধসের পরেই ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। ২১ দিনের টানা অভিযানে জীবিত উদ্ধার হন দুই হাজার ৪৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন পরে হাসপাতালে মারা যান। শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ১২৭ জনে।
ভবনধসের এ ঘটনা বিশ্বে বড় ধরনের একটি শিল্পবিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে বিশ্ববাজারে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের এক মাস পার হলো, কিন্তু স্বজনহারা মানুষের হাহাকার থামেনি। অনেকগুলো পরিবার শোক কাটিয়ে উঠলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের শঙ্কা বেড়েছে। বেশির ভাগই হারিয়েছে পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে। বহু শিশু হয়েছে অভিভাবকহীন।
আহত ব্যক্তিরা শারীরিকভাবে যে রকম ক্ষতির শিকার হয়েছেন, সে তুলনায় ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের দাফন খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা আর আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার করে নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। সরকার আহতদের চিকিৎসার তদারক করছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কিছু নিহতের স্বজনকে ডেকে একটি করে চেক দেওয়া হয়েছে। তবে প্রত্যেক নিহত কত টাকা পাবেন, আহতরা কত পাবেন, তা এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি।
অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি হতাহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সরকারি হিসাবে ৮৩৬টি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২৯১টি মৃতদেহ অ-শনাক্ত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। শনাক্তের জন্য এই দেহগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখনো কয়েক শ মানুষ রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে প্রতিদিন ভিড় করছেন ঘটনাস্থল আর সাভার উপজেলা পরিষদে।
উপজেলা প্রশাসনের কাছে ৩১৬ জন নিখোঁজের তথ্য রয়েছে।
হাসপাতালগুলোতে এখনো চলছে আহতদের আর্তনাদ। বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ভর্তি রয়েছেন ২২৩ জন আহত ব্যক্তি। যাঁদের বেশির ভাগেরই হাত বা পায়ের মতো অঙ্গহানি হয়েছে। তাঁঁদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে চলেছেন।
নিহতদের পরিবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় রয়েছে। আর আহতদের দাবি পুনর্বাসন।
ডেকে এনে হত্যা: রানা প্লাজার ওপরের ছয়টি তলায় পাঁচটি পোশাক কারখানা, দোতলা ও নিচতলার এক অংশে বিপণিবিতান, আরেক অংশে ব্র্যাক ব্যাংকের সাভার শাখার কার্যক্রম চলছিল। ২৩ এপ্রিল সকালেই রানা প্লাজার তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিম, দেয়াল ও স্তম্ভে ফাটল দেখা দেয়। ধসের আতঙ্কে পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসেন।
ওই দিন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। খবর শুনে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীরা। ওই দিন বিকেলেই ইউএনও গণমাধ্যমকে বলেন, সে রকম কিছু হয়নি।
পরদিন (২৪ এপ্রিল) সকালে পোশাক কারখানাগুলোর মালিকেরা মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে ফোন করিয়ে ডেকে আনেন শ্রমিকদের। শ্রমিকেরা যেতে না চাইলে জোর করে তাঁদের কারখানায় ঢোকানো হয়।
সকাল আটটার দিকে কাজ শুরু করার কিছু সময় পরই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বিকট শব্দে ধসে পড়ে নয়তলা ভবনটি। মাথার ওপর পড়া ইট-কংক্রিটে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে সেখানেই প্রাণ হারান সহস্রাধিক মানুষ। অনেকের গলিত লাশ বের করা হয় ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে।
জীবন বাজি রাখা উদ্ধার অভিযান: ধ্বংসস্তূপের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে জীবন বাজি রেখে ঢুকে পড়েন উদ্ধারকারীরা। হাঁকডাক দিয়ে আহতদের অবস্থান শনাক্ত করে একের পর এক বের করে আনছিলেন জীবিত মানুষদের।
অক্সিজেনের অভাব, হাঁসফাঁস করা গরমে কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। তবু থেমে থাকেনি উদ্ধারকাজ।
ভবনধসের পঞ্চম দিনে জীবিত উদ্ধার করা হয় কিউ এম এ সাদিক নামের পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তাকে। তখন তৃতীয় তলায় শাহীনা নামের এক শ্রমিককে জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু রাত ১০টায় সুড়ঙ্গে আগুন ধরে যাওয়ায় শাহীনাকে আর জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।
সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান উদ্ধারকর্মী এজাজউদ্দীন কায়কোবাদ।
বিস্ময়কন্যা রেশমা: ধ্বংসস্তূপের জীবিত মানুষ পাওয়ার যখন কোনো আশাই ছিল না, তখনই ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা। ভবনধসের ১৭তম দিনে (৩৯১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর) জীবিত অবস্থায় বের করা হয় পোশাকশ্রমিক রেশমাকে। এখনো সাভার সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।
আর কত খুঁজব? ‘তোমরা আমার ভাইয়ের লাশটাও দিলা না।
লাশ দেও, আমি আর কিছু চাই না। ’ গতকালও ঘটনাস্থলে ভাই সুরুজের খোঁজে এসেছিলেন বগুড়ার সুজন। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইতেই এ কথা বলে কেঁদে ফেলেন তিনি। ফেটে পড়েন ক্ষোভে। ভবনের ভেতরে আটকে থাকা অবস্থায় ভাইয়ের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন সুজন।
কিন্তু এখনো ভাইয়ের লাশ বা কোনো খোঁজ পাননি।
সুজন জানান, সাততলায় একসঙ্গে আটকা পড়েছিলেন বগুড়ার সুরুজ, শাজাহান, আলতাব ও এক নারী কর্মী। কোমর বরাবর বিম পড়ে আলতাব চাপা পড়ে থাকলেও অন্যরা ছিলেন সুস্থ। ঘটনার দিনই তাঁদের সন্ধান পান বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র উদ্ধারকর্মী কাঁকন দাস। তাঁর সাহায্যেই ভাই সুজনকে ফোন করেছিলেন আটকে থাকা সুরুজ।
উদ্ধারকর্মী কাঁকন জানান, শেষ পর্যন্ত তাঁদের জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।
এ রকম অসংখ্য হূদয়ভাঙা গল্প ছড়িয়ে রয়েছে সাভারের আনাচকানাচে। জামালপুরের সারদাগঞ্জের বিথী খাতুনের ছবি নিয়ে তাঁর বাবা নায়েব আলী চষে বেড়াচ্ছেন সাভারের অলিগলি। দিনে অন্তত দুবার আসেন রানা প্লাজার সামনে। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা আর কত খুঁজব।
অন্তত লাশটার ব্যবস্থা কইরা দেন। ’
গতকাল ঘটনার ৩০তম দিনে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রানা প্লাজার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছেন। নিখোঁজদের স্বজনসহ এলাকার লোকজনও এতে অংশ নেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, ডেকে এনে শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে।
ভবনধসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে।
ধসে পড়া ভবনটির মালিক সোহেল রানা, তাঁর বাবা আবদুল খালেক ও পাঁচটি কারখানার মালিকসহ ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।