যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।
ওয়ান ইলেভেন (দ্বিতীয় পর্ব)
খট্ খট্ করে দূর থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে। এক সাথে কয়েকটি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। ঢাকা নগরীর পশ্চিমে শায়েস্তা খাঁ নির্মিত এই তোরণের ভেতর দিক থেকে শব্দটি আসছে।
তার মানে এই তোরণ দিয়ে কোন ঘোড়সওয়ার বের হবে। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে আমি তোরণের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এখন পর্যন্ত ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাইনি। কারণ আমার বায়োমেট্রিক আইডি কার্ড নেই। ওয়ান ইলেভেনের আগে এই আইডি কার্ডের প্রচলন ছিল না।
ঘোড়ার খুরের শব্দে সচকিত হই। শব্দের উৎসের সন্ধানে কান পাতি। আসলে কান পাতি না বলে আমার 'অরগ্যান অব হিয়ারিং সক্রিয় করি- বললেই মানাবে ভালো। কারণ ওয়ান ইলেভেনের প্রচণ্ড আক্রোশে আমি যখন মৃত গণতন্ত্রের ন্যায় রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম আমার চোখের মত কান দুটোর উপর দিয়েও প্রচণ্ড ক্ষোভ বয়ে গিয়েছিল। একদল উন্মত্ত লোক পেরেক ঠোকার মত করে কানের এক ছিদ্র দিয়ে লাঠি ঠুকে অপর দিক দিয়ে বের করে দেয়।
আমি গণতন্ত্রের মৃত্যুযন্ত্রণার শেষ চিৎকারটুকুও শুনতে পাই না।
আচ্ছা! তখন কি আমি চিৎকার করে বলতে চেয়েছিলাম, "হে বিক্ষুব্ধ মানুষগণ! তোমরা এতটা নিষ্ঠুর হইও না। তোমরা নৃশসংতা বন্ধ করো। গণতন্ত্রের নামে এই হানাহানি বন্ধ করো। " আমার তা বলা হয়ে উঠে কিনা জানিনা।
কারণ উন্মত্ত মানুষগুলো আক্রোশে আমার কন্ঠনালীকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বসের এই ল্যাবরুমে আমাকে যখন সাইবর্গ ম্যান হিসেবে বাইনারি ডিজিটের ১ এবং ০ সমন্বয়ে পুনর্জীবন দেওয়া হয়, কানের মতোই দেখতে একটি বিশেষ ডিভাইস বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কানের জায়গায়।
শায়েস্তা খাঁর তোরণের পাশে থেকেই আমি অনুমান করার চেষ্টা করি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আসছে কোথা থেকে। তবে কি শায়েস্তা খাঁ ফিরে আসছেন অতীত ভ্রমণ শেষ করে! কিন্তু ২০১০ সালের ওয়ান ইলেভেনের এই তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে তিনি কোথা থেকে আসবেন! প্রচণ্ড যুক্তির তোড়ে আমার অনুমান শক্তি ব্যাহত হয়। আমার স্থায়ী মেমোরি ঘেঁটে যা দেখতে পাই তা হচ্ছে, ওয়ান ইলেভেনের দিনগুলোতে হঠাৎ করে যখন চালের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে, জনগণকে তখন শায়েস্তা খাঁর আমলের গল্প শোনানো হয়।
সেই থেকে আমি শায়েস্তা খাঁকে নিয়ে ভাবতে থাকি। ১৬৬৪ সাল থেকে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত শাসন করে যাওয়া বাংলার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সুবাহদার শায়েস্তা খাঁ। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে নগরীর পশ্চিম তোরণে পণ্যের সস্তা মূল্য প্রদর্শনকারীর জন্য তোরণ উন্মুক্ত করার যে বাণীটি উৎকীর্ণ করে গেছেন, তা সযত্নে বাংলাপিডিয়ায় সংরক্ষণ করে আমার স্থায়ী মেমোরিতে রেখে দিয়েছি।
আমার অনুমান শক্তি তেমন ভাল না। মানুষের মতো করে আমি ভাবতে পারি না।
কারণ আমার মস্তিষ্কের বেঁচে যাওয়া ১৯৬ মিলিয়ন নিউরন পুরো মানব মনের রহস্য ভেদ করে উঠতে পারে না। মানব মস্তিষ্কে কমবেশি ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে। ওয়ান ইলেভেনের ধাক্কায় মরতে মরতে বেঁচে ওঠা মাত্র ১৯৬ মিলিয়ন নিউরনের পাশাপাশি বাকি নিউরনের ঘাটতি পূরণ করছে প্রোগ্রামিং করা নিউরন গুলো। আমার সাইবারনেটিক অরগ্যান গুলো বেশি সক্রিয়, তাই আমি সাইবর্গ ম্যান। বসের ল্যাবরুমে সাইবর্গ ম্যান হয়ে জন্মাবার পর থেকে বাইনারি ডিজিট ১ এবং ০ নিয়েই আমার জগত।
তাই ঘোড়সওয়ার সম্পর্কে আমার অনুমান সত্য হয় না।
আরে! আরে!!
এ যে দেখি সেই ছয়টি ঘোড়া!
