দুঃখের জল,করে ছল-ছল...
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নিউজউইকের ইন্টারভিউতে আমেরিকায় তার নতুন প্রকল্পে কাজ করার কথা বলছিলেন এবং নোবেল পুরস্কার প্রত্যাশী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আমেরিকায় জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে বিশ্বশান্তির জন্য তার নিজস্ব ফর্মুলা দিচ্ছিলেন তখন তার কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নয়া পল্টনে তার দেয়া ভাষণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই গভীর চিন্তাভাবনা করছিলেন।
ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনার তুলনায় তার ভাষণ দেয়ার বিষয়টি ছিল কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। ড. ইউনূসের সামনে কোনো লাইভ অডিয়েন্স ছিল না- ছিল শুধু তার ইন্টারভিউয়ার আর এম শ্নেলডারম্যান ও তার টেপরেকর্ডার এবং নিউজউইক ফটোগ্রাফার।
শেখ হাসিনার সামনে ছিল ওই অধিবেশনে যোগদানকারী শ’খানেক বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রতিনিধিরা এবং অধিবেশনের সভাপতি। সেখানে বৃষ্টিপাতের আশংকা ছিল না।
আইন-শৃংখলা ভঙ্গ হবার ভয় ছিল না। কোনো সরকারি হামলার ভয় ছিল না। বিদ্যুৎ চলে যাবার ভয় ছিল না। নামাজের আজান শোনার সম্ভাবনা ছিল না। এসব নিশ্চয়তার মধ্যে নিরুপদ্রবে লিখিত টেকস্ট থেকে প্রায় ১,৬৫০ শব্দের বাংলা ভাষণটি শেখ হাসিনা পড়ে শোনান।
খালেদা জিয়া তখন ভাবছিলেন তিনি কী করবেন?
কৌতূহল ও প্রত্যাশা উভয়ই ছিল
এ বছর মৌসুমী বৃষ্টি এসেছে দেরিতে। আশ্বিন শুরু হয়ে গেলেও প্রায়ই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলবার ২৭ সেপ্টেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপির হেড কোয়ার্টার্সের সামনে মঞ্চে তেরপল থাকবে। তাই সেখানে বক্তারা ভিজবেন না। কিন্তু ভিআইপি রোড জুড়ে যে দর্শক সমাগম হবে তাদের কী হতে পারে?
বৃষ্টি হলে দর্শক সমাগম কেমন হবে? যেখানে বড় দর্শক সমাগম দেখানোই এই আয়োজনের প্রধান লক্ষ্য, সেখানে কম দর্শক সমাগম তো দেশবাসীর কাছে উল্টো বার্তা বহন করবে।
কোন ক্ষ্যাপা শ্রাবণ আশ্বিনের আঙিনায় ছুটে এসে সব কিছুই কি পন্ড করে দেবে?
ড. ইউনূসের ইন্টারভিউ সম্পর্কে পাঠকদের কৌতূহল ছিল কিন্তু কোনো প্রত্যাশা ছিল না। শেখ হাসিনার ভাষণ সম্পর্কে শ্রোতাদের কোনো কৌতূহল ছিল না। তারা জানতো, শেখ হাসিনা নিয়মমাফিক তার পিতার কথা, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা এবং নিজের শাসন আমলে সাফল্যের কথা বলবেন। তবে তাদের গভীর প্রত্যাশা ছিল যে তিনি ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকায় সফরের পর তিস্তার পানি বন্টন বিষয়ে কোনো চুক্তি না হওয়ায় (এর আগেই আশুগঞ্জ-আখাউড়া হয়ে ইনডিয়াকে বিনা শুল্কে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে দেয়া সত্ত্বেও) জাতিসংঘে প্রতিবাদ জানাবেন যেমনটা নভেম্বর ১৯৭৭-এ জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান করেছিলেন।
এদের দুজনার বিপরীতে খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রোতাদের কৌতূহল এবং প্রত্যাশা উভয়ই ছিল।
কৌতূহল ছিল যে তিনি সরকার পতনের লক্ষ্যে কী কর্মসুচি ঘোষনা করবেন এবং প্রত্যাশা ছিল যে এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি সবাইকে নিয়ে এখনই সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমে পড়বেন। এছাড়া আরো কয়েকটি কৌতূহল ছিল।
এক. খাবারদাবার, জিনিসপত্র, তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাস, সার, প্রভুতির দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে কী বলবেন এবং তিনি ক্ষমতায় এলে এই বৃদ্ধি কীভাবে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখবেন?
