আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাক্স সুন্দরী , কর্পোরেট পুঁজিবাদ , কিছু প্রশ্ন ও সমাধান - জ্ঞান ও সম্পদ পর্ব

পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি

গতপোস্টে আমি বলেছি , ১। আমরা আমাদের জীবনে যে যেইখানেই থাকি না কেন, কর্পোরেট পুঁজিবাদের খপ্পর থেকে আমরা কেউই বাইরে নেই। হিমালয়ের গুহা কিংবা আমাজনের জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করলেও এর প্রভাব বলয়ের বাইরে আপনি থাকতে পারবেন না । ২। একজন ভোক্তা , ক্রেতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সার্ভিসের উৎপাদক হিসেবে আপনি আমি - সবাই - কর্পোরেট পুঁজিবাদের দুনিয়ার চক্র টার সাথে জড়িত ।

ই এই পৃথিবীর ৬ বিলিওন মানুষ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । এই সব কিছুই আমার এবং আমাদের জীবনের দৈনন্দিন প্রতিটা সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রন করে। তাহলে, কর্পোরেট পুঁজিবাদের জগৎ এ আমাদের নিজেদের অবস্থান কি ? আমরা কেউই যে এই কর্পোরেট পুঁজিবাদের খপ্পর থেকে বাইরে না, তা আমরা বুঝি না এবং আমাদের অজান্তেই গল্পের গরু বিক্রির পরের ঘটনার মত একে একে স্কুল, হাসপাতাল, মিষ্টির কারখানা , কাপড়ের কারখানা , বিড়ির কারখানা ইত্যাদিতে শ্রমিকে পরিণত হই। ইতমধ্যে আপনি যা সত্যিকারের মূল্যবান সম্পদ , উৎপাদনের আসল খাত , সেই গরু বা ফসলী জমি কিংবা মাছে ভরা পুকুরটা হারিয়ে ফেলেন। একটা দৃশ্য কল্পনা করুন, হঠাৎ করে যদি আজকের দুনিয়ার সকল প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় , সবার পরে মারা যাবে কারা ? যাদের মালিকানায় খাদ্য উৎপাদনের জায়গা গুলো আছে ।

অর্থাৎ , যে চাকুরীজীবী কিনে খাবার খাইতো সে মরবে সবার আগে । যে আড়তদার খাবার মজুত এর ব্যবসা করতো সে মরবে মজুত ফুরালে। আর যে নিজের জমি, পুকুর, গবাদি পশু কিংবা গ্লাস হাউজে খাদ্য উৎপাদন করতে পারে , সে মরবে সবার পরে । সুতরাং, আজকে যারা মনে করে যার হাতে যত টাকা সে ততবেশি ধনী বা পাওয়ারফুল , আখেরে এই ধারনা পুরাই মিথ্যা । সম্পদ ও সম্পদের উৎস লেন দেনের বিনিময় মাধ্যম হইলো টাকা ।

যতদিন কর্পোরেট এর পুঁজির বাজার বাড়তে থাকবে, লেন দেন চলতে থাকবে , আপনার মনে হবে আপনি সত্যি সত্যি পাওয়ার ফুল, আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রন আপনার নিজের হাতে, আপনার সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতাও আপনার হাতে । এই ফুলস রিয়েলিটি বা বোকার স্বর্গে বসবাসকে পুঁজি করেই লাক্স সুন্দরীদের মতন সুপারস্টার এবং বাকি যারা সুপারস্টার হতে চায় তাদের জীবনটাকে যথা সম্ভব ঘোরালো এবং প্যাঁচালো করে রেখে দুনিয়াশুদ্ধ মানুষকে বেকুব বানিয়ে কর্পোরেট পুঁজিবাদের মালিক ও শোষক গোষ্ঠী দুনিয়াময় মজা লুটে বেড়াচ্ছে । সত্যিকারের মূল্যবান সম্পদ হইলো এমন কিছু যা আপনাকে (খাদ্য বা পানি) উৎপাদন করার সুযোগ/ ক্ষমতা দেয় । যেমন কৃষিজমি, গবাদি পশু, মৎস জলাশয়, সুপেয় পানির উৎস ইত্যাদি এইগুলা হইলো আসল সম্পদ কারন এইগুলা আপনার মালিকানায় থাকলেই আপনি সত্যিকারের স্বাধীন । বেঁচে থাকার জন্য অন্য কারো উপর নির্ভর করতে হবে না আপনাকে ।

