www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
স্ব-দেহে তিলেতিলে বেড়ে উঠা জীবন অনুভব করতে কেমন লাগে?
বারান্দার ঠিক এই জায়গাটায় বসলে এক পশলা বৃষ্টি-সিক্ত মানিপ্ল্যান্টের সবুজ গন্ধ আর ছোট্ট টবের ভেজা মাটিতে দণ্ডায়মান রুক্ষ ক্যাকটাসের তীক্ষ্ণ ইশারার খোঁচা খেতে খেতে চোখ চলে যায় পাশের বাড়ির জানালায়। অকপট খোলা জানালা। বৃষ্টিভেজা শীতল বাতাসে পর্দা উড়ছে। কালো লোহার গ্রীল চুইয়ে ছিটেফোঁটা জলের অস্তিত্ব। জানালার পাশের দেয়ালের প্রসারমান অংশে অন্দরমহলের অলক্ষ্যে বাসা বেঁধেছে এক সব্যসাচী চড়ুই।
নিত্য তার ব্যতিব্যস্ত আনাগোনা। বহির্জগতের কুটিল চক্ষুর অন্তরালে নিরাপদে অবস্থানরত দুটি সাদাটে পদার্থের আয়ুরেখা নিশ্চিতকরণে সদা তৎপর তার চঞ্চু। তুচ্ছ খড়কুটোর অভ্যন্তরে ক’দিন পরই উঁকি দেবে জীবন। মেতে উঠবে কোলাহলে। মহাকাল দেখবে আরও এক অদ্ভুতুরে ঘটনা।
শুনবে জীবন-স্পন্দন। গাইবে জীবন-গান। তবে আপাততঃ নিশ্চুপ পাখির বাসা। আসন্ন নবীনের আগমনবার্তায় সজাগ চারপাশ। অতন্দ্র বাতাস।
মুহুর্মুহুঃ চাপা উৎকণ্ঠা।
বিকেলের নম্র আলোয় আজ বারান্দার ঠিক এখানে বৃষ্টিভেজা বেতের চেয়ারে বসে আনমনে কুঞ্চিত হস্তরেখায় আঙুল বুলোতে বুলোতে মনে পড়ছে অন্য কোন এক খোলা জানালার কথা। কোন এক উড়ন্ত পর্দার কথা। কোন এক অশরীরী ছায়ার কথা। কতদিন আগে! মনে নেই।
শুধু মনে আছে এক মানবীর পায়চারি। তার গুন্গুন্। তার নিখাদ কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি। সুরেলা স্বরতন্ত্রী।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
আজ জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে জীবনবোধের অভাববোধ হচ্ছে বড়! বিকেলের এক চিলতে রোদের উষ্ণতার জন্য বড্ড আইঢাই করে মন। হাড় বুড়িয়ে গেছে। খুঁজে ফেরে উত্তাপ। টানটান চামড়া ছেড়েছে তার উত্তেজনা। হয়েছে শিথিল।
পাশে পড়ে থাকা কাঠের দণ্ডটির প্রতি জন্মেছে অনুরাগ। গুনতে থাকা হৃৎকম্পন হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে উঠে হারিয়ে যাওয়া স্পন্দনে। চোখের তীক্ষ্ণতা হার মেনেছে। সদা কম্পমান অঙ্গুলী কোন নির্দিষ্ট দিকচিহ্নিতকরণে অক্ষম। পুরোনো কলসির তলায় পড়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে যক্ষের ধনের মতন আগলে রাখতে চায় বৃদ্ধ-অভিজ্ঞ স্নায়ুকেন্দ্র।
কলসির গায়ে শুধু এক মহাকালিক রন্ধ্র। সাদাটে অতীত। চিরচেনা দেহখানি হঠাৎ বড্ড অচেনা মনে হয়। মনে হয়, এই তো! এই তো আমার ডানহাতের কব্জীর কাছের চামড়ার ঐ ভাঁজখানি আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। ভুলে গেছি বাম তালুর উপর এক সাদাটে দাগের অতীত-কাহিনী।
