সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
১২ ফেব্রুয়ারি, কোনো এক শনিবার সন্ধ্যায়, টিভি চ্যানেলগুলো ব্রাউজ করতে করতে, চ্যানেল আইতে একটা লাইভ প্রোগ্রামে নজর দিতেই দেখলাম, এক সুন্দরী প্রতিযোগিতা সেটা। একজন নারী-এ্যাঙ্কর দর্শকদেরও রায় নিচ্ছেন, কে হবেন সেরা সুন্দরী। বিরাট দর্শকসমাগম, দর্শকদের খানিক মতামত নিয়ে অবশেষে একজনকে সেরা সুন্দরী ঘোষণা করা হলো, বিজয়-মুকুট পরিয়ে দেয়া হলো। এখন তো ট্যালেন্ট হান্ট আর বিউটি কনটেস্টের ছড়াছড়ি --সুপারস্টার, ফটোজেনিক -- এরকম নানা নামে বিউটি কনটেস্ট চলছে। এসব আয়োজনে থাকে কোনো একটা মিডিয়া হাউস, সঙ্গে থাকে একটা কর্পোরেট ব্র্যান্ড, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে থাকে একটা মার্কেটিং কোম্পানি।
যেমন সবচেয়ে আলোচিত ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতায় যুক্ত থাকে ইউনিলিভার, চ্যানেল আই ও এশিয়াটিক মার্কেটিং লি.। ইহা কোন প্রতিযোগিতা, এরকম আগ্রহ থেকে একটু মনোনিবেশ করলাম। নির্বাচিত সেই সুন্দরী হলেন সেরা আদিবাসী ‘'প্রিয়দর্শিনী'। সুন্দরীর টাইটেল বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, তিনি প্রিয়দর্শিনী কিন্তু আদিবাসী! যাহোক এসব প্রতিযোগিতায় যেহেতু আগ্রহ ও আকর্ষণ কম থাকে আমার, তাই অন্য কোনো চ্যানেলে লাফ দিলাম। লাফিয়ে লাফিয়ে ক্লান্ত হয়ে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে টেলিভিশন বন্ধও করলাম।
তবে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আমার আগ্রহ কম থাকলেও, এর পেছনের রাজনীতিকে বুঝতে অনাগ্রহ নেই আমার। তাই টেলিভিশন বন্ধ করার পরও সেদিন রাতে ঘুমাবার এবং পরদিন মাঝে মাঝেই মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল যে, আদিবাসীদের মধ্য থেকেও সেরা সুন্দরী নির্বাচনের প্রয়োজন কেন পড়ে? পরদিন সকালে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম দেখলাম: 'আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের নাচে-গানে মুখরিত সৈকত'’। সেই প্রতিবেদনে অবশ্য আদিবাসী 'প্রিয়দর্শিনী' সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া গেলনা। জানা গেল, সেটা ছিল মূলত আদিবাসী মেলা। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও চ্যানেল আইয়ের যৌথ উদ্যোগে এই আয়োজন ছিল দ্বিতীবারের মতো।
২০০৯ সালে প্রথম আদিবাসী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা ঐ মেলায় অংশ নেয় এবং ‘নাচে-গানে' সৈকত 'মুখরিত’ হয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান, চ্যানেল আইয়ের শীর্ষ দুই কর্তা ব্যক্তি, স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘এক্সোটিক ডেস্টিনেশন’ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আদিবাসীদের এই সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশকে সাদা চোখে সদর্থক দৃষ্টিতে দেখার বিস্তর সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু দু’টি বিষয় আমাকে আরও ভাবিয়ে তোলে, ইস্যুর গভীরে নামতে উস্কে দেয় -- প্রথমত, ঐ প্রশ্নটি মনে