আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘জীবন্ত কিংবদন্তী’ জননেতা জ্যোতি বসুর জীবনাবসান


১৭ই জানুয়ারি-জননেতা জ্যোতি বসুর জীবনাবসান হয়েছে। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’ কমরেড জ্যোতি বসু আর নেই। সি পি আই(এম)-র সূচনাপর্বে ‘নবরত্ন’ নেতৃত্বের শেষতম জীবিত ব্যক্তিত্ব রবিবার বেলা ১১টা ৪৭মিনিটে আমাদের ছেড়ে গেলেন। তাঁর জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটলো ইতিহাসের একটি কালপর্বের, যিনি নিজে সবসময় বলতেন, মানুষই ইতিহাস রচনা করে। অথচ যাঁর গোটা জীবনটাই মানুষের স্বার্থে গণ-সংগ্রামের নিকষ কষ্টিপাথরে পরিণত হয়েছে ইতিহাসে।

পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে যার হাতেখড়ি, স্বাধীনোত্তর ভারতে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যা পরিণত। নেতৃত্বের প্রথম সারিতে থেকে উত্তাল গণ-আন্দোলনের তীক্ষ্ণতায় পশ্চিমবঙ্গকে সারা দেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামে অগ্রবর্তী ঘাঁটি হিসাবে যিনি গড়ে তুলেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে কিভাবে সংসদ-বহির্ভূত গণ-আন্দোলনের ভাষাকে মূর্ত করে তোলা যায়, যার অনুকরণীয় অনন্য উদাহরণ তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সংসদীয় জীবন। গোটাদেশে উত্থিত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যিনি ছিলেন নেতৃত্বে, নিজরাজ্যে সম্প্রীতির দূর্গ গড়ে তুলে। যিনি জীবনের শেষ লগ্নেও সোচ্চার ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে পদলেহনকারী নীতির বিরুদ্ধে।

তাঁর নেতৃত্বেই পশ্চিমবাংলা জনস্বার্থে প্রণোদিত ভূমিকায় জাতীয় স্তরের সীমানা ছাড়িয়ে একইসঙ্গে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়বস্তু এবং গণ-আন্দোলনে প্রেরণার উৎসে। তিনি বলতেন, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কমিউনিস্টদের মানুষের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে। নিজের জীবনের মধ্যে দিয়েই সেকথা প্রমাণ করে গেছেন তিনি। আর মানুষও তাঁকে সেই কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন অকৃপণভাবে। জীবিত অবস্থায় এই কিংবদন্তী নেতা যেখানেই গিয়েছেন, উদ্দাম জনস্রোতে তাঁর পথ গিয়েছে ভেসে।

আর অগণিত মানুষের স্রোতের মধ্যে দিয়েই এদিনও হাসপাতাল থেকে শেষ বিদায় নিলেন তিনি, টানা ১৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর, যা বারেবারে স্মরণরেখায় উদ্‌ভাসিত করেছে তাঁর লড়াকু সংগ্রামী অতীতকে। সংরক্ষণের জন্য ‘পিস হাভেন’-এ তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময়েও রাস্তার দু’পাশে শুধুই মানুষ। মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদান করে গেছেন বসু। আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী মঙ্গলবার সরকারী মর্যাদায় জ্যোতি বসুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে এস এস কে এম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে তাঁর মরদেহ তুলে দিয়ে। তার আগে হবে বিধানসভা ভবনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং সেখান থেকেই শুরু হবে শেষযাত্রা।

সোমবার রাজ্য সরকারের সমস্ত দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের সর্বত্র সি পি আই (এম)-র দপ্তরে অর্ধনমিত থাকবে রক্তপতাকা। গত ১লা জানুয়ারি, নতুন বছরের প্রথম দিন সন্ধ্যায় বিধাননগরের একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যোতি বসু। ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন প্রবীণ জননেতা। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ভর্তি করা হয়।

এর আগেও তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে সুস্থ হয়ে আবার বাড়ি ফিরে গেছেন। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন মানুষ। এবারও তাই আশা ছিল তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। যদিও পিত্তরসের প্রদাহে নিয়মিত ভূগতেন তিনি, ইংরাজিতে যাকে বলা হয় ‘ইরিটেবল্‌ বাওয়েলস্‌ সিনড্রোম’।

