যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।
ওয়ান ইলেভেন (পঞ্চম পর্ব)
ওয়ান ইলেভেন (চতুর্থ পর্ব)
ধুপ ধাপ করে পা ফেলে কারও এগিয়ে আসার শব্দ পাচ্ছি। অনেকটা স্বভাবজাত ব্যস্ত ভঙ্গীতে হাঁটার ন্যয় আওয়াজটা। কেউ একজন ব্যস্ত ভঙ্গিতে শায়েস্তা খাঁর তোরণের কাছে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে।
কে হতে পারে অনুমান করার চেষ্টা করি।
কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর লাশবাহী পাঁচটি কফিন বের হয়েছে শায়েস্তা খাঁর এই তোরণ দিয়ে। আমি পাঁচটির পরিবর্তে ছয়টি কফিন দেখতে পেয়েছিলাম। ষষ্ঠ কফিনের ভিতরে কি আছে কিছুই দেখতে পাইনি। দেয়াল ভেদ করার মতো প্রযুক্তিসম্পন্ন স্ক্যানিং মেশিন থাকার পরও সেই কফিনের দেয়াল ভেদ করতে পারিনি আমার সাইবর্গ আই দিয়ে।
যা প্রযুক্তি দিয়ে পারিনি, তা পারতে যুক্তির সাহায্য নেই। আমি আপন মনে ভাবতে বসি।
এই ভাবনার আমি কোন তল খুঁজে পাই না। কি নিয়ে ভাবতে বসেছি- তার তল খুঁজে বের করার জন্য আমাকে স্থায়ী মেমোরির সাহায্য নিতে হয়। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি নৃশংস খুনের ইতিবৃত্ত আমার স্থায়ী মেমোরিতে জমা আছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের জঘন্য নৃশংস এই খুনের দৃশ্যগুলো আমার মেমোরিতে ভেসে উঠলেই নিউরনগুলোর মধ্যে অস্থির ছোটাছুটি শুরু হয়। নৃশংসতা নামক ভাইরাসটি আমার ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক সংকেত বোঝা নিউরনগুলোকে স্থবির করে ফেলে। আমার তখন ওয়ান ইলেভেনের কথা মনে হয়। রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গণতন্ত্রের কথা মনে হয়।
আমার অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে নিজ হাতে আমি আমার জনকের বুক বুলেটে বুলেটে ঝাঁজরা করে দিচ্ছি।
উফ!
কী নৃশংস ভয়াবহ সেই দৃশ্য!
এত বুলেট আর এত রক্তের দৃশ্য ভেসে উঠতেই নিউরনগুলো সুতীব্র চীৎকারে জানান দিতে থাকে...শায়েস্তা খাঁর এই তোরণ দিয়ে খুনীদের কফিনগুলোকে চিরতরে বের করে দাও...।
আমার চোখের সামনে দিয়ে একে একে পাঁচটি কফিন বের হয়ে গেল। ষষ্ঠ কফিনটির কিনারা আজও করতে পারলাম না। ছয় সংখ্যাটি আমার মাথায় ঘুরপাক খেতেই থাকে। ছয় সংখ্যাটি নিয়ে আমি ভাবতে বসি।
বঙ্গবন্ধুর খুনী ১২ জন। এর মধ্যে ৫ জনের ফাঁসি হয়েছে। একজন আগেই মারা গিয়েছে। আর বাকি ৬ জন পলাতক।
আচ্ছা আমি কি পলাতক ৬ খুনীর লাশ বহনকারী প্রতীকি কফিন দেখেছি!
আচ্ছা! আর কিসের লাশ থাকতে পারে এই কফিনটিতে।
কেন আমার সাইবার আই দুটো দিয়ে ষষ্ঠ কফিনের রহস্য ভেদ করতে পারছি না। এই রহস্য ভেদ করতে আমাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে!