ঘুরপাক খায় যে কেন আদিবাসীদের মধ্য থেকেও সুন্দরী বাছতে হয় এবং দ্বিতীয়ত, দুই কলামের আদিবাসী মেলার সংবাদের পাশেই প্রথম আলোতে প্রকাশিত আরেকটি এক-কলাম সংবাদ: ‘মন্ত্রণালয়ের গোপন চিঠি: উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতা চলছে’। কী আছে ঐ এক-কলামের সংবাদে? সেখানে বলা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্রসচিব ও তিন পার্বত্য জেলা প্রশাসককে দেওয়া গোপন চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘উপজাতীয় কতিপয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি সাংবাদিকেরাও ইদানীং উপজাতীয় স¤প্রদায়গুলোকে উপজাতি না বলে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করছেন। বিভিন্ন এনজিও, বিদেশি সংবাদমাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিস্টান রাষ্ট্রসমূহ ঐ ব্যক্তিবর্গের সহাযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে’ (প্রথম আলো, ১৩ ফেব্র“য়ারি, ২০১০, পৃ ২১)।
আদিবাসী মেলার সংবাদের একেবারে পাশ ঘেঁষে প্রকাশিত এই সংবাদ দগদগে বৈপরীত্য নিয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়। এই ‘গোপন সংবাদ’ আমাদের অবহিত করছে সরকার ও আমলাতন্ত্র আদিবাসীদের কী দৃষ্টিতে দেখে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার ও তার আমলাতন্ত্র সংখ্যালঘুদের সাধারণ নাগরিকের স্বীকৃতি দিতে কীরকম সংরক্ষণবাদী তা স্পষ্ট হয় এই সংবাদে। ১৯৯৭ সালের চুক্তির ন্যূনতম বাস্তবায়ন এত বছরেও কেন হচ্ছে না, তারও একটা ব্যাখ্যা এই মানসিকতার প্রকাশের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকারের অবস্থান তেমন হেরফের হয়না। কিন্তু সেই সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান পর্যটন করপোরেশন যখন আদিবাসী মেলায় যুক্ত হয়, তখন এটাও স্পষ্ট হয় যে এটা কোনো আদিবাসী-দরদী অনুষ্ঠান নয়, বরং আদিবাসীদের জাতিবৈচিত্র্য, তাদের নৃত্য-গীত, তাদের জীবন-যাপন-সংস্কৃতি এখানে ‘এক্সোটিক কমোডিটি’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশি-বিদেশি সম্ভাব্য-পর্যটকদের কাছে। চ্যানেল আইয়ের পৌরহিত্যে আদিবাসী 'প্রিয়দর্শিনী’ বাছাবাছিও, সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে প্রাথমিক যে অভিযোগ -- নারীকে পণ্যকরণ -- তার সঙ্গে বাড়তি মাত্রা নিয়ে হাজির হচ্ছে।
একে বলা যায় আদিবাসী নারীর পণ্যকরণ হিসেবে। দ্বিস্তরের এই পণ্যকরণ প্রক্রিয়ায় চ্যানেল আই ও পর্যটন কর্পোরেশন উভয়কেই দায়ী করতে হয়। তবে প্রথম স্তরের পণ্যকরণ প্রক্রিয়া, সুন্দরী-প্রতিযোগিতা নিয়ে আরেকটু বিশদ বাগবিস্তার ঘটাতে চাই।
১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক সিটির হোটেলসমূহের কর্তৃপক্ষরা হোটেলগুলোতে ভ্রমণকারীদের আরও অধিক সময় আটকে রাখার মার্কেটিং উপায় হিসেবে মেয়েদের সুইমস্যুটনির্ভর একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এটাই সুন্দরী প্রতিযোগিতার আদি নিদর্শন।