দুই. আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা সেই বিষয়ে এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে কী বলবেন?
তিন. তিস্তার পানি বন্টন, টিপাইমুখে ইনডিয়ান বাধ নির্মাণ এবং আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে ইনডিয়াকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে দেয়া সম্পর্কে কী বলবেন?
চার. মানুষের কর্মসংস্থান বিষয়ে কী বলবেন?
পাঁচ. শেয়ার মার্কেটে মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়া বিষয়ে এবং ভবিষ্যতে সেখানে যেন কোনো কেলেংকারি না হয় সে বিষয়ে কী বলবেন?
ছয়. প্রশাসন দলীয়করণ এবং বিচারবিভাগকে সাজানোর বিষয়ে কী বলবেন?
সাত. বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন?
সমবেত মানুষের এত দাবি, এত অভিযোগ, এত আশা-আকাঙ্খার বিষয়ে এক ভাষণে কি তিনি তাদের সন্তুষ্টি দিতে পারবেন?
কতোক্ষন বলতে হবে তাকে?
এসব পশ্ন নিশ্চয়ই খালেদাকে ভাবিত করছিল।
নি:সঙ্গতা ও মানসিক কষ্ট
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে আবার বিরোধী দলীয় নেত্রী রূপে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের পথ অতিক্রম শুরু হয়েছে। তার বর্তমান বয়স ৬৬ এবং তার দুই হাটুতেই অপারেশন হয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে তিনি কায়িক কষ্টের চাইতে মানসিক কষ্টে বেশি আছেন। ১৯৮১-তে ছত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হবার পর থেকে ক্যান্টনমেন্টে একই বাড়িতে তিনি তার সন্তান ও নাতনিদের নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করছিলেন। এখন তাকে একাই থাকতে হচ্ছে গুলশানে নতুন একটি ভাড়া বাড়িতে। সাধারণত পশ্চিমে নারীদের রিটায়ারিং বয়স হচ্ছে ৬০ এবং পুরুষদের ৬৫। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ৫৭-তে রিটায়ার করবেন।
বয়স এবং বাড়িতে নিঃসঙ্গতা খালেদা জিয়াকে কি রাজনীতি বিমুখ করবে? এই প্রশ্নটিও বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনে প্রায়ই ঘুরপাক দিয়ে যায়। নয়া পল্টনের জনসভায় খালেদা জিয়ার এই মানসিক অবস্থার কোনো অসতর্ক প্রতিফলন ঘটবে কি? সেই প্রশ্নও সেদিন শ্রোতাদের মানে উকি দিয়েছিল।
বিশাল সমাবেশের প্রস্তুতি ও প্রকৃতি
মঙ্গলবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১, ১২ আশ্বিনে ঢাকায় সকালবেলা থেকে আকাশ মুখ ভার করে ছিল। ন’টার দিক থেকে শুরু হয়ে যায় তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি চলে প্রায় দেড় ঘন্টা যাবৎ।
তবে কি প্রকৃতি ফরিয়াদি মানুষের বিপক্ষে চলে গিয়েছে? বিএনপির মঞ্চ সাজাতে গোছাতে ব্যস্ত, সাতটি ট্রাকে সাতটি টিভি স্কৃন ফিট করায় ব্যস্ত, কাকরাইলের মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত স্পিকার লাগাতে ব্যস্ত বিএনপি কর্মীদের মনে এই প্রশ্ন জাগে।
এক সময়ে বৃষ্টি থেমে যায়। বিএনপি নেতা-কর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
সকাল সাড়ে দশটা থেকে শত শত কর্মী-সমর্থকদের বহু মিছিল নয়া পল্টন এলাকায় এসে জড়ো হতে শুরু করে। ফলে সাড়ে বারোটার পর থেকে এই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষ ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল গোল চত্বর, নটরডেম কলেজ, ফকিরাপুল, নয়া পল্টন, কাকরাইলের মোড় থেকে কাকরাইলের মসজিদ এবং বিজয় নগর, পুরানা পল্টন থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত। বেলা আড়াইটার পর এসব এলাকাতেও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং তার প্রতিক্রিয়া হয় রাজধানীর অন্যান্য কিছু স্থানে। ফলে সরকারি-বেসরকারি অফিস কর্মচারিদের দুর্ভোগে পড়তে হয়।