২০০০ সালের ২৮শে জুলাই দিল্লিতে সি পি আই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীন তিনি একবার আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে দিল্লির রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। সাম্প্রতিক সময়ে দু’বার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর গভীর রাতে বাড়িতে বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন বসু।

তাঁর মাথায় তখন চোট লেগেছিল। চিকিৎসকদের পরামর্শে ৭ই সেপ্টেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে দশদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। তখন থেকেই একজন নিউরোলজিস্ট, একজন কার্ডিওলজিস্ট এবং একজন জেরিয়াট্রিসিয়ানকে নিয়ে গঠিত চিকিৎসকদের একটি দল বসুর স্বাস্থ্যের নিয়মিত দেখাশুনা করছিল। বাড়িতেও ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পরে আবার অসুস্থতার জন্য ২০০৯ সালের ১২ই জুলাই থেকে ৭ দিনের জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তারপর থেকে তাঁর আর কোনো বড় ধরণের অসুস্থতা হয়নি। গত ৮ই জুলাই বসু ৯৬ বছরে পা দিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী কমল বসু কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন। একমাত্র ছেলে এবং নাতি-নাতনিসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।

আর রয়েছেন তাঁকে ভালোবাসেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা উদ্বেলিত হতেন আন্দোলনের ময়দানে তাঁর বক্তব্যের তীক্ষ্ণতায়, প্রতিটি মন্তব্যে, বাক্যবিন্যাসে। হাসপাতালে জ্যোতি বসুর চিকিৎসার জন্য প্রথমে পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যায়ল বোর্ড গঠিত হয়েছিল। পরে অবশ্য তা সম্প্রসারিত হয়। চিকিৎসকরা তাঁর মাঝারি ধরণের নিউমোনিয়া হয়েছে বলে জানান। তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণও ধরা পড়ে।

চিকিৎসায় বসুর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতিও হচ্ছিলো। কিন্তু গত ৬ই জানুয়ারি ভোররাতে তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণে বসুকে ভেন্টিলেশনে নিয়ে যেতে হয়। ৭ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বসুকে দেখতে এসে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন। পরদিনই প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের যৌথ ব্যবস্থাপনায় নয়াদিল্লির এইমস্‌-এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে বসুর চিকিৎসার বিষয়ে আলোচনা করে তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিক্যারল বোর্ড। ৯ই জানুয়ারি সকালে জ্যোতি বসুর অবস্থার আচমকা অবনতি ঘটে।

যদিও পরদিন বসুর স্বাস্থ্যের অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়। তারপর থেকে ১৩ই জানুয়ারি পর্যন্ত অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। কিন্তু সেদিন রাত থেকে আবার অবস্থার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। এইমস্‌-র বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া হয়।

শুক্র ও শনিবার কার্যত দিন-রাত হাসপাতালে থেকে তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিক্যা ল বোর্ডের সদস্যরা চেষ্টা চালান। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে এদিন সকাল ১১টা ৪৭মিনিট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যা গ করলেন। হাসপাতালে তখন উপস্থিত সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিমান বসু, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ পার্টি নেতৃবৃন্দ। মৃত্যুসংবাদ ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে চলে আসেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত। চলে আসেন অন্যা ন্য নেতারা, বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং অবশ্যই হাজার হাজার মানুষ।

প্রকাশ কারাত ও বিমান বসু রক্তপতাকা দিয়ে মুড়ে দেন তাঁর মরদেহ। এখান থেকে বসুর মরদেহ ‘পিস হাভেন’-এ নিয়ে যাওয়া হয় সংরক্ষণের জন্য। এদিকে, মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরই সি পি আই (এম) রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনেও আসতে থাকেন বহু মানুষ। অবিরত স্রোতের মত আসতে থাকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শোকবার্তা ও টেলিফোন। বিকালে বসে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর জরুরী বৈঠক।

বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানান তাঁর শোক। সম্পাদকমন্ডলীতে গৃহীত শেষযাত্রার সূচী ঘোষণা করেন বিমান বসু। শোক জানান প্রকাশ কারাত। পার্টির রাজ্য দপ্তরেও খোলা হয়েছে শোকজ্ঞাপক পুস্তিকা।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।