আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
কুড়িল ফ্লাইওভার চালু হবার পর এলাকাটা ঘুরতে খুব মজা লাগে। যদিও এখনো রাস্তার অনেক কাজ বাকি কিন্তু ফ্লাইওভারের ওপর থেকে যখন উড়াল পথে পেঁচিয়ে থাকা গোটা এলাকাটা চোখে পড়ে, তখন বেশ লাগে এটা ভাবতে যে, বিদেশে নয়, দেশে থেকেও এমন আধুনিক শহর-সুলভ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। উড়াল-সড়কটির একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে আবার বিমানবন্দরের উড্ডয়নের রানওয়েটা চোখে পড়ে। ভাগ্যবান হলে সেই বিশেষ স্থানটি থেকে একজন দেখতে পাবে, ধাতব ডানায় ভর করে মানব নির্মিত দানবীয় পাখিটি কিভাবে ভেসে পড়ে বাতাসে। যেহেতু এই এলাকাটা হয়ে প্রতিদিন অন্তত দুইবার যাতায়াত করি, তাই জানি যে ফ্লাইওভারটি চালু হয়ে যাওয়ার পর, অনেক মানুষের কাছ থেকে তপ্ত বিকেলগুলো কাটানোর আরও একটি জায়গা কমে পেল।
ফ্লাইওভারটির কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, তখন এটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে। তারা সেটাতে উঠে ঘোরাফেরা করত, রেলিংয়ে বসে বাদাম চিবত আর শিশা ভরা বাতাস খেত। অনেকে অবশ্য গাড়িঘোড়ার চলাচলে ব্যস্ত হয়ে ওঠা স্বত্বেও, এখনো ফ্লাইওভারটির ডিভাইডার কিংবা পাশের রেলিংটিতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসে থাকে। জীবন-বাতাস বেরিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকলেও, বাতাস খাওয়া চাই।
মিরপুর ফ্লাইওভার হয়ে মিরপুর ডিওএইচএস কিংবা কালশি যাওয়ার রাস্তাটার কিনারে বসেও অনেকে বিকেলটা কাটায় আর নিশ্চয়ই প্রাণপণে অদূরের দালানকোঠা দ্বারা বেষ্টিত নোংরা সবুজ পানিতে ভরে থাকা নিচু-জমিটাকে পাহাড় ঘেরা লেক হিসেবে কল্পনা করতে থাকে।
ছোট ময়লা খেকো মাছ, ব্যাঙাচী, পোকামাকড়ের হুটোপুটিতে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় পানিতে, সেটা দেখতে যে পয়সা দিতে হচ্ছে না এইতো বেশি! অবশ্য আর তো কয়েকটা দিন। অচিরেই নিচু-জমিগুলো ভরে বড় বড় দালানকোঠা তৈরি করা হবে সেখানে। এটা আশ্বস্ত করে সেখানে সাইনবোর্ডও লাগানো আছে বিশাল বিশাল।
রাজধানীর উপকণ্ঠে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আরেকটা চমৎকার ঘুরতে চাওয়ার জায়গা আছে। বাউনিয়া।
বাউনিয়ায় (দলিপাড়া), রানওয়ের সীমানার দেওয়াল সংলগ্ন একটা স্থানে এদিক ওদিক বসে মানুষজন বিমান অবতরণ দেখে আর চটপটি, ফুচকা খায়। গিয়ে এক বাটি ফুচকা কিনে দুই-তিন পিস মুখে দিতে না দিতেই যে অবতরণের খেলা দেখাতে বিমান চলে আসবে, তা কিন্তু না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ! ভাগ্য ভাল হলে কিংবা রাতের দিকে গেলে (রাতে যাওয়া নিরাপদ নয়), দানবীয় আকারের বিমানগুলোর প্রলয়ঙ্করী অবতরণের দৃশ্য দেখা যেতে পারে। যখন কোনও বিমান অবতরণ করে, তখন এত ধুলাবালি ওড়ে যে জামার ভেতর ঘর্মাক্ত শরীর বালুতে মাখামাখি হয়ে যায়। চটপটি, ফুচকা দাঁতের মাঝে বালিতে কিচকিচ করে।
