জানি না কেন লিখি! তবু লিখি মনের খেয়ালে, পরিবর্তন করার মানসে, পরিবর্তিত হওয়ার মানসে। যদিও জানি সব ব্যর্থ হচ্ছে। তবুও আমি আছি সেদিনের সেই আলোকময় প্রত্যুষার আগমনের অপেক্ষায়
খুব পুরনো গল্প। সবারই জানা। কিন্তু গল্পটির আবেদন এখনো হারিয়ে যায় নি বলেই মনে হয়।
চিরচেনা, চিরন্তন এ গল্প। মূল গল্পটি এ রকম:- একদিন এক ঝর্ণায় গিয়ে একটি খরগোশ পানি খাচ্ছিল। উপর থেকে এক সিংহ নেমে এল। তার অভিপ্রায় খরগোশকে সে খাবে। কিন্তু এর জন্য কোন একটা ছুতা দরকার।
শত হলেও একেবারে কোন ছুতা ছাড়া তো আর খাওয়া যায় না। সিংহ খরগোসের কাছে এসে বললো, এই তুই আমার পানি ঘোলা করেছিস কেন? আমি তোকে খাব। খরগোশ বললো, আমি তো ঝর্ণার নিচের দিকে ছিলাম। আপনিই তো উপরে ছিলেন। আমি ঘোলা করলে তো আপনার ওদিকে ঘোলা হওয়ার কথা নয়।
যুক্তিতে সিংহ হেরে গেল। কিন্তু হেরে গেলে তো আর খাওয়া চলবে না। এবার সিংহ বললো, ওহ, ঠিক আছে। তুই করিস নি, কিন্তু তোর বাপ করেছে। অতপর: খরগোসের বাঁচার আর কোন উপায় রইল না।
গল্পটি পশু এবং জঙ্গলের সঙ্গে মানানসই হলেও বর্তমানে মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদকে আমেরিকার পছন্দ নয়।
সুতরাং তাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে। আরব বসন্তের নামে শুরু হোল বাশার বিরোধী আন্দোলন। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মী’ নামে একটি বিদ্রোহী গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের সূচনা করলো।
পশ্চিমা শাসকগণ তাদের সমর্থন, অর্থ ও সামরিক সাহায্য দিয়ে তাদের উৎসাহ জোগালো। দীর্ঘ দুই বছরের গৃহযুদ্ধে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ নিহত হলো আর ১৫ লাখ মানুষ উদ্ধাস্তু হয়ে পাশ্ববর্তী দেশুগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিল। সর্বশেষ বাