কাব্যগ্রন্থ: পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক। সরসিজ আলীম। প্রচ্ছদ: অতনু তিয়াস। প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০০৯। পৃষ্ঠা: ৪৮।
মূল্য: ৬০। প্রকাশক: ভাষাচিত্র।
প্রথম কাব্যগ্রন্থে যদি কিস্তিমাত না করা যায়, তাহলে সে কবির কপালে দুঃখ আছে। কবি ও কবিতার মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে কবি নামের স্ব-শ্রেণী। তাঁদের ভাব, অভাব ও হাবভাব।
কবিতা লিখে ধরাকে সরা করতে চায়। সামান্য সৌজন্যতা, সামান্য ভদ্রতা, মানবিক সৌন্দর্য ও মানবিক মূল্যবোধ এদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যত রকমের ভণ্ডামী ভড়ং অভিনয় করা দরকার, সবটা করে যাচ্ছে আমাদের কবি যশোপ্রার্থী বন্ধুরা। এতে কোন লাভ হচ্ছেÑ আখেরে না কবিতার না
নিজের।
আত্মকেন্দ্রীক মানসিকতার কারণে গড়ে উঠছে না আমাদের মধ্যে একটা তীব্র কাব্যান্দোলন, সনাক্ত করা যাচ্ছে না শক্তিশালী কবিগোষ্ঠী।
মিডিয়ার কল্যাণে ও মিডিয়া মোগলদের করুণায় যাদের নাম আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি, তাদের লেখা কতটুকু সনাক্তযোগ্য, সে প্রশ্ন সবার। কবি হওয়ার প্রতিযোগিতা করা ও ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করা, দুইটা দুই জিনিস। কবি হওয়া সহজ; মিডিয়া মোগলদের সাথে সম্পর্ক, বাজে লেখাকে ভালো
বলে চাটুকারিতা করা ইত্যাদি বিষয় করতে পারলে কবি হওয়া যায়। কিন্তু ভালো কবিতা লেখা অত্যান্ত কঠিন। এখন আমরা কঠিনকে ছেড়ে সহজকে
বেছে নিচ্ছি।
ভালো কবিতা লেখার সাথে মানবিক সৌন্দর্য চড়িয়ে দিতে
পারলে, সেই কবি মহাকালের বারান্দায় হাঁটতে পারেন এবং তার সংগে থাকে কবিতা পাঠক নামের সংবেদনশীল, মানবিক মূল্যবোধ সমপন্ন বোদ্ধা শ্রেণী। যারা কবিতাকে অনুভবে অনুরাগে নান্দনিক করে তোলেন।
ভাব ও অভাবের এই সময়ে ২০০৯-এর একুশে বইমেলায় এরকমই এক মানবিক সৌন্দর্যের কবির দেখা পেয়ে খুবই ভালো লাগলো। কবির নাম সরসিজ আলীম। মেলায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক’ বয়রাতলায় বসে বিক্রি করছে।
বইটি কিনে নিলাম। মেলা-শেষে বাসায় এসে যখন কবিতাগুলো পড়তে লাগলাম, একটা নতুন চেতনা, নতুন কাব্যভাবনা আকর্ষণ করতে লাগলো। পড়তে পড়তে কবিতার সৌন্দর্য আমাকে মগ্ন করে তুললো। কবিতাকে ভেঙেচুরে উল্টে দেওয়ার সাহস সরসিজের যথেষ্ট। কবিতাকে ভেঙেচুরে উল্টে দেওয়ার সাহস আমাদের সময়ের কবিদেও মধ্যে প্রচুর লক্ষ্য করা যায়।
বিষয় বিন্যাসে নতুনত্ব, আঙ্গিকের পরীক্ষা নিরীক্ষা, সর্বোপরি বাংলা কবিতাকে বদলে দেওয়ার মানসিকতা এ সময়ের কবিদের নতুন কবিতা লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। সরসিজও নিজস্ব বয়নে ও বুননে সেই চেষ্টা করছেন অনেক তীব্র এবং সচেতনভাবে। প্রথম কবিতা পাঠে কবিতাগুলো আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। যখন বারবার পড়বেন, মনযোগ দিয়ে পড়বেন, কবিতায় ডুব দিবেন, তখন কবিতার অর্ন্তগত সৌন্দর্য একে একে আপনার কাছে ধরা পড়বে, প্রকৃত অর্থে তখন কবিতাগুলো আপনার ভালো লাগতে শুরু করবে।
কবিতা এমন এক নান্দনিক বোধের উৎসারণ, যাকে হালকাভাবে গ্রহণ করলে আপনাকে ঠকতে হবে।
কবিতা লেখার জন্য যেমন আপনাকে সিরিয়াস হতে হবে, তেমনি কবিতা পাঠের জন্য আরো বেশি সিরিয়াস হতে হয়। দরদ ভালোবাসা সমান শ্রদ্ধা, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকলে কবিতা পড়ে
আপনি অনুভবে অনুরাগে ধারণ করতে পারবেন না। কবিতার জন্য চায় ভালোবাসা একটু বেশি ভালোবাসা। প্রেয়সীকে যেমন ঘোরে অঘোরে চেতনে অবচেতনে দূরচেতনে ধারণ করে, নিজের অজান্তে কবিতাকেও সেভাবে ধারণ করতে হয়, মজে যেতে হয়। তাহলেই কবিতার নান্দনিক সূষমা আপনাকে শীতল স্বর্গীয় একটা শান্তির পরশ দেবে, যা আপনি না নারীতে না নদীতে না জীবনের অন্য কোন বিনোদনে পাবেন না।
ভাসা-ভাসা ভাবে একটু পড়ে অনুভব না করে কবিতার ভেতর ডুব না দিয়ে চট করে মন্তব্য করে দিলে বুঝতে হবে, সে পাঠক হোক আর কবি হোক, এরমধ্যে কবিতার প্রতি ভালোবাসা নেই। যা আছে, তা আছে লোক দেখানো ভড়ং, প্রতিষ্ঠাকামীতার দূরভিসন্ধি। আমাদের সময়ের কবিদের মধ্যে কারো কারো কবিতা সনাক্তযোগ্য হয়ে উঠেছে নিরবে নিভৃতে । হৈ হৈ রৈ রৈ এর ভেতর যারা প্রকৃতই কবিতা লিখছেন, সরসিজ তাদের মধ্যে অন্যতম। যেমন: একজন যুবকের স্বপ্ন পিয়াসের দু’চোখ/ নিয়ে কথা বলতে দৌঁড়তে জলঘাসের ক্রন্দন লিখতে ও পড়তে পারতাম আমরা/ যার দু’চোখে ও পিয়াসে/ দীর্ঘলম্বা অতিদূর গাঁও ও নগরীর রয়েছে সুপেয় সুপ্রভাত আলোকধারা/ এ আলো কখনো ঘুমিয়ে
পড়েনা/ চে’র চেয়ে উজ্জ্বলতম আগুন।
( হাত রচিত )।
প্রকৃত কবিতার স্বাদ কোথায়, কবিতা পড়তে পড়তে পাঠককে খুঁজে নিতে হয় এবং প্রকৃত কবিতা কি তাও অনুভবের আঙ্গিনায় বুঝে নিতে হবে। একজন যুবকের স্বপ্ন আলো স্বপ্ন সাধনা, সে আলো জ্বলতেই থাকে জ্বলতেই থাকে। কোনভাবে যেনো নেভে না এবং বিশ্বের অমর বিপ্লবী চে’র চেয়ে হাজারো উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকে, সে যুবক তো বিশ্ব জয় করবে। সরসিজ এ কবিতার মাধ্যমে কিসের যেনো ইঙ্গিত দেয়, ইতিহাসের কোন এক স্বাপ্নিকবার্তা আভাসিত করে তোলে।
এভাবেই এগিয়ে যায় প্রকৃত কবিতা, ভালো কবিতা উজ্জ্বলতম আগুন নিয়ে জ্বলতে থাকে পৃথিবীর ফাগুনে। কাব্যগ্রন্থেও এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা যা সনাক্তযোগ্য। এই একটি কবিতার মাধ্যমে পাঠক অবগত হতে পারেন বাংলা কবিতা যেমন বাঁক নিচ্ছে নতুন পথে নতুন স্বরে, তেমন সনাক্তযোগ্য কবিও আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে।
সরসিজ নিরন্তর নিজেকে ভাঙবার চেষ্টা করছেন। কবিতাকে গল্পের কাঠামোতে দাঁড় করাচ্ছেন, তাতে কবিতার বাইরের খোলস যেমন বদলে যাচ্ছে তেমনিভাবে ভেতরের খোলসও শিল্পিত সূষমায় ভরে উঠছে।
