Let the wind blow out the candles
বারের এককোণে রায়হানকে একা বসে থাকতে দেখে মো একটু অবাক হল। ট্যিপিকাল নার্ড বলতে যেমনটা বোঝায়, রায়হানের চেহারাটা তার চেয়েও একধাপ ওপরে। সামনের টেবিলের উচ্ছ্বল তরুণীদের হাতে ককটেলগুলো ধরিয়ে দিয়ে মো রুট বিয়ারের একটা ক্যান নিয়ে রায়হানের টেবিলে রেখে বললো, কি ব্যাপার রায়ান? আজ একাই এখানে?
রায়হানের কালি পড়া চোখের দৃষ্টির সাথে মো ভালভাবেই পরিচিত, প্রতিদিনই বারে আসা জীবনযুদ্ধে পরাজিত কিছু নেশাগ্রস্থ মানুষের চোখে এরকম দৃষ্টি থাকে। দীর্ঘরাত পর্যন্ত বারের এককোণে পড়ে থাকে তারা, পরেরদিন স্যাটেলাইট বুলেটিনে তাদের দু'একজনের মৃত্যুর খবরগুলো অবশ্য কারো দৃষ্টি কাড়ে না। আর যাই হোক, রায়হানের মত "জিনিয়াস" ছেলেপেলেদের এরকম ভেঙ্গে পড়া দৃষ্টির সাথে মো পরিচিত নয়।
বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে রায়হান তার বারে আসে, সম্ভবত: বাধ্য হয়েই। অন্যদের হাতে এলকোহলের মগগুলো ধরিয়ে দিয়ে মো রায়হানের জন্য বিটুমিন দেয়া নিরীহ শরবত বানিয়ে দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত থাকে তারা, প্রথমদিকে তাদের দৃষ্টি থাকে ব্লুবীকন ধারী কলগার্লদের দিকে, উচ্চস্বরে অসংলগ্ন ভাবে ক্যাম্পাসের নতুন মেয়েদের নিয়ে সরস মন্তব্য করতে করতে মো'র দিকে খালি গ্লাসগুলো বাড়িয়ে দেয়। মো গ্লাসগুলোতে পানীয় ভরতে ভরতে তাদের আলোচনার বিষয়ও বদলে যায়, নতুন আসা প্লাজমা ওয়েজার (নির্ঘন্ট দ্রষ্টব্য) , সাড়ে তিন সেন্টিমিটারের পাওয়ার প্রসেসর, কিংবা বায়ো চ্যানেলে অবৈধ হরমোনের কেনাবেচার আলাপ শেষে গিয়ে ঠেকে কে কাকে খুন করে প্যাটেন্ট বাগিয়ে নেবে সেই আলাপে, তবে রায়হান কখনোই মাতাল হয়না। বন্ধুদের বাসায় পৌছে দেবার দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয় কিনা।
মো'র দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রায়হানের চোখগুলো জ্বলে উঠলো, মো উচুমাত্রার জিরাক্স দিয়ে একটা ড্রিংক বানিয়ে দেবে?
রায়হানের চোখে তাকিয়ে মো হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেল, সেখানে পরাজিত মানুষের দৃষ্টি নেই, তবে উন্মাদনার এক দৃষ্টি খেলা করছে। যে চোখের দিকে তাকালে যে কেউই চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
২
কষ্ট করে চোখ খুলে রায়হান ঘড়ির দিকে তাকালো। কিছু একটা ঠিক নেই, মাথার বামপাশে একটা শিরা দপ দপ করছে, পেটে ভয়ানক ক্ষুধা, কতক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিলো? রাতে বার থেকে কিভাবে বাসায় ফিরে এলো সে নিয়েও কোন ধারণা নেই, মো হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করে থাকবে। কাউচ থেকে উঠতে গিয়ে গিয়ে অসাবধানে পা লেগে কিছু একটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল, রায়হান মেঝেতে তাকিয়ে দেখে নিতুর জন্য কেনা প্রাচীন ফুলদানীটা।
যে উপহারটা কেনার জন্য তাকে একমাস তেরো দিন বিলাসিতাকে বিদায় জানিয়ে কৌটোর খাবার খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেই ফুলদানীটা কখনোই নিতুকে আর দেয়া হবে না, নিতুকে কতটা ভালবাসে সেকথাটাও আর কখনো হয়তো বলা হবে না! মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসহায় কাচগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে রায়হান......কোনটা বেশি স্বচ্ছ, প্রাচীন মায়ান সভ্যতার কাচগুলো, নাকি তার চোখের হিউমার? নিতুর কাছে যে তার চোখের লোনা পানির দাম নেই, সেটাতো সে কাল রাতেই জেনেছে! কারণ নিতু যখন রায়হানের দেয়া প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বললো, রাজেশ কে ছাড়া আর কারো কথা সে ভাবতে পারছে না, তখনোতো রায়হানের চোখে অশ্রু ছিল! দুর্ভাগ্যবশ:ত, সেটা নিতুর কাছে তেমন মূল্যবান কিছু মনে হয়নি।
মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাচগুলোতে রায়হানের জ্বলজ্বলে চোখগুলো অনেক বেশি উজ্জ্বল লাগছিল।
৩