এই বিশাল সমাবেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন শৃংখলা বাহিনী কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল। সমাবেশ স্থলে ছিল র্যাব ও পুলিশ।
আরো ছিল আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, জলকামান, পৃজন ভ্যান ও ডগ স্কোয়াড।
নয়া পল্টন ও তার আশপাশের এলাকায় আসতে থাকে পায়ে হেটে অথবা বাস বা ট্রাকে চড়ে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক, দল, শ্রমিক দল, মহিলা দলসহ প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিশাল সাংগঠনিক কাজটি সফলভাবে পালন করে মহানগর বিএনপি কমিটি। ঢাকা মহানগরের প্রতিটি থানা এবং ওয়ার্ড থেকে মিছিল আসে, মহানগর বিএনিপর জয়েন্ট কনভেনর, ওয়ার্ড কমিশনার ও গত পার্লামেন্টারি নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন- এমন নেতারা পৃথক মিছিল নিয়ে আসেন। এছাড়া, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, এলডিপি, বিকল্প ধারা, জাগপা প্রভৃতি সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীরাও পৃথক মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসেন।
আগত মিছিলের স্লোগান ছিল:
দিন বদলের দরকার নাই
গ্যাস বিদ্যুৎ পানি চাই।
আর কোনো দাবি নাই
দশ টাকায় চাল চাই।
ঘরে ঘরে চাকরি চাই।
ভাত দে কাপড় দে
নইলে গদি ছেড়ে দে।
খালে বিলে আর লাশ না
হাসিনা সরকার চাই না।
আশ্চর্য। বাঙালি তার দাবিদাওয়া তুলে ধরে প্রচন্ড হতাশা আর গভীর দুঃখের বর্ণনা দেয় কবিতারই মাধ্যমে! আর কবিতা প্রেমীদের ওপরই ঝাপিয়ে পড়ে লাঠি-বৈঠা-লগি প্রেমীর দল!
কিন্তু এই দিন নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সেই ভয়ে ভীত ছিলেন না। এই দিনের জনসমাবেশের একটি বড় বৈশিষ্ট ছিল দল ও সংগঠনের বাইরে যারা সরকারের ব্যর্থতার শিকার ও সমালোচক তাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান সরকারের আমলে চাকরি হারা, অন্যায়ভাবে ওএসডি এবং ট্রান্সফার হওয়া, শেয়ার মার্কেটে ফকির হওয়া, বিদেশ থেকে ফিরে আসা, গণহুলিয়া জারির শিকার, প্রভৃতি মানুষ। এই জনসমাবেশে এই বিধ্বস্ত মানুষরা বুঝতে এসেছিল অদূর ভবিষ্যতে তাদের ভাগ্য বদলাবে কিনা।
এরা ছিল আমেরিকান টার্মিনলোজিতে যাদের বলা হয় ইনডিপেনডেন্ট সাফারিং ক্রাউড (Independent Suffering Crowd) বা ভুক্তভোগী স্বাধীন মানুষ। এই জনসমাবেশে রেন্ট-এ-ক্রাউড (Rent-a-Crowd) বা ভাড়া করা মানুষ ছিল না।
এই জনসমাবেশ ছিল দল ও দলের বাইরের জীবিত ও অর্ধজীবিত (যারা এক বেলা খেয়ে থাকতে বাধ্য হন) মানুষের জীবন্ত প্রতিবাদ সভা। এখানে বেলা বারোটা থেকে জাসাস সাধারণ সম্পাদক মনির খানের নেতৃত্বে পরিবেশিত হতে থাকে প্যারোডি, গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান। বেলা দুইটায় শুরু হয় জনসভা।
বুলেট প্রুফ নয়
এই পটভুমিকায় বিএনপি নেত্রী সভাস্থলে এসে পৌছান বেলা প্রায় পৌনে চারটায়।
তার পরনে ছিল শাদা জর্জেটের শাড়ি। কানে ছিল ছোট পার্লের টব। চোখে ছিল টিনটেড সানগ্লাস।
এই সময়ে মঞ্চে উপবিষ্ট বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা একের পর এক ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তখন রোদ ছিল। ভ্যাপসা গরম ছিল। কয়েক লক্ষ মানুষের দেহ নিঃসৃত তাপ পরিবেশকে আরো গরম করেছিল।
আমেরিকায় নিউজউইকের অফিস অথবা ড. ইউনূসের হোটেল রুমের ঠান্ডা পরিবেশ কিংবা জাতিসংঘের অ্যাসেম্বলি হলের নিরুত্তাপ ও নিরাপদ পরিবেশ এখানে ছিল না।
বিকেল পাঁচটায় খালেদা জিয়া কোনো চশমা ছাড়া তার অলিখিত ভাষণ দেয়া শুরু করেন।
প্রথমেই তিনি জনতার কাছে প্রশ্ন করেন, আপনারা কেমন আছেন?