সে রকম একটি কবিতা ‘আমাদের মা’ গল্পের ছলে বলে যাওয়া একটি
পরিবারের উৎস রচনার নান্দনিকতা। যেমন:
‘মেয়েটি অথবা নববধূটি এক সন্ধ্যায় শ্বশুর মানুষটির অজুর পানি দেবার পর পূর্বঘরের দ্বিতীয়তলায় সেজবাতি জ্বালায়, সেই সেজবাতিতে সরিষার তেল ও একটি শলিতার গল্প জ্বলতে থাকে ভীরুতা ও লাজের ভেতর, ভীরুতা ও লাজ গিয়ে বসে কদমবুচিতে, কদমবুচির মাথায় রাখে হাত, ...হাত...ধনে মানে পূর্ণবতী হও মা... ব’লে গল্প গড়াতে থাকে ঘর আলো করা ঘর-সংসার। ’ ( আমাদের মা)।
আমাদের মা নববধূ লজ্জাবতী, কিভাবে শ্বশুরের অজুর পানি দিয়ে পূণ্যবতী হওয়ার দোয়া বা আশীর্বাদ নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে গড়িয়ে যায় জীবন সংসারে। তারপর অনেক গল্পের পর ভাতে ও হাভাতে আট সন্তানের গর্বিত জননী হয়ে ওঠে আমাদের মা।
প্রকৃতির যে ভাষা আছে, প্রতিদিন মানুষের মত বৃক্ষ পাখি পাতা
নদী যে কথা বলছে সে বিষয়কে সরসিজ আমাদেও চোখের সামনে নিয়ে আসে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে । যেমন:
নিম ও তেতুল বন্ধু বুঝি তাঁর ?
বন্ধু, ধরে রাখতে যদি ই-কার !
আদরগুলো রেখে দিঘির জলে
‘যাই’ কী কখনো যেতে পারে চলে!
কিংবা
পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক,
দিঘি জলটি লিখছে মোটা দাগ।
দিঘির জল লেখে মোটা দাগকে,
‘যে’ লম্বা মোটা দাগ ফেলেছিলো ‘কে’।
কবিতার ভিতর বাহির, কবিতা বাহির ভিতর সরসিজ ঘুরে ফিরে দেখেছেন নিজের মত করে। প্রথম কাব্যগ্রন্থটির ত্রিশটি কবিতার সবগুলো কবিতার একটা মেজাজ আমরা লক্ষ্য করি একান্ত সরসিজীয়।
যে মেজাজ নিয়ে সরসিজ মেজাজ দেখাক না কেনো, তার কবিতা প্রকৃতই নতুন স্বপ্নে নতুন সংবেদে আশবাদী করে তোলে সময়, কাল সর্বোপরি মানুষকে। মাঝি, একটি
হেমন্তের কবিতা, বৈশাখ, এই সবুজ, মৃত্যু ও তালপাতার কাব্য _ এ সব কবিতা যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। কথা হচ্ছে, পরীক্ষা রিরীক্ষা
যাকিছু করুক, সরসিজ আলীম এই পরীক্ষা নিরীক্ষার টেক্স্ট নিয়ে আগামীতে
কতটুকু দাঁড়াতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। আশা করি সরসিজ আলীম দাঁড়িয়ে যাবে। প্রথম কাব্যগ্রন্থে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি।
(১ ফেব্রুয়ারি ২০১০, একুশে বইমেলা শুরু হচ্ছে। আমার উল্লেখিত বইটি একুশে বইমেলা ২০০৯-এ প্রকাশিত। এবার মেলা থেকেও বইটা সংগ্রহ করতে পারবেন। পাঠকের পাঠের সুবিধার্থে গ্রন্থালোচনাটি পোষ্ট করলাম। পাঠক, বইটা পড়ে এ আলোচনার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
আবার আপনার নিজের মতো করে একটা আলোচনা লিখতে পারেন। আপনার আলোচনাটি এ ব্লগে প্রকাশ করুন। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।