এরপরে নারীর সৌন্দর্য ও শরীরনির্ভর প্রতিযোগিতার বুম হয়। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা হতে থাকে। এরপর একে একে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয় মিস ওয়ার্ল্ড (১৯৫১ সালে), মিস ইউনিভার্স (১৯৫২ সালে), মিস ইন্টারন্যাশনাল (১৯৬০ সালে) নামে। এইসব বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য জাতীয় প্রতিযোগী নির্বাচনের জন্য আবার জাতীয় পর্যায়ে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা হয়, ভারতে যেমন আছে ‘ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া’। তবে মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্সের জাতীয় প্রতিনিধি নির্বাচনই তো মূল কথা নয়, পণ্যের প্রসার-প্রচারের জন্য কর্পোরেশনগুলোর প্রতিনিয়ত দরকার হয় সুন্দর দেহের নতুন নতুন নারীমুখ, এজন্য নিয়মিতভাবে এইসব প্রতিযোগিতার আয়োজন চলে।
একই নারী(দেহ) র্যাম্প, সিনেমা, সিরিয়ালে যুক্ত হয়ে তারকা-ইমেজ বলবৎ রাখে এবং পণ্যের মডেলিং-এ নারীর বিক্রিমূল্য অটুট রাখে। তাই ‘ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া’ ছাড়াও আমরা দেখি ‘সানন্দা তিলোত্তমা’ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে যেমন রয়েছে ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার’ প্রতিযোগিতা। আগেই বলেছি যে এইসব প্রতিযোগিতায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে একটি মিডিয়া হাউস। ফেমিনা হলো ভারতের অন্যতম বৃহৎ টাইমস অব ইন্ডিয়ার অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান।
এইসব সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজকরা ‘নারীকে বস্তুকরণ’-এর অভিযোগ এড়াতে অন্তঃত দু’টি বিষয় সামনে এনে অভিযোগের ঘায়ে মলম দিতে চায় -- প্রথমত, এটি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটায়; দ্বিতীয়ত, এখানে দৈহিক সৌন্দর্যই মূলকথা নয়, তার বুদ্ধিমত্তা বা ট্যালেন্টই তাকে জিতিয়ে দেয়। এই আলোচনায় ফিরে আসা যাবে, তার আগে আমি সুন্দরী প্রতিযোগিতার পেছনের যে রাজনৈতিক-অর্থনীতি, সেদিকে আলোকপাত করতে চাই।
ভারতীয় নারীরা একসময় বিশ্বসুন্দরীর খেতাব পাওয়া শুরু করেন এবং পেতেই থাকেন। এযেন সুন্দরী হবার জোয়ার, ভারতীয় নারীরা হঠাৎ করে যেন সুন্দরী হয়ে গেছেন। ১৯৯৪ সালে সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হন এবং ঐশ্বরিয়া রাই মিস ওয়ার্ল্ড হন।
এরপর ডায়ানা হেইডেন মিস ওয়ার্ল্ড হন ১৯৯৭ সালে। যুক্তা মুখী মিস ওয়ার্ল্ড হন ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালে মিস ইউনিভার্স হন লারা দত্ত এবং মিস ওয়ার্ল্ড হন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। ১৯৯৪ সালের আগে একমাত্র ভারতীয় বিশ্বসুন্দরীকে (রিটা ফারিয়া) দেখা যায় বহু পূর্বে ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৬-১৯৯৪ সময়কালে, ২৮ বছরে কোনো ভারতীয় বিশ্বসুন্দরী পয়দা হননি, কিন্তু ১৯৯৪-২০০০ সময়কালে, ৬ বছরে আমরা পাচ্ছি ৬ জন বিশ্বসুন্দরীকে।
আবার ২০০০ সালের পর থেকে ৯ বছরে আর একজনও বিশ্বসুন্দরীর খেতাব পেলনা ভারত থেকে।
