আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোনদিন আচমকা একদিন



অনেকদিন আগে এক মেঘলা দুপুরে আমি বাংলা একাডেমী'র রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। লাইব্রেরীতে দু'টা বই জমা দিতে হবে। টিএসসি'তে ছাএদের কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল আর ঠিক তখন রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে একটা মিছিল আসছিল। হঠাৎ মিছিলের উপর পুলিশ লাঠি চার্জ শুরু করে। আমি তখন অপরাজেয় বাংলা'র সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের মার'মুখি ভুমিকা দেখছি।

একজন পুলিশ হঠাৎ আমার দিকে তেড়ে এলো এবং পায়ে খটাং করে দিল এক লাঠি'র বাড়ি। আমি ব্যাথায় চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলাম আর অন্য পা দিয়ে পুলিশটাকে কষিয়ে একটা লাথি দিয়ে দিলাম। আমার অনেক রাগ হচ্ছিল,তাই সাহসটা করে ফেললাম। রাগি পুলিশটা এবার পিস্তলে হাত দিল,হয়তো আমাকে মেরেই ফেলতো-কিন্তু সেই সময় মিছিলের কিছু লোক ছিটকে এলো এদিকে। তাদের বেপরোয়া হতচকিত ধাক্কায় রাগি পুলিশটা সরে গেল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। হাঁটুতে সাংঘতিক ব্যাথা,চোখ ভিজে আসছে। ঠিক সেই সময়ে দু'টো গুলির আওয়াজ। আর্ত চিৎকার। টিয়ার সেল।

ভয়ে মানুষের ছোটাছুটি। সেই মেঘলা দুপুরে পুলিশ ঠিক তিন রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। তাতে চলন্ত বাসে বসে থাকা একটি লোক মারা যায়। আমি আমার ভেজা চোখেও দেখতে পেয়েছিলাম। অন্য সবাই দেখেছে একটু দেরীতে।

আমি আমার জখম পা নিয়েই কাছ-ঘেষা বাসটায় উঠে পড়ি। তখন হুড়োহূড়ি করে যাএীরা সব নেমে যাচ্ছে। আর গুলি লাগা লোট মরে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বাসের সীট,মেঝে। কোনো সাংবাদিক হয়তো চকাচক দু'তিনটা ছবি তুলে নিচ্ছিল।

আর ঠিক তখন আমি দেখতে পাই-লেডীজ সীটে খুব সুন্দর নীল শড়ি পরে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা খুব ভয় পেয়েছে। এতো ভয় পেয়েছে যে পালাতে পারেনি। গোঙ্গাছে,পানি!পানি করছে। আমি বললাম-আরে...,পালান পালান!নামুন তাড়াতাড়ি!বলে আমি গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিয়ে আসি বাস থেকে।

বাইরে টিয়ার গ্যাসের ধোয়া,লোকজন যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে,পুলিশ তেড়ে যাচ্ছে যাকে পাচ্ছে সামনে তার দিকে। ঠাস ঠাস করে লাঠি পড়ছে। আমাকে মারার জন্য কমপক্ষে সাত জন পুলিশ লাঠি তুলেছিল। সাথে মেয়েটি ছিল বলে বেঁচে গেলাম আমি। পুলিশ সাথে মেয়ে দেখে আমায় মারেনি।

তীব্র টিয়ার গ্যাসে প্রায় অন্ধ চোখে ছুটতে ছুটতে আমরা আজিজ মার্কেটের সামনে চলে গিয়েছিলাম। কোথায় থাকেন আপনি? মেয়েটি কোন জবাব দিতে পারেনি। শুধু কাপছিল ভয়ে,অবিশ্বাসে। নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে বসতে দেই আমি। জিরোতে দিলাম।

দু'জনেরই চোখ লাল হয়ে গেছে। দু'জনেই হাফাচ্ছি। অনেকক্ষন বাদে মেয়েটি তার ঠিকানা বলতে পারলো। আমি বললাম একা যেতে পারবেন? না। ভিষন ভয় করছে-মেয়েটি বললো।

কিন্তু আমাকে যে এখন লাইব্রেরীতে যেতে হবে। এই বই দু'টো ফেরত দিতে হবে। খুব জরুরী। মেয়েটা কাঁদছিল। কিছু বললো না।

ঠিক সেই সময়ে আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছিল। খুব বৃষ্টি। সাংঘাতিক বৃষ্টি। আরে ...,উঠুন!ভিজবেন যে!মার্কেটের কোনো দোকানে ডুকে পড়তে হবে। মেয়েটি উঠেনি,ছোটেনি,বসে রইলো মুখ নীচু করে।

আমার হাতের বই দু'টো ভিজছিল। আমি চলে যেতে পারতাম। যাইনি শেষ পর্যন্ত। মেয়েটির সাথে আমিও ভিজেছিলাম বই দু'টো হাতে নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো সেই বিকেলে বৃষ্টি আর থামেনি।

প্রচন্ড বৃষ্টিতে আন্দোলন থেমে গেল,পুলিশের হামলা বন্ধ হলো জনসাধারন পালালো নিরাপদ আশ্রয়ে। আর আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই নীল শাড় পরা মেয়েটিকে বাড়ি অবধি পৌছে দিলাম। কিছু পথ হেঁটে কিছু পথ রিকশায়। সাতদিন পর আমার পায়ের ব্যাথা ভালো হয়েছিল আর দশ দিনের মাথায় আমি মেয়েটির একটি ফোন পাই। ফোনের কথা গুলো ছিল এই রকম-"আমি সেই মেয়েটি,যে সেদিন চোখের সামনে লোকটাকে মরে যেতে দেখে পাথর হয়ে গিয়ে ছিলাম।

মনে হয় আমার হার্ট ফেল হয়ে যেত,আপনি আমাকে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে না আনলে। আমার বোধ হয় জ্ঞানও ছিল না। কি রকম যেন হয়ে গিয়েছিলাম!বৃষ্টিতে ভিজে আমার জ্বর হয়ে গিয়েছিল,জানেন?(আমি শুনেই যাচ্ছি,কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি না। )তবু ওই বৃষ্টিটা বোধ হয় দরকার ছিল। ভিজে ভিজে মাথা ঠান্ডা হয়ে ছিল,শরীরে শক্তি ফিরে এসে ছিল।

আপনার সাথে আর একবার দেখা হতে পারে কি?আমার যে মুখোমুখি একবার ধন্যবাদ আর কৃ্তজ্ঞতা জানানো দরকার আপনাকে। আর কি অভদ্র আমি! সেদিনতো এক কাপ চাও অফার করা হয়নি আপনাকে! আমি ফোনটা কেটে দিয়ে মা'কে বলি- মা,চা দাও,বাইরে যাবো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।