শুধুমাত্র এই কারনেই দুনিয়ার সমস্ত কর্পোরেট যে কোন অজুহাতে পৃথিবীর স্থল, জল , আকাশ দখল করতে লেগে গেছে । অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক এই বিষয় গুলো এই কর্পোরেট বিশ্ব ইচ্ছা করেই চায় না যে মানুষ বুঝুক । বুঝলেই তো শুভংকরের ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে । খুব খেয়াল করে দেখবেন , দেশের আইন ও রাষ্ট্র পরিচালনার বই গুলা সবচাইতে কঠিন ভাষায় লেখা থাকে । এমন বাংলায় লেখবে যে স্বয়ং বঙ্কিম ঐ বাংলা পড়লে যমুনা ব্রিজের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে চাইবে , ' কিছুই বুঝি নাই' , সেই লজ্জায় ।

এখন কথা হইলো , এত কঠিন করে লেখে কেন ? আপনি যাতে না বুঝতে পারেন। বহুদিন ধরে বহু কিছু বুঝার চেষ্টা করে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে । আগের দিনে , ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ কিতাব বা পুঁথি পাঠ করার অনুমতি পাইতো না। কেন? কারণ তারা জানতো জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই ক্ষমতা । সুতরাং, এই জ্ঞানকে শুধুমাত্র নিজেদের গোষ্ঠীর ভিতরে আটকে রাখো ।

তাহলে যুদ্ধবাজ ক্ষত্রিয় ( পড়েন আমেরিকান সেনাবাহিনী) , নম্র ( হেলথ, ডেভেলপমেন্ট , এন জি ও ) , বৈশ্য ( জগতের সকল ব্যবসা) , শূদ্র (মুচি – মেথর- ডোম) সবাইকেই নিয়ন্ত্রন করা যাবে । মানুষ যখন চালাক হয়ে গেলো , তখন কর্পোরেট পুঁজিবাদীরা বুঝে গেলো , বই পড়া বন্ধ রাখা যাবে না , মানুষ আন্দোলন করছে , তখন তারা নয়া বুদ্ধি বের করলো। ১। অর্জিত জ্ঞান সবটুকু বাজারে ছাড়া যাবে না । ততটুকুই ছাড়া হবে যতটুকু ছাড়লে ব্যবসার ক্ষতি নাই ।

২। সহজ সরল জ্ঞান যেইটারে লুকানো সম্ভব না সেই বিষয়টারে এমন প্যাঁচায়ে ফেলতে হবে যাতে কেউ পড়লেও কিছুই না বুঝে । এই জন্য অর্থনীতি মানেই আজকাল গ্রাফ, কার্ভ, অংকের সূত্র । যারা ধর্ম বেচে পেট চালায় তারা কেউ বাংলায় ধর্ম পড়াইতে রাজি না । বাংলাতে পড়ালেই আপনি বুঝে ফেলবেন।