নব্বই দশকে ভারতে বিশ্বসুন্দরীদের এই সমাগমের পেছনের রাজনৈতিক-অর্থনীতি হলো, নরসীমা রাওয়ের সরকার থেকেই একসময়ের-সোভিয়েত-ঘেঁষা ভারত অর্থনৈতিক উদারীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া তাতে বহু-ভোক্তার দেশ ভারত একটা বিরাট বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই বাজারে মাল বেচতে প্রয়োজন একগুচ্ছ সুন্দরী, যারা পণ্যের বহিরঙ্গের পণ্য হিসেবে বিকোবেন। সেই সুন্দরীকে হতে হবে অবশ্যই স্থানীয় -- থিঙ্ক গ্লোবালি, এ্যাক্ট লোকালি -- এই সমীকরণে।
আর এক ভারতীয় বিশ্বসুন্দরী দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল বাজারে প্রবেশ সম্ভব। সুস্মিতা-ঐশ্বরিয়া-প্রিয়াঙ্কা তো কেবল ভারতীয় আইকন নন, তারা দক্ষিণ এশীয় আইকন হয়ে ওঠেন বিশ্বসুন্দরী খেতাব পাবার সঙ্গে সঙ্গে।
আরেকটি মজার রাজনীতি হয়েছে মুসলিম দুনিয়া নিয়ে। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত মুসলিম দেশগুলো থেকে বিশ্বসুন্দরী দেখা যায়না। তবে ২০০১ সালে টুইন-টাওয়ারে হামলার পরে যখন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মুসলিম-আইডেন্টি একটা রেসিস্ট্যান্স বা বিরোধী-পক্ষ হিসেবে হাজির হয়, তার ঠিক পরের বছরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি মুসলিম দেশগুলো থেকে বিশ্বসুন্দরী খেতাব দেয়া হয়েছে।
২০০২ সালে মিস ওয়ার্ল্ড হন তুরস্ক থেকে এবং মিস ইন্টান্যাশনাল হন লেবানন থেকে। ব্যাপারটা কাকতালীয় ভাবলে ভুল হবে। বরং শত্রুপক্ষীয় রক্ষণশীল মুসলিম দেশগুলোর সংস্কারে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট খোলাপোশাকের একজন স্বদেশী বিশ্বসুন্দরী। আবার সেই সুন্দরীর মাধ্যমেই পণ্য ও ভোক্তাসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ নিরবে মুসলমানদের 'রক্ষণশীলতা' নষ্ট করা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কড়া সমালোচক, লাতিন আমেরিকার নেতা, সমাজতন্ত্রী হুগো শভেজের দেশ ভেনেজুয়েলা থেকে বেশ কিছু বিশ্বসুন্দরী নির্বাচনের পেছনেও রয়েছে প্রায় একই রকম রাজনীতি।
২০০৮ ও ২০০৯ সালের মিস ইউনিভার্স, ২০০৩ ও ২০০৬-এর মিস ইন্টারন্যাশনাল নির্বাচিত হয়েছেন ভেনেজুয়েলার প্রতিনিধি। ২০০৩ সালে চীন থেকে মিস ওয়ার্ল্ড একই রাজনীতির আওতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাই বলা যায় ‘সৌন্দর্য ও ট্যালেণ্টের সমন্বয়’-এর আপ্তবাক্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। বরং বিশ্বায়নকালে মুক্তবাজার অর্থনীতির দূত হিসেবে এইসব সুন্দরীদের নির্বাচন করা হয়, এবং মোটামুটি হিসেব কষে সুন্দরীদের মুকুট ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। এমনকি বর্ণবাদী এই প্রতিযোগিতা শ্বেতাঙ্গ বা বাদামি-ফর্সা সুন্দরীদের অবশ্যম্ভাবী বর্ণ হিসেবে একটা মানদণ্ড ঠিক করে দেবার পরও মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম ঘটানো হয়, ‘কালোদের-জন্য-একজন-এ্যাম্বাসেডর’ খোঁজার স্বার্থে।
