তখন ফাগুন মাস। কঠিন দুপুর।
ঝড়টা আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আর দশটা তপ্ত দুপুরের মতোই চলছিল খাজুরতলা গ্রামের কাজকারবার। বড় মসজিদের ইমাম সাহেব জোহর নামায শেষে বাড়ি ফিরছিল। চাচা আব্দুর রহমান ক্ষেতের কাজটা মাত্রই শেষ করে হাতমুখ ধুতে পাশের খালে নেমে গিয়েছিল ততক্ষনে।
ভাতিজা আয়নাল নামবে নামবে করেও নামছিলা না, এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল আসমানীর খোজে। সদ্যই বিয়ে করা আয়নালের ষোড়শী বউ আসমানী তখন মাত্র ভাত বেড়ে গামছা দিয়ে বেঁধে রওনা হয়েছিল ক্ষেতের দিকে। ভয়ে ভয়ে, দেরী হয়ে গেছে কিনা ভাবতে ভাবতে। গোরা নিবারন চক্রবর্তী হেটে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে স্নান থেকে ফেরার পথে। জমিরনের ছোট নাতি পিচ্ছি বিচ্ছু শফিক তখন নিবারন দাদুকে ছুয়ে দেবার জন্য সুযোগ খুজছিল।
ছঁইয়ে দিতে পারলেই দাদু আবার স্নানে যাবে। নিবারনও ব্যাস্ত গা বাঁচিয়ে চলতে। নিবারন চক্রবর্তীর বিধবা মেয়ে সরলা বাপের জন্য রান্না করে নিজের জন্য নিরামিষ রান্নায় ব্যাস্ত। বাড়ির পেছনে জংলার দিকে তখন ওত পেতে ছিল ফটকা মোতালেব, সাথে আখলাছ। মনের ভেতর কু-মতলব থাকলেও সাহসে কুলায় না অন্য কিছু করার।
সরলাদের পাশের বাড়ির ছমিরন দাদীর চোখটা নিবারনদের বাড়ির দিকে, ফটকাটাকে কয়েকদিন ধরে ঘুরঘুর করতে দেখে। চৌধুরীদের আম বাগানের নিচে, আমের মুকুলের গন্ধ মাদকতার মাঝে, এক বৈষ্ণবী গান গাচ্ছিল আর সামনে মাদুরে বসে তা শুনছিল চৌধুরী বাড়ির ইউনিভার্সিটি পাশ করা ছেলে স্বাধীন চৌধুরী, তার মেডিকেলে পড়ুয়া বউ মুক্তিকে নিয়ে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে গ্রামের মানুষজন।
মাত্র আধাঘন্টার ঝড়ে খাজুরতলার খুব বেশি ক্ষতি হয় নাই। অন্তত বাহ্যিক কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর শোনা যায় নাই।
বাজারের পাশে স্কুল পাঠের পুর্বপাশে যে পরদাদার আমলের বটগাছ সেটা আগের মতোই দাড়িয়ে ছিল। পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর পানিও বাড়েনি বেশি। চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা রহম আলীর নৌকাটাও কোন দুলুনী খায়নি। গ্রামের প্রায় বাইয়ে ক্ষেতের মধ্যে দ্বীপের মতো জুলেখাদের ছনের ঘরটারও কোন ক্ষতি হয় নাই। আম গাছের মুকুলগুলো ঝরে পরে নাই।
বৃষ্টি ছিল না। তবুও যেন ঝড়টা ওলট-পালট করে দিয়েছে পুরো খাজুরতলা গ্রাম।
বড় মসজিদের ইমাম সাহেব দ্রুত বাড়ি গিয়ে কিছু না খেয়েই বসে গেছে জায়নামাজে। ঝিকির পড়ছে। বিড়বিড়িয়ে বলছে ‘ফাবিআইয়ি আলায়ি রাব্বিকু মা তুকাজ্জিবান’ ‘আমি আপনার কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবো?’।
ইমাম সাহেবের স্ত্রী স্বামীর ব্যাবহারে ভয় পেয়ে নিজেও বসে পড়েছে স্বামীর পাশে। চাচা আব্দুর রহমান আর ভাতিজা আয়নাল তখন খেয়ে ফেলেছে দুপুরের খানা। আসমানী হাতে থাকা পাখাটা দিয়ে বাজার করছিল স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। ‘বুঝলি কলিম, এইবার আর ধান লাগামু না, পাট বুনতি হবি। যুদ্ধ টুদ্ধ লাগলি পাটক্ষেতের মইধ্যিরতন যুদ্ধ করা সোজা।
’ চাচার মুখে কথাটা শোনার পরে দুজনের কেউ কিছু বলে না। বলে না ধান না হলে খাবে কি? তাদের মধ্যে অন্য ভাবনা। ‘দ্যাশই যদি না থাহে তাইলে খাওন দিয়া কি করমু?’