সেই নাদুস নুদুস ঘোড়াগুলোর একি হাল হয়েছে! কী তাগড়া ছিল ঘোড়াগুলো। ৪টি মেয়ার আর ২টি স্ট্যালিয়ন প্রজাতির। আমার স্থায়ী মেমোরি বলছে ২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের ইন্ডিয়া সফরের সময় ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী বন্ধুত্বের নির্দশন স্বরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ৬ টি ঘোড়া উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ৬ জন সামরিক উর্দিপরা অশ্বারোহী ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে শায়েস্তা খানের এই গেট দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করেছিল।
সামরিক উর্দিপরা গেটম্যান স্যালুট দিয়ে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়েছিল। ভেতরে প্রবেশ করে ৬ অশ্বারোহী ৬ বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে।
কোটি টাকা মূল্যের ৬ টি ঘোড়া শায়েস্তা খানের এই গেটের কাছে থেমেছে। একে একে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অশ্বারোহীরা। তাদের অবয়বে ক্লান্তির চিহ্ন।
ওয়ান ইলেভেনের দিনগুলোতে শায়েস্তা খাঁর এই গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্রায় ২ বৎসর দাপিয়ে বেড়িয়েছে সারা বাংলা। ক্যান্টনমেন্টের সুরক্ষিত আবাস ছেড়ে ৬ বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড বিক্রমে। তারপর বিশৃঙ্খল দেশকে শৃঙ্খলায় আনতে সে কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! পণ্যমূল্যকে কমিয়ে আনার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে। একসময় নিজেরাই চাল-ডাল-আলু-পটল নিয়ে বাজারে নেমে পড়েছে বিক্রয় করবে বলে। কিন্তু শায়েস্তা খাঁর আমল আর ফিরিয়ে আনা যায়নি।
পরিশেষে ঘোড়া ছয়টিকে ফিরিয়ে নিয়ে উল্টো পথে যাত্রা।
ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে এই তোরণ দিয়ে অনেক শস্যমূল্য সন্ত্রাসী, পণ্যমূল্য সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত প্রবেশ করেছে। কিন্তু শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগের সময় এই তোরণে স্পষ্ট করে লিখে গিয়েছিলেন- 'পণ্যের সস্তামূল্য প্রদর্শনকারীরা এই তোরণ উন্মোচন করবেন। ' তিন তিনটি ওয়ান ইলেভেন পার করে দিয়েও এরকম কাউকে প্রবেশ করতে দেখিনি। আমি আশায় আছি এই তোরণ দিয়ে পণ্যদ্রব্যের সস্তামূল্য প্রদর্শনকারী কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখবো।
এ আশায় আমি শায়েস্তা খাঁর তোরণের ও পাশে তিন তিনটি ওয়ান ইলেভেন পার করে দিয়েছি।
আজ ১৯ জানুয়ারি, ২০১০ সাল। তিন বছর আগে এই দিনগুলোর প্রত্যেকটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক অন্যরকম এক আশার সঞ্চার করে বিরাজ করছিল। ওয়ান ইলেভেনের আগে রাজনীতির প্রচণ্ড রোষানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যত। রাজনীতির নানান ফর্মূলাকে ব্যর্থ করে দিয়ে পলিটিশিয়ানরা পলিটিক্সকে আরও জটিল করে তোলে।
এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে আসে ওয়ান ইলেভেন।
আমি ওয়ান ইলেভেনের সন্ধানে শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের বাইরে দাঁড়িয়ে নিউরাল ভ্রমণ করছি। ওয়ান ইলেভেন কেন হয়- তা বের করার জন্য বস আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সমস্ত সমস্যার বোঝা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে বস নির্দেশ দিয়েছেন সমাধান বের করতে মূলের সন্ধান করার জন্য। আমি রমনার বটমূল থেকে মূলের সন্ধান শুরু করেছি।
দারিদ্র্যের মূল, দুর্নীতির মূল, সামাজিক অবক্ষয়ের মূল- এগুলোরও সন্ধান করছি। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার বর্গমূল ৮। এই মূলের ৮ শ্রেণীগোষ্ঠীর যারা শায়েস্তা খাঁর এই তোরণ দিয়ে প্রবেশ করবে তাদের সবার মূলের সন্ধান আমাকে করতে হবে। আমি মনে মনে এই শ্রেণী গোষ্ঠীর একটি তালিকা করতে থাকি...
কৃষি উৎপাদনকারী- যারা শুধু কৃষিপণ্য, হস্তজাত শিল্প পণ্য উৎপাদন করেই জীবিকা নির্বাহ করে।
মৎস্যজীবী- যারা শুধু মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে।
শ্রমিক- যারা বিভিন্ন শিল্প, পরিবহন কিংবা নির্মাণ কাজে শ্রম দিচ্ছে।
চাকুরিজীবী- যারা সরকারি বেসরকারি চাকরি করে, শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করে।
আত্ম কর্মসংস্থানকারী- যারা নিজেই ছোটখাট কোন ব্যবসায় করে বা উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে।
শিক্ষার্থী- জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ যারা শুধু পড়াশুনা করে, উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকে না।
বেকার- শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কর্মহীন জনগোষ্ঠী, যাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রবাসী- যারা অন্য দেশে নিজের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিয়ে দেশে রেমিটেন্স পাঠায়।
জনগোষ্ঠীর এই আট শ্রেণীকে পরিচালনা করছে কারা তার একটি তালিকাও করতে হবে। পরিচালনার ত্রুটির কারণেই বাংলাদেশের এত এত সমস্যা। এত সমস্যার ভিড়ে আমি ঠাঁই খুঁজে পাই না। আমার মস্তিস্কের ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল সংকেত বোঝা নিউরনগুলো বিশ্রামে যেতে চায়।
বেশি ভাবনা মাথায় আসলেই মস্তিষ্কে জট লেগে যায়। বস এই মাত্র "বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি" জানতে চেয়ে একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। আমি এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আবারও ভাবনায় ডুবে যাই...।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।