আবার বালিতে কিচকিচ করতে থাকা সেই দাঁতগুলোই খুশিতে চমৎকার বেরিয়ে পড়ে যখন আকাশ কোণে অবতরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকা কোনও বিমানকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে দেখা যায়।
তবে আশুলিয়ার সৌন্দর্যের কাছে, উড়াল পথ, দালানকোঠায় পরিবেষ্টিত সবুজ পানির লেক, কিংবা বাউনিয়া নামক ধাতব পাখি দেখার স্থানটি কিছুই না। উত্তরা থেকে যেতে বেড়িবাঁধ বরাবর বাম দিকের খোলা জায়গাটা, শরৎকালে কাশফুলে ভরে গিয়ে অপূর্ব এক মেঘ-শুভ্র রূপ ধারণ করে! রাস্তাটা দিয়ে দ্রুতগতির কোনও যানে চড়ে যাওয়ার সময় মনে হবে যেন উড়ে চলেছি, আর পাশে সাদা মেঘ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে! রাস্তাটার ঠিক অপর পাশটা, বর্ষাকালে নদীর পাড় ছাপিয়ে প্লাবিত হলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে! ইটের ভাটার চিমনীগুলোকে বিবেচনায় আনা গেলে মনে হবে, যেন ভরা যৌবনা কোনও নদী! সন্ধ্যে বেলা সূর্যটা যখন পচ্চিম কোণে রঙের খেলা দেখায়, তখন আকাশটাকে প্রতিবিম্বিত করা প্লাবিত এলাকাটাকে ‘মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ’* বলে মনে হয়। তবে রাস্তার ধারে বসে এই দৃশ্য অবলোকন করতে যাওয়ার প্রয়াস কিন্তু বিপদজনক। আমি নিজের চোখে দেখেছি মোটর বাইক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার বাইক ও বান্ধবী সমেত কিভাবে পানিতে গিয়ে পড়েছিল।
রাস্তার কিনারে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকা একজনকে সাথে নিয়ে এই চিতপটাং খাওয়াটা মোটেও অসম্ভব ছিল না। তবে এই বিপদজনক অপূর্ব সুন্দর জায়গাটাও আর থাকবে না। থাকবে না কাশফুলে ছেয়ে যাওয়া সাদা-মেঘের আকাশের মত দেখতে খালি প্রান্তরটাও। সাইনবোর্ড লাগানো আছে। এই জমি অমুক গ্রুপের, এই নদী তমুক লোকের (“নদী” কথাটা অবশ্য বলে না।
একটা লজ্জা-সরমের বিষয় আছে না?)।
ভাবছি, তারপর কোথায় যাবে মানুষগুলো? ঘুরতে যাবার জায়গা গুলো কিন্তু ইতিমধ্যেই কম বিলুপ্ত হয়নি! তবুও কিছু বাকি থাকায়, কিভাবে কিভাবে যেন মানুষ সেগুলো খুঁজে নিয়েছে। ভবিষ্যতে উঁচু উঁচু দালানকোঠার পেটে চলে গিয়ে একটি জায়গাও যখন আর বাকি থাকবে না, তখন সরকারীভাবে টিকিটের বিনিময়ে হলেও, বহুতল বিশিষ্ট দালানগুলোর ছাদে ওঠার ব্যবস্থা করে দিবে তো? নইলে আমরা বাতাস খাব কিভাবে? এয়ার টাইট ক্যানে করে বিশুদ্ধ বাতাস বাজারে বিক্রি হবে কি? নদীর পাড়ের বাতাস ২০টাকা, খোলা মাঠের বাতাস ১৯ টাকা ৯৯ পয়সা?
http://www.notun-din.com/?p=6777
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।