এই বিবেচনাতেই ২০০১ সালে নাইজেরিয়া থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে দেয়া হয় মিস ওয়ার্ল্ড-এর খেতাব। একই বিবেচনায় আমাদের দেশে আয়োজন করা হয়েছে আদিবাসী 'প্রিয়দর্শিনী’ প্রতিযোগিতা, যে-প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কথা আমি এই রচনার শুরুতেই বলেছি। অর্থাৎ আদিবাসীদের মধ্য থেকেও একজন সুন্দরী বেছে নেয়া, যাকে দিয়ে পণ্যের প্রমোশন করা যাবে এবং আদিবাসীদের কাছে পণ্যের বার্তা নিয়ে সহজে পৌঁছা যাবে। কেবল বর্ণ নয়, সব বয়সের প্রতিনিধিও খোঁজার দৃষ্টান্ত রয়েছে। একবার আমাদের দেশেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল চল্লিশোর্ধ নারীদের প্রতিযোগিতা।
স্মৃতি প্রতারক না হলে, সেই প্রতিযোগিতার নাম ছিল ‘প্যান্টিন ইউ গট দ্যা লুক’। এই হলো ভোক্তা-সংস্কৃতির নমুনা। তুমি মুসলিম হলেও মডেলিং করো, না হয় পোশাকটা একটু লম্বাই রাখো। তুমি একটু বয়েসী হলেও সেজেগুজে প্রতিযোগিতায় নামো। তুমি আদিবাসী হলেও র্যাম্পে আসো।
এবার আসা যাক নারীর ক্ষমতায়ন ও সুন্দরী একইসঙ্গে ট্যালেন্টও -- এই ধারণার আলোচনায়। নৃবিজ্ঞানী সুসান রাঙ্কল (রাঙ্কল, ২০০৪) গবেষণা করেছেন মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার পূর্বে নির্বাচিত ২৬ জন প্রতিযোগীর জন্য আয়োজিত প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া নিয়ে। তিনি লক্ষ করেছেন নির্বাচিত ২৬ জনকে যেভাবে ঘষেমেজে সম্ভাব্য মিস ইন্ডিয়া বা মিস ওয়ার্ল্ড-ইউনিভার্স হিসেবে তৈরি করা হয়, তাতে প্রতিযোগীর অবদান সামান্যই। তার ভাষায়, ‘‘মিস ওয়ার্ল্ড হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়াটাতে তিনি নিজে অবদান রাখেন সামান্যই। বরং, ‘এক্সপার্ট’রাই হচ্ছেন আসল লোক যারা মোট কাজের বেশিরভাগটা সম্পাদন করেন।
খোদাই করে করে তারা তাকে একজন মিস ওয়ার্ল্ড যেমন হওয়া উচিত সেরকম আদর্শ-বস্তুতে রূপান্তর করে ফেলেন’’ (রাঙ্কল, ২০০৪: ১৪২)। এই পুরো ‘গ্রুমিং’-প্রক্রিয়া দেখে সুসান রাঙ্কলের ধারণা হয়েছে, ‘শরীর এমন একটা যন্ত্র যার বিভিন্ন পার্টস মেরামত করা যায়’ (রাঙ্কল, ২০০৪: ১৩৯)। এই মেরামতিতে ডায়েট, ভাষাভঙ্গী, ত্বক, ফ্যাশন ইত্যাদি নানা বিষয়ের এক্সপার্ট যুক্ত হন। দেখা যাচ্ছে প্রতিযোগীর সৌন্দর্য ও ট্যালেন্ট উভয়ই নির্মিত হচ্ছে অন্যের দ্বারা। আর তার ট্যালেন্টের বহর উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন রাঙ্কল।
একজন প্রতিযোগী সবচেয়ে পছন্দের নারী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের নাম বলেছিলেন -- ‘কারণ তিনি হচ্ছেন প্রেম, ক্ষমতা আর দৃঢ়তার আদর্শ, যদিও তাঁর ছিল একটা দুর্যোগপূর্ণ ব্যক্তিগত জীবন’ (দেখুন রাঙ্কল, ২০০৪: ১৫০)। স্বামীর প্রকাশিত বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের পরও যিনি তার প্রেম ও দৃঢ়তা দিয়ে বিয়ে-রাজনৈতিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখেন তিনিই সুন্দরীর আদর্শ হবেন, এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
তথ্যসূত্র
http://en.wikipedia.org/wiki/Beauty_contest
সুসান রাঙ্কল (২০০৪), ‘সৌন্দর্য উৎপাদন’, সেলিম রেজা নিউটন অনূদিত, চন্দ্রাবতী, সুস্মিতা চক্রবর্তী সম্পা., রাজশাহী, ২০০৬।
প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।