তবে বৃষ্টিভেজা এই সন্ধ্যালগ্নে কিছু বর্ণীল মুহূর্ত পিছু ছাড়ছে না। ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে কিছু। তারপর পালিয়ে যাচ্ছে নিমেষেই। হ্যাঁ, কোন এক খোলা জানালা।
কোন এক উড়ন্ত পর্দা। কোন এক মানবীর পায়চারি। তার আনমনে গেয়ে যাওয়া গান।
জীবন-গান। জন্ম-গান।
ছানি পড়া অস্পষ্ট এই দুচোখ বন্ধ করলে আমার মানসপটে আজও ভেসে উঠে সেই দৃশ্য। হতে পারে অতীব সাধারণ। হতে পারে সাদামাটা। কিন্তু তিল-তিল করে বেড়ে উঠা ভ্রূণের প্রতি এক জননীর মৃদু কথোপকথন আমাকে মনে করিয়ে দেয় কী ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ এক একটি জন্ম! কী দেদীপ্যমান মৌলিকতায় আচ্ছন্ন প্রতিটি জন্ম-কান্না! মনুষ্য-জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগোচরে নীরবে প্রস্তুতি নেয় মহাকাল। প্রস্তুতি নেয় প্রসব-মুহূর্তের।
শত-সহস্র আলোকবর্ষ দূরের কোন এক নক্ষত্রের বিস্ফোরণ অর্থহীন হয় না আর। নৈরাশ্যবাদীদের অণ্ডকোষে লাথি মেরে জীবন হয়ে উঠে পরিপূর্ণ। সবকিছুই সেই নীরব ভ্রূণের অবদান। প্রায়োগিক জীবনে অভ্যস্ত, জীবন সায়াহ্নে দাঁড়ানো, জীবন-রহস্যের খোঁজ পাওয়া হতাশ এক বৃদ্ধ এই আমি আজও বুঝতে চাই। আজও বুঝতে চাই স্ব-দেহে তিলেতিলে বেড়ে উঠা জীবন অনুভব করতে ঠিক কেমন লাগে! আমি জানি, এ এক সাধ্যাতীত ব্যাপার।
শুধু আমার বিস্ময়াপন্ন কানে এখনও বেজে উঠে কোন এক মানবীর আনমনে গেয়ে যাওয়া গান। একাকী এলোমেলো পায়চারি। তার অন্তঃসত্ত্বা কণ্ঠ জন্ম দিচ্ছিলো কী এক অপার্থিব ঐকতান!
তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত,
তোরই জন্য গল্প বুনেছি কত কত
তোরই জন্য গান
তোকে ঘিরে এই খেলা
তোকেই দিচ্ছি
আমার সকাল ছেলেবেলা।
তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত।
নিজ দেহে অন্য এক সত্তার অস্তিত্ব! নক্ষত্রের ধুলো থেকে জন্ম নেয়া এই জগতখানিতে মানবজনম কার কাছে ঋণী? কে বিধাতা?
মানবী গেয়েই চলেছিলো, আর মাটির ঘরের বাইরে এক খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে আমি শুধু দেখছিলাম।
আমি দেখছিলাম এক সহধর্মিণীর একাকী অনুভূতি। চুপচাপ। মুগ্ধ বিস্ময়ে।
তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত।
তোরই জন্য গল্প বুনেছি কত কত!
তোকে দেবো আমি আমার টিনের চাল বাড়ি
তোকে দেবো দ্যাখ আমার পাহাড় সারি সারি
তোকে দিয়ে দেবো
ইস্কুল পথে বাঁকে পাওয়া ফ্রক...
মানব এখানে উপলক্ষ মাত্র।
তুচ্ছ।
শুধু গত হাটবার থেকে আমার এনে দেয়া ঐ লাল চিরুনি, রাঙা ফিতে। নতুন গল্পের বই। আর ঐ আচারের বয়ামখানি। ওগুলো অপাংক্তেয় নয় মোটেই!