ক্ষমতার মোহে মানুষ কী না করতে পারে! স্রেফ পশু হয়ে যেতে পারে। নিজ হাতে বাবাকে খুন করে ফেলতে পারে। প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি মিলবে। কিন্তু তাই বলে পরিকল্পনা করে একটি বংশের সবাইকে ব্রাশফায়ার করে মেরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা! ভাবনার এ সময়ে একটি অসাধারণ হত্যাকাণ্ডের সাথে একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের তুলনা আমার মনে চলে আসে।
সেটিও আগষ্ট মাসের হত্যাকাণ্ড। ১৯৯৩ সালের ১১ আগষ্ট নিদারাবাদে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
সামান্য এক টুকরো সম্পত্তির লোভে নিদারাবাদের তাজুল ইসলাম একটি পরিবারের ১২ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করে চুনের ড্রামে ভরে বিলের পানিতে চুবিয়ে রেখেছিল। খুনীরা বিরজাবালার বংশের কাউকে জীবিত রাখে নি। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর লাশবাহী কফিনগুলোকে আমার সেই ড্রামের মতোই মনে হয়েছিল।
আমি প্রতিটি কফিনে তাজুল ইসলামদের লাশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম। ক্ষমতার লোভে, অর্থের লোভে ফারুক-রশীদরা তাজুল ইসলাম হয়ে যেতেও পিছপা হয় না। তাজুল ইসলামের ফাঁসিতে ঝোলার দৃশ্য দেখার জন্য বিরজাবালার বংশের কেউ জীবিত ছিল না। কিন্তু জাতির জনকের খুনীদের ফাঁসি তাঁর কন্যারা দেখতে পেয়েছেন। বিষয়টি ভাবতেই আমার মস্তিষ্কের নিউরনে স্বস্তির আমেজ আসে।
কিন্তু ছয় নাম্বার কফিনটির রহস্য আমি এখনও উদঘাটন করতে পারিনি। আমাকে আরও ভাবতে হবে। আমার ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক সংকেত বোঝা নিউরনগুলোকে কাজে লাগিয়েছি ষষ্ঠ কফিনের রহস্য উদঘাটনের জন্য। এই কফিনে কি তাহলে আদৌ কোন লাশ পরিবাহিত হয় নি? আমার প্রোগ্রামিং করা দৃষ্টিশক্তি ভুল করতে পারে না। আমি স্পষ্ট ৬ টি কফিন দেখতে পেয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর লাশবাহী পাঁচটি কফিন বের হয়ে যাওয়ার পর পরই ষষ্ঠ কফিনটি বের হয়ে গিযেছিল। কফিনটির দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে আমার সাইবারনেটিক দৃষ্টিশক্তি ভেতরে পৌঁছতে পারেনি। এই বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড ভাবনায় ভাবিয়ে তোলে।
এই সুযোগে কেউ একজন ধুপধাপ শব্দে পা ফেলে তোরণের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি চমকে উঠি।
আরে!
এতো দেখছি সেই স্যুট-টাই পড়া ভদ্রলোক। ওয়ান ইলেভেনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে যিনি গরীব পিঠা বিক্রেতার গলা চেপে ধরেছিলেন প্রবল আক্রোশে। ঢাকার পশ্চিমে শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের কাছে আজিমপুর থেকে তিনি বাসে চড়েছিলেন, নতুন ঢাকায় যাবেন বলে। বাসে বসে ঘুমের ঘোরে ভুলক্রমে শায়েস্তা খাঁর আমলে চলে এসেছেন ভেবে পুরো শান্তিনগর জুড়ে কী এক দজ্ঞযজ্ঞ বাধিয়ে ফেলেছেন।
ভদ্রলোক আনমনে কি যেন খুঁজতে খুঁজতে ত্রস্ত ভঙ্গীতে হেঁটে চলেছেন।
ভদ্র্রলোকের বিষণ্ন মুখটিতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আমি জানি লোকটি কি খুঁজছে। শায়েস্তা খাঁর তোরণটি খুঁজছে। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে নগরীর পশ্চিম তোরণে উৎকীর্ণ সেই লিপিটি খুঁজছে।
এটিতে একটি রহস্যময়ী বাণী আছে। বাংলাপিডিয়ায় শায়েস্তা খাঁ অধ্যায়ে এই বাণীটি দেওয়া আছে। এই বাণী সমৃদ্ধ তোরণটি খোঁজার জন্য ভদ্রলোকের দিনের পর দিন কি চেষ্টা!
কিন্তু আমি জানি সে এটি খুঁজে পাবে না। কারণ কয়েকশ বছরের পুরনো এই তোরণটির চিহ্নমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। শায়েস্তা খাঁ চলে যাওয়ার পর থেকে তাঁর উৎকীর্ণ এই বাণীটির মাহাত্ম্য কেউ বুঝেনি, তাই তোরণটিকে সংরক্ষণ করা হয়নি।
অথবা এমনও হতে পারে শস্যমূল্য সন্ত্রাসীরা এই তোরণটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তোরণটি ধ্বংস হয়ে গেলেও আমার সাইবর্গ আই দিয়ে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে দশ মাত্রার দৃষ্টি দিয়ে তোরণের এ পাশে বসে আমি শুধু দেখছি- কারা এই তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে।
আমার বায়োমেট্রিক আইডি কার্ড না থাকাতে আমি এই তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে পারছি না। না পারলেও ক্ষতি নেই।
প্রথম অভিযাত্রায় আমি তথ্যের সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে কিছুটা ক্লান্ত। তাই তোরণের এপাশ থেকেই আমি নিউরাল ভ্রমণ সেরে নিচ্ছি। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত ট্রেনটি সঠিকভাবে যাত্রা শুরুর সময় থেকে সামরিক উর্দি পরা ছয়জন ঘোড় সওয়ার বের হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে ৬টি কফিন বের হয়েছে, যার পাঁচটিতে ছিল বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসিতে ঝুলানো আধা হাত জিহ্বা বের করা বিকৃত লাশ।
ষষ্ঠ অর্থাৎ শেষ কফিনটিতে কি থাকতে পারে তার একটি সম্ভাব্য তালিকা আমি মনে মনে করতে থাকি।
আচ্ছা এই কফিনটিতে কি প্রতীকি কারও লাশ বহন করা হচ্ছিল যা আমি দশ মাত্রার দৃষ্টি দিয়েও দেখতে পাইনি। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবুবকর সিদ্দিকের লাশ বাহিত কফিন ছিল কি এটি? নাকি ভবিষ্যত অনেক আবুবকরের লাশে ষষ্ঠ কফিনটি ঠাসা থাকবে।
আমার ভাবনাটা আরও এলোমেলো হয়ে যায়।
এত লাশ কি একটিমাত্র কফিনে জায়গা হবে? নাকি আবুবকরদের নিয়ে আরও শত শত কফিন বের হবে এই তোরণ দিয়ে?