বুঝে ফেললেই প্রশ্ন করবেন । প্রশ্ন করলেই ধরা পড়ে যাবে , যা কিতাবে আছে তা হুজুরে নাই, যা হুজুরে আছে তা বাস্তবে নাই । এই কিতাবের জ্ঞান, হুজুরের অনুবাদ আর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা গুলাতে গরমিল গুলা ধরা পড়তে শুরু করলে হুজুরদের ব্যবসা লাটে উঠতে বাধ্য । তাই কর্পোরেট হুজুররা চায় না কেউ তার নিজের ভাষায় , নিজের মত করে , সহজ সরল ভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি, বাণিজ্য , উৎপাদন – সবচেয়ে বড় কথা কর্পোরেট পুঁজিবাদ জিনিসটা বুঝুক। বৃটিশদের কথা মনে আছে ? তারা ঐটুকুই শিক্ষা দিত , যতটুকু শিক্ষা দিলে বেকুব কেরানী বানানো যায় ।

বাংলাদেশের সেই বৃটিশ আমলের কেরানি বানানোর শিক্ষানীতি আজো পাথর গেড়ে বসে আছে । গোড়ার গলদ দূর না করে প্রতি বছর বিদেশী কর্পোরেট হুজুরেরা বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি শিক্ষা ঋণ দেয় যাতে আমরা শিক্ষা নীতিটাকে না বদলায় একটা মরা হাতির হাত , পা, দাত ঠেলা ঠেলি করি আর ভাবি এত দামি হাতিটা নড়ে না কেন? কাজ করে না কেন? শিক্ষানীতিকে না বদলানোর জন্য শিক্ষা সেক্টরে বিলিওন ডলারের ঘুষ আর জামায়াতের শিক্ষানীতির বিরোধিতার এই হলো আসল কারন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার, আপনি হয়ত হার্ভার্ড, ইয়েল কিংবা বাংলাদেশের আই বি এ বসে মার্কেটিং শিখলেও আপনাকে এইটাই শেখানো হবে, মার্কেটিং এর কাজই তো হইলো ফলস ডিমান্ড তৈরী করা। বিশ্বের অথবা বাংলাদেশের সেরা ছাত্ররা, সেরা সেরা মাথা, যখন ব্রেইন ওয়াশড হয়ে ফিরে এসে আপনাকে বুঝাবে , মার্কেটিং করবে , আপনি বিশ্বাস না করে যাবেন কই? কর্পোরেট পুঁজিবাদের সূক্ষ কারচুপি করা , এইটা ঠেকাতে হলে কি করতে হবে ? পড়তে হবে। চক্ষু মেলে দেখতে হবে।

চিন্তা করতে হবে। চিকেন ফ্রাই যেইটা বসে গিলতেছি সেইটা কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো, কার হাত দিয়ে এলো, কে কত লাভ করলো , কার ক্ষতি হইলো? এই সব ভাবতে হবে। মোবাইল যেইটা সারাক্ষণ ব্যবহার করি , সেইটা একটা বাংলাদেশে বসে বানাইতে পারি না কেন? ভাবতে হবে। আমরা খালি এর কাছ থেকে , ওর কাছ থেকে কিনি , নিজেরা উৎপাদন করি না কেন? ভাবতে হবে। আমাদের চারিপাশে আমরা যা কিছু দেখি, সেই সব সম্পদ ও পণ্যের আসল মালিক কে ? ভাবতে হবে।

আজকে যদি হঠাৎ করে দুনিয়াশুদ্ধ সবার চাকরী এক সাথে চলে যায় , সবচেয়ে বেশি ভাবতে হবে , আপনি কোন মরার দলে, সবার আগে না সবার শেষে ? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর আপনি তখনই পাবেন, যখন আপনি সম্পূর্ণ সচেতনতার স্তরে থেকে মুক্ত ভাবে চিন্তা ভাবনা করতে পারবেন, নিজেকে বুঝতে পারবেন আর সর্বগ্রাসী মিডিয়াকে ঠেকানোর এইটাই একমাত্র উপায় । পরের পর্বে , কি ভাবে আপনি অর্জন করবেন সেই সচেতনতা যা দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতা কিংবা কর্পোরেট পুঁজিবাদিতায় আক্রান্ত মিডিয়াকে ঠেকানো যায়?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.