সরলার মনে তখন ঝড়ের প্রকোপ। আর কতদিন এরকম, মুখ বাঁচিয়ে, পিঠ বাঁচিয়ে, চুপে চুপে বেঁচে থাকা। আর কতকাল ভিটেভাটি দখলের ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকা।
আর কতকাল? সরলা খুব আশ্চর্য হয়ে যায় যখন দেখে বাবা শফিককে কাধে করে বাড়ি ফিরছে। বাবাকে দেখে মনের মধ্যে বল পায় সরলা। এতদিন পরে বাবা যেন অন্যরকম। ঝড়টা তাহলে সরলার মনের মধ্যেই প্রভাব ফেলেনি। বাবার মধ্যেও ফেলেছে।
দুজনের জন্য ভাত বাড়তে চলে যায় সরলা। ফটকা মোতালেবের সাহসটা বেড়ে যায় ঝড়ের পরে। আহারে, সরলা! কি চমত্কার না দেখতে! সরলার মুখটা মনে করতে করতে আওরাতে থাকে ‘হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের- কইছে তরে?’ এইবার মালাউনের বাচ্চাটা যাইবো কই? এই দ্যাশটা খালি মুসলমানের। হিন্দুরা গনিমতের মাল। শফিকের দাদী ছমিরন তখন দা’য়ে শান দিতে ব্যাস্ত।
অনেক অনেক কাল আগে শফিকের দাদার রাম’দা টা জং ধরে গেছে। ফটকা মোতালেবের সাহসটা বেড়ে গেছে। সরলারে বাঁচাতে হবে।
চৌধুরীদের আমবাগানের নিচে বৈষ্ণবীর গানটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। গানের পরিবর্তনটা নজর এড়ায় না ছেলের বউটার।
বাড়িরি কোনদিকটা হাসপাতাল করলে সুবিধা হয় তা ভাবতে থাকে মনে মনে। স্বামীর হাতটা ধরে থাকে সাহস যোগান দেয়ার জন্য। বউয়ের হাতের স্পর্শে সাহসের ওম পায় চৌধুরীদের ছেলেটা। পাশ ফিরে দেখে মুক্তি হাসছে। মনে মনে না বলে এবার ভাষণের মতো করে বলে ‘হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’
ভাষণ ঝড়ের প্রকোপে গ্রামের মানুষজন প্রথমে হচকচিয়ে গেলেও সামলে উঠে। গলা মেলায় স্বাধীনের সাথে ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।
’
.......................................................
ফাল্গুন মাসের শেষের দিক ছিল সে ঝড়ের সময়টা। বাংলা মাসের হিসাবটা আজকাল আমাদের কাছে খুব বিদঘুটে লাগলেও যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে সেটাই ছিল সহজ। বোরো মৌসুমে ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময় হলো ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ১৫ই জানুয়ারী না বলে কৃষককে যদি বলা হতো পুরা পৌষ মাস তবে বোঝানো সহজ হতো। তবুও কিছু কিছু সময় থাকে যা বাংলা-ইংরেজীর দ্বন্ধ থেকে মুক্ত। যাদের কাছে পাটের জাতের ইংরেজী নামের চেয়ে বৈশাখমাসি জাত বা ফাল্গুন-চৈত্রমাসি জাত বেশি সহজ ছিল তাদেরও একাত্তরের মার্চের কথা বললে সেটা বাংলা কোন সনের কোন মাস তা জানতে চাইবে না।
কারন একটা দেশের গর্ভনিষেকের সময়টা একজন পিতা বা মাতার সন্তানের গর্ভনিষেকের সময়ের মতোই জীবনভর মনে রাখার বিষয়। সেখানে গোধুলী ছিল না সন্ধ্যা, বাতাস ছিল না উত্তাপ, সব খুটিনাটি মনে থাকে। সব কিছু থাকে অন্যরকম। ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তাই কোন সময় থাকে না। হয়ে যায় তা সব সময়ের।
তবুও সেই ফাগুনলাগা কঠিন দুপুরে খাজুরতলার মতোই বাংলার সমস্ত গ্রামে ঝড় বয়ে চলে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঝড়।
সে ঝড়েই নিষিক্ত হয় বাংলাদেশ। যেন ঝড়ের প্রকোপে পরাগরেনু ছড়িয়ে পড়ছিল গ্রাম থেকে গ্রামে। খাজুরতলা থেকে পাশের ডুমরীতলায়, তার পাশে কৃষ্ণপুরায়।
প্রস্তুত হয় পুরা বাংলা।
যার যা আছে তাই নিয়ে। বুঝা যায় মানুষকে। কে কোন ভুমিকায় অবতীর্ন হবে গর্ভনিষেকের পরের নয় মাস।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।