ওয়ান ইলেভেনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে স্যুট-টাই পড়া ভদ্রলোক যখন ঘুরতে ঘুরতে মনের অজান্তে শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের কাছে চলে এসেছিল একটু ফ্যান্টাসি করার জন্য আমি ভদ্রলোকের মাথায় একটি নিউরন পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। শায়েস্তা খাঁর আমলের টাকায় আটমন চালের গল্প সংবলিত সেই প্রোগ্রামিংটি ছিল নিউরনটিতে।
তারপর সে কী মজার কাণ্ড!
এখনও আমার চোখে ভাসছে আক্রোশে কিশোর ছেলেটির গলা চেপে ধরে রাখার সেই দৃশ্য। মৃত্যু ভয়ে ভীত ছেলেটি চীৎকার করে বলে যাচ্ছিল...আমি পণ্যমূল্য সন্ত্রাসী না...আমি ছিনতাইকারী না...আমি রাস্তায় পিঠা বিক্রি করে সংসার চালাই...১০ টাকার চাউল ৪০ টাকায় কিনতে হইলে ২ টাকার পিঠা আমাকে ৫ টাকায় বিক্রি করতে হইব...।
ভদ্রলোক মনের অজান্তে তোরণের কাছে চলে এসেছেন। মনের অজান্তেই গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। কোথায় যাবেন কে জানে! গেট দিয়ে কারা বের হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই।
আমার প্রতি নির্দেশ ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে তোরণের মধ্য দিয়ে কারা প্রবেশ করে শুধু তাদের হিসাব রাখা। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসী, পণ্যমূল্য সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ নেতা যারাই এই তোরণ দিয়ে প্রবেশ করেছে আমি সবার তথ্য টুকে রেখেছি।
ক্লান্তিতে নুয়ে পরা শরীর নিয়ে ভদ্রলোক শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। গেটের ওপাশে আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত প্রহরীকে দেখা যাচ্ছে না। আমি প্রখর দৃষ্টি ফেলি ভদ্রলোকের উপর।
এই গেট দিয়ে যারা একবার বের হয়ে যায় তারা চিরতরেই চলে যায়! ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী থেকে উপহার পাওয়া মেয়ার এবং স্ট্যালিয়ন প্রজাতির ছয়টি ঘোড়া নিয়ে সামরিক উর্দি পরা ছয়জন ঘোড় সওয়ার বের হয়ে গিয়েছে এই তোরণ দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনীর লাশবাহী পাঁচটি কফিন বের হয়ে গিয়েছে এই তোরণ দিয়ে। আমার সাইবার আই দিয়ে দেখতে পাওয়া ষষ্ঠ কফিনটিও বের হয়ে গিয়েছে এই তোরণ দিয়ে।
আমার ভাবনার এ সুযোগে ভদ্রলোক ঘুরতে ঘুরতে মনের অজান্তে শায়েস্তা খাঁর এ তোরণের কাছে এসে পড়েছেন। আমি জানি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে নির্মিত শায়েস্তা খাঁর এই তোরণটি ভদ্রলোক দেখতে পাচ্ছেন না।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঢাকা নগরীর পশ্চিমে এই তোরণটির চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। মনের অজান্তেই তিনি তোরণ দিয়ে বের হয়ে চলে যাওয়ার পথ ধরেছেন। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে যেসব অপশক্তি এ তোরণ দিয়ে বের হয়েছে তারা চিরতরেই বের হয়েছে। কিন্তু স্যুট-টাই পরা এ ভদ্রলোক তোরণ দিয়ে চলে গেলে কি চিরতরেই চলে যাবেন! ভদ্রলোকের চলে যাওয়াকে আমার প্রবলভাবে বাধা দিতে ইচ্ছে করছে। তোরণটি অতিক্রম না করার জন্য আমি ভদ্রলোকের মাথায় ক্রমাগত মেসেজ পাঠিয়ে যেতে থাকি...
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।