সবাই সমস্বরে উত্তর দেয়, ভালো নেই।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে জনসভায় শেখ হাসিনা বুলেট প্রুফ কাচের দেয়ালের আড়ালে উপস্থিত থাকেন। খালেদা জিয়া সেই নিরাপত্তা আগেও নেন নি, সেদিনও নেন নি।
এরপর খালেদা জিয়া প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী ভাষণে যেসব পয়েন্ট কভার করেন তার সারাংশ হলো:
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : দ্রব্যমূল্যের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ আজ ভালো নেই।
তিনি দৈনিক নয়া দিগন্ত-র পাতা থেকে ‘ডাস্টবিন থেকে একজন মহিলা খাদ্য খাচ্ছেন’- এমন একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার বলছে, দেশের মানুষ নাকি চার বেলা খাচ্ছে। অথচ পত্রিকার পাতায় যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা কিন্তু অন্য কথা বলে। আসলে সরকারের লোকেরা চার বেলা খাচ্ছেন।
তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি : বিদেশে তেলের দাম কমলেও দেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ আমাদের সরকারের সময় যখন বিদেশে দাম বাড়ছে তখন আমরা ভর্তুকি দিয়ে এসবের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রেখেছিলাম।
তিনি বলেন, কেরোসিন ও ডিজেলের দাম আমাদের সময় ছিল ৩৩ টাকা, এখন তা ৫১ টাকা। তেমনিভাবে পেট্রলের দাম আমাদের সময় ছিল ৫৬ টাকা, এখন ৮১ টাকা। অকটেন ৫৮ ছিল, তা বেড়ে হয়েছে ৮৬ টাকা। সিএনজি’র দাম এক বছরেই ১৬:৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। ফার্নেস তেলের দাম আমাদের সময় ছিল ২৬ টাকা, এখন হয়েছে ৫০ টাকা।
সারের দাম বৃদ্ধি : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে অঙ্গীকার করেছিল, তারা ক্ষমতায় গিয়ে বিনামূল্যে সার বিতরণ করবে। এখন তারা বিনামূল্যে তো দিতেই পারছে না, বরং বেশি দাম দিয়েও সার পাচ্ছে না কৃষক। তিনি বলেন, আমাদের সময় এক বস্তা ইউরিয়া সারের দাম ছিল ২৮৬ টাকা। এখন এর দাম ১,০৬০ টাকা। এজন্য তিনি এ সরকারকে ভাওতাবাজ ও মিথ্যাবাদী সরকার বলে আখ্যায়িত করেন।
শেয়ার মার্কেটে ক্যু : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ‘শেয়ার মার্কেটে ক্যু’ হয়। তিনি বলেন, এবার প্রায় ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে। তারা টাকা দেশেও রাখে নি। সেই লুটের টাকা ডলার-পাউন্ড কিনে বিদেশে পাচার করেছে। যার জন্য এখানে বিদেশি কারেন্সির দাম বেড়ে গেছে।
মানুষ এই অপকর্মের জন্য স্বাভাবিকভাবে ন্যায়বিচার আশা করে। কিন্তু আজ ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই।
সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ : রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ করা হয়েছে বলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন খালেদা। তিনি বলেন, প্রশাসনকে নির্লজ্জভাবে দলীয় করা হয়েছে। ৪৬০ জনকে ওএসডি করা হয়েছে।
কী অপরাধে ওরা ওএসডি? এরা সিনিয়র, ভালো, নিরপেক্ষ অফিসার। এরা আওয়ামী লীগের দালালি করে না বলে ওএসডি করা হয়েছে। অবিলম্বে ওএসডি প্রত্যাহার করে প্রশাসনকে সচল করার দাবি জানান তিনি।
একই সঙ্গে তিনি নতুন করে বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে বলেন, এ দুঃশাসনের কবলে পতিত মানুষের সর্বশেষ আস্থার স্থল বিচার বিভাগ। কিন্তু সরকার সেই বিচার বিভাগকেও দলীয় করেছে।
নিজেরা কিছু না করে বিচার বিভাগকে দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করিয়ে নিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়।
তিনি সামরিক বাহিনীতেও দলীয়করণ চলছে বলে অভিযোগ তুলে বলেন, তারা দলীয়করণ করে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
পিলখানায় হত্যাকাণ্ড : খালেদা জিয়া বলেন, পিলখানায় যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে, তা বর্বরোচিত। কিন্তু যারা আসল অপরাধী তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয় নি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামীতে এর সঠিক বিচার হবে।