টক নুন টক
তেঁতুল আচার আছে রাখা
তোরই জন্য
আমার বয়ামে তেলে মাখা
তোকেই দিচ্ছি
জল ছপছপ ভেজা জুতো
স্কুলে না যাবার
আমার পুরোনো সেই ছুঁতো আমার।
গল্প বইয়ের মলাট পাতা খুলে
তোরই জন্য শব্দগন্ধ রাখি তুলে।
নারী অনুভূতি। এক অনন্য মনুষ্য-অস্পষ্টতা। যার গুপ্তদ্বারে স্বয়ং মহাকালও বুঝি অপেক্ষমাণ!
তোকে ভাগ দিই
আমার বড় হবার ব্যথা,
তোকে বলে দেবো
আমার গোপন যত কথা,
এই সব আমি
তোকেই দেবো, তোকেই দেবো
তোর ছেলেবেলা
তোর কাছে থেকে চেয়ে নেবো।
কি সেই ব্যথা? কি সেই বড় হওয়ার পীড়ন? কি সেই গোপন কথাগুলো? যৌগিক ও দুর্বোধ্য।
নিশ্চুপ থাকুক বরং বিশ্বচরাচর। ছেলেবেলা-মেয়েবেলা-মনুষ্যবেলা। শুধু নারী-অনুভূতিগুলোর পরতে পরতে জমে থাকা গোপন সব কথা, বড় হবার সব ব্যথা এক জননী জানিয়ে দিক তার ঔরসজাত সন্তানকে। মহাকাল তুমি কান পেতো না! গর্ভধারিণীর মানস বোঝার উপযোগিতা তুমি অর্জন করোনি এখনও!
আজ এই মুহূর্তে, এই বৃষ্টিভেজা বেতের চেয়ারখানিতে বসে কুঁচ্কে যাওয়া চামড়ার প্রণোদনায় বৃদ্ধ এক আমি ফিস্ফিসিয়ে বলে উঠি, জীবন এক খোলা খাতা আমার কাছে, যার পাতা উল্টিয়ে আমি আজ শেষ অধ্যায়ে। জীবনের অনেক পাতার কোন অর্থ আমি পাইনি।
পারিনি কোন কোন পাতার হিসেব মেলাতে। তবু কী এক নেশায় আমি পাতা উলটানো থামাইনি। আমি শুধু অপেক্ষায় সেই মুহূর্তটির যখন আমার কোলের উপর শুয়ে থাকা খোলা জীবন-বইটি বন্ধ হবে। আর আমি ধুলো-পড়া ধূসর মলাটে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে তাকাবো কোথাও। তাকাবো শূন্যে।
কিংবা হয়তো অসীম এক দেয়ালের তাক-ভর্তি অসীম সংখ্যক বইয়ের সমারোহের দিকে। আমি অবাক হবো না কিছুতেই। মৃত্যু-রহস্য উন্মোচিত হলেও এক অজানা রহস্যের সন্ধানে এই ক্ষয়িষ্ণু সন্ধ্যালগ্নের এক বৃষ্টিস্নাত মুহূর্তে আমি তাই আজও ফিরে যাই এক খোলা জানালায়। এক এলোমেলো পায়চারিতে। এক চিরচেনা মানবীর অচেনা কণ্ঠস্বরের রহস্যময় শব্দধ্বনিতে।
তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত,
তোরই জন্য গল্প বুনেছি কত কত।
এত সরলতায় এত যৌগিকতা!
এত রহস্য!
জন্ম। আজ বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায় জীবনের শেষ-পৃষ্ঠায় তুমি মৃত্যুকে করেছো জয়।
উৎসর্গ : মানবী। প্রজ্ঞার অধিকারিণী একজন মানুষ।
অনুপ্রেরণাদাত্রী। :-)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।