সময় গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, বিকেল থেকে সন্ধ্যার আলো নেমে এসেছে। দিনের এসময়টা রায়হান বেডরুমে কাটায়, যে বেডরুমের দেয়াল সে ছেয়ে ফেলেছে নিতুর আকা অসংখ্য ছবি আর প্রোট্রেট দিয়ে।
নিতুর ফটো এক্জিবিশনের রায়হান প্রথম শ্রেণীর ক্রেতা। মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হয়, নিতু নাকি তার আকা ছবি তার কাছে বেশি প্রিয়? নিতু অবশ্য কখনোই রায়হানের কাজের ওপর আগ্রহ দেখায়নি। আগ্রহী হলে সে হয়তো জানতে পারতো, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান পরিষদের বর্ষসেরা তরুন বিজ্ঞানীর সম্মাননা হয়তো এবার রায়হান পেতে পারতো। রায়হান কাজ করছে মানুষের বিশেষ বিষয়ে পারদর্শীতার সাথে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের সংশ্লিষ্টতাকে নিয়ে। রায়হানের রিসার্চ গ্রুপ, তাদের গবেষণায় এতটাই পজেটিভ ফলাফল পেয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার সাহায্যে সাড়ে তিন মিলয়ন অতিরক্ত ইউনিট সরবরাহ করছে।
রায়হানের গবেষণা অনুযায়ী, মানব মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষের পারদর্শীতা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন কেউ হয়তো কোন একটা গেইম অন্যদের চেয়ে খুব দ্রুত এবং ভালোভাবে খেলছে। রায়হানদের রিসার্চ গ্রুপের গবেষণা অনুযায়ী, ঐ বিশেষ গেইম টা খেলার সময় মস্তিষ্কের একটা নির্দিষ্ট অংশে নির্দিষ্টনিউরন গুলো বারবার অনুরণিত হয়, আর সংশ্লিষ্ট স্মৃতি সংরক্ষণ করে। গবেষণা সফলভাবে উচু বুধ্ধিমত্তার স্তন্যপায়ীদের মাঝে করা হয়েছে, আর সেগুলো প্রায় সফল। গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আর কয়েকটা অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারলেই মানব মস্তিষ্কের ওপর সফলভাবে সিদ্ধান্তে আসা যেত।
কিন্তু এখন কি আর সেটা হবে?
না। রায়হানের মনোযোগে এখন বিজ্ঞান নেই, গবেষণা নেই। আছে মো'র বার থেকে আসা উচুমাত্রা জিরাক্স দেয়া উত্তেজক পানীয়তে। বিছানায় শুয়ে সে সিলিং এ ভেসে থাকা নিতুর আকা ছবিটার হলোগ্রামের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিদিন সে কাজ শুরু করে নিতুর আকা ছবিগুলো দেখতে দেখতে, নিতু আকে অসাধারণ, ছবিগুলা একবার না দেখলে রায়হানের কাজে মন বসে না।
কে জানতো তার প্রতি নিতুর আগ্রহ শূণ্যের কাছাকাছি! নিতুর সমস্ত আগ্রহ জুড়ে আছে ভার্সিটির ব্যান্ডের চুল লম্বা গীটারিস্ট ছেলেটা - কি নাম যেন, রাজেশ, হ্যা সেই রাজেশ। নিতু নাকি প্রতিট বিকেলে রাজেশের সাথে অবজারভেশন টাওয়ারে গিয়ে গীটারের টুংটাং শুনে। কি আছে এই গীটারে? লাউজি গিটার! দাতে দাত চেপে করা রায়হানের ক্রোধোক্তিটা ঘরের কোণে পড়ে থাকা গিটারটা শুনতে পেল না যদিও। হ্যা, মিউজিকের প্রতি নিতুর আগ্রহ দেখে রায়হান চেষ্টা করেছিল গিটার শেখার, লাভ হয়নি। সবকিছু সবার জন্য নয়।
কিছু প্রতিভা মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নিয়ে আসে।
রায়হানের রিসার্চ গ্রুপের একজন, ভিকি, রায়হানকে ভয়ে ভয়ে একুশ নাম্বার ফোনটা করলো। নিতুর সাথে ছেলেটার কাহিনী সে এর মাঝেই জেনেছে, বাকি বিশটা কলের মত এই কলটাও রায়হান ধরবে না এরকম আশাই করেছিল, নিজের রিসার্চ নিয়ে নাক উচু রায়হান এমনিতেই তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয়না, নেহায়েত একই রিসার্চ গ্রুপে পড়ে যাওয়াতে এখন তার কথা মাঝে মধ্যে শোনে। কলটা কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু দেখাগেল শেষ মুহূর্তে রায়হান ফোনটা ধরলো।
রায়হান, আমি অনেক দু:খিত, তোমাকে কি বলবো ভাষা খুজে পাচ্ছি না ... ভিকি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল, রায়হান তাকে থামালো।
ভিকি একজন ভেঙ্গে পড়া মানুষের কন্ঠস্বর আশা করছিল কিন্তু রায়হানের কন্ঠে যেন অন্যরকম একটা তারুণ্য, "ভিকি আমাদের গবেষণা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। "
পরের পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।