সারা দেশে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল : খালেদা জিয়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা দেখিয়ে বলেন, এ সরকারের আমলে কেবল ঢাকায় ৫,৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে। সারা দেশে পাওয়া গেছে ১১,০০০-এর বেশি। একথা আমার নয়, এটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। এরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসের শিকার।
এ তথ্য আমাদের কাছে আছে।
রোড অ্যাকসিডেন্ট : খালেদা জিয়া বলেন, বড় বড় প্রকল্পে তারা ব্যর্থ। মহাসড়কে দুরবস্থা। মানুষ ঈদে বাড়ি যেতে পারে না। মহাসড়ক সংস্কারের নামে মন্ত্রী টাকা লুটপাট করছেন।
এটি তাদের দলের লোকেরা বলাবলি করছে। ঈদের দিনেও তাদের লোকেরা শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট করেছে।
সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করছে বলে অভিযোগ করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, সরকারের একটি ভোট ব্যাংক আছে। সেই ভোট ব্যাংক হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
‘৭২ থেকে ‘৭৫ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের সম্পত্তি, বাড়িঘর, জমিজমা ও মন্দির দখল করা হয়েছে। এসব এখনও চলছে।
জামায়াত ও আওয়ামী লীগ : খালেদা জিয়া বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে রাস্তায় মিছিল করতে দেয়া হয় না। কিন্তু কেন? জামায়াত কি এদেশে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল? জামায়াত এদেশের একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
তাদের মিছিল-মিটিং করার স্বাধীনতা রয়েছে।
তিনি আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, ’৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তো আপনারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। তখন মাওলানা নিজামী ও মুজাহিদকে পাশে নিয়ে বসতে পারলে এখন তারা স্বাধীনতা বিরোধী হয় কীভাবে? সেই সময় কি এই কথা মনে পড়ে নি?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালকে দলীয় ট্রাইব্যুনাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রহসন চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমিও চাই।
কিন্তু এ বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, সেটি দলীয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালের বিচার দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি অবিলম্বে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দলীয় ও জোটের সব নেতাকর্মীর মুক্তি দাবি করেন।
ইনডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক : খালেদা জিয়া বলেন, তিস্তার পানি আমাদের অধিকার। আর ট্রানজিটের নামে করিডোর তাদের (ইনডিয়ার) আবদার।
ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়া যাবে না। চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আগে দেখতে হবে এটি ব্যবহারের পরিবেশ আছে কিনা।
সীমান্তে প্রতিদিন নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা চলছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, কাটাতারের বেড়ায় ঝুলছে ফেলানীর লাশ। প্রধানমন্ত্রী সে বিষয়ে কথা বলার সাহস পান না।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয় নি। সেটি নিয়েও আলোচনা নেই। এভাবে নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ইনডিয়ার সঙ্গে কোনো বন্ধুত্ব চাই না। আমরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব চাই।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা : দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, তিন বছরে নতুন কোনো শিল্প স্থাপন হয় নি।
অনেক প্রতিষ্ঠান গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা (আওয়ামী লীগ) বলে বেড়াচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, যদি উন্নয়নই হয়ে থাকে তাহলে ব্যাংক থেকে প্রতিদিন একশ’ কোটি টাকারও ওপরে সরকার ঋণ নিচ্ছে কেন?
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থা : বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত র্যাব-পুলিশ সদস্যদের ট্রেইনিং না দেয়ার জন্য বিদেশি সংস্থাকে অনুরোধ জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশে কোনো কিছু গোপন থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমইউ আহম্মেদকে পুলিশ হেফাজতে টর্চার করে মেরে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি এসেছে পত্রপত্রিকায়।
কিন্তু এর কোনো বিচার হয় নি। অবশ্যই এর বিচার করতে হবে। চৌধুরী আলমকে র্যাব নিয়ে গেছে। এখনও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। কেন খুঁজে পাওয়া যায় নি, সরকারকে তার জবাব দিতে হবে।
তিনি বলেন, এসবের সঙ্গে জড়িত র্যাব-পুলিশ সদস্যদের ট্রেইনিং না দেয়ার জন্য বিদেশি সংস্থাগুলোকে আমি অনুরোধ জানাই। তারা ট্রেইনিং নিয়ে সেবা না করে জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়।
দেশের অবস্থা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ‘অশান্তি সৃষ্টি’ করছেন বলে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে এখন বিশ্বে শান্তির মডেল দিচ্ছেন। এটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর একটি রাজনৈতিক দল ৪০,০০০ মানুষ হত্যা করেছে।
তখন আপনার (শেখ হাসিনা) শান্তি প্রক্রিয়া কোথায় ছিল? ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দিনে-দুপুরে সবার সামনে লগি বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। হরতালের সময়ে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। আপনার শাসন আমলে অনেক মানুষ হত্যা-গুম করা হয়েছে। তখন আপনাদের শান্তি প্রক্রিয়া কোথায় ছিলো? একটার বদলের দশটা লাশ ফেলার ঘোষণা দিলে তো আর শান্তি তৈরি হয় না।
দেশের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলের সঙ্গে তুলনা করেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ১৯৭২-৭৫ সালের মতো লুটপাট হচ্ছে। বর্তমান সরকার লুটপাট করলেও তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। বিচার হবে কীভাবে? তারা বিচার বিভাগকে দলীয় করে রেখেছে। সেখানে গেলে আওয়ামী লীগ হলেই সব মাফ।
নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার শর্ত : খালেদা জিয়া বলেন, এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
পঞ্চদশ সংশোধনী অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের লক্ষ্যে বিরোধী দলীয় নেতা কয়েকটি দাবি উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রযেছে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, ত্রয়োদশ সংশোধনী পুর্নবহাল, সংবিধানে ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা, আলোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, গণভোট ব্যবস্থা পুনর্বহাল, সংবিধানের আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য কমানো, ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি (ইভিএম) বাতিল করা।
ঘোষিত কর্মসুচি : চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে মহাজোট সরকারের অবিলম্বে পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সারাদেশে জনমত গড়ে তুলতে সমাবেশে রোড মার্চের ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, ১০ অক্টোবর সিলেট অভিমুখে রোড মার্চের পরদিন ১১ অক্টোবর সিলেট জেলায় জনসভা হবে।
১৮ অক্টোবর রাজশাহী অভিমুখে রোড মার্চ হবে। সেদিন বগুড়ায় এবং পরদিন ১৯ অক্টোবর রাজশাহী জেলায় জনসভা হবে। সর্বশেষ রোড মার্চ হবে ২৫ অক্টোবর। এটি চট্টগ্রাম অভিমুখে শুরু হবে ঢাকা থেকে। সেদিন ফেনীতে জনসভা করে রাত যাপনের পরদিন ২৬ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রোড মার্চ শুরু করে সেখানে জনসভা হবে।
স্বল্পভাষী থেকে দীর্ঘভাষী
অলিখিত হওয়া সত্ত্বেও এবং নোটের প্রতি কদাচিৎ দৃষ্টিপাত সত্ত্বেও খালেদা জিয়া এই সুদীর্ঘ ভাষণে প্রায় সব পয়েন্টই কভার করেন। অল্পভাষী এই মহিলা দীর্ঘভাষীতে রূপান্তরিত হবার সময়ে পুনরুক্তি ছিল কম, তথ্য ছিল বেশি, প্রমাণ (নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ) ছিল হস্তগত, ভাষা ছিল সংযমী, প্রতিশ্রুতি ছিল পরিমিত, প্রতিপক্ষের সমালোচনা ছিল শালীন এবং আবেগ ছিল সংযত।
সেদিন কেউ কেউ ভেবে এসেছিলেন খালেদা জিয়া হবেন জংগি এবং ঘোষণা করবেন একটি জংগি কর্মসুচি।
কিন্তু বিরোধী নেত্রী সেটা করেন নি। তার এই ভাষণের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট।
অতীতে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার ৯৬ ঘন্টা হরতালের ডাক দিয়েছিল। খালেদা জিয়া কোন হরতালের ডাক দেন নি। এজন্য ভুক্তভোগী মানুষের ধন্যবাদ পেয়েছেন তিনি। ধারণা করা যায় এর ফলে তার তিনটি রোড মার্চ এবং সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, ফেনী ও চট্টগ্রামের পাচটি জনসভায় বিপুল জনসমাবেশ হবে।
বর্তমান ডাইলেমা
খালেদা জিয়ার বর্তমান ডাইলেমা হচ্ছে জংগি না হয়েও আন্দোলনের পথে মানুষকে ধরে রাখা এবং নেতা-কর্মীদের দমনপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করা।
তাকে অন্তত পক্ষে আরো দেড় বছর হয়তো এভাবেই চলতে হবে- যদি না আওয়ামী সরকার দেশকে আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যায়। তখন হয়তো সরকার পতনের লক্ষ্যে তীব্র আন্দোলন শুরু করতে হবে।
গণতন্ত্রে যারা বিশ্বাসী তাদের কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করতে দেয়া উচিত। যুক্তি স্বরূপ তারা বলেন, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
এই যুক্তির বিপরীতে কেউ কেউ বলেন, ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ (ওয়ান-ইলেভেনে) যখন মইন ইউ আহমেদের সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতাসীন হয় তখন এটা সুষ্পষ্ট হয়েছিল যে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাতে সমর্থন জানিয়েছিল।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমে যায়, দেড় বছরের মাথায় সেটা উবে যায় এবং দুই বছরের আগেই ওই সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
কারণ?
কারণ তারা সুশাসন দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়।
সুতরাং দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ সরকার গঠন করলেও সুশাসন দিতে ব্যর্থ হলে পাঁচ বছর আগেই তাদের বিদায় নিতে বাধ্য করাটি যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায় সঙ্গত।
ভবিষ্যতে খালেদা জিয়া এই যুক্তি গ্রহণ করতে পারেন। সেই অপশন তার খোলাই আছে।
তবে আপাতত তিনি এখনো আওয়ামী সরকারকে সময় দিচ্ছেন এবং এটিই শ্রেয়।
খালেদা জিয়ার ভাষণের দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট ছিল তিনি ইনডিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দও বলেন নি।
সুশাসন নির্বাসনে
তার ভাষণের তৃতীয় বৈশিষ্ট ছিল তিনি কোনো প্রতিশ্রুতি দেন নি যা বাস্তবায়িত করা অসম্ভব হতে পারে। তবে তিনি সুশাসন যে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন তারও কোনো ইঙ্গিত দেন নি। আওয়ামী সরকারের নেগেটিভ সাইডগুলো তুলে ধরছেন বটে, কিন্তু আগামী বিএনপি সরকারের পজিটিভ পদক্ষেপ বিষয়ে থেকেছেন নীরব।
তার ভাষণের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
ভাষণের শেষ দিকে আজান পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো অ্যান্টিক্লাইম্যাক্সে না গিয়ে খালেদা জিয়া তার ভাষণ চালিয়ে যান এবং অল্প কিছু পরে সমাপ্তি টানেন।
উজ্জীবিত, সংকল্পবদ্ধ ও আত্মবিশ্বাসী
উজ্জীবিত সাধারণ শ্রোতারা বাড়ি ফিরে যান আশা নিয়ে।
নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ফিরে যান আরো দৃঢ় সংকল্প নিয়ে।
আর খালেদা জিয়া?
তার ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। সেদিন নয়া পল্টনের জনসভা থেকে খালেদা জিয়া ফিরে গিয়েছেন এই লড়াইয়ে বিজয়ী হবার নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
শফিক রেহমান: প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।
(লেখাটি ইতিপুরবে দৈনিক নয়াদিগন্ত ও বিডিনিউজ২৪.কম-এ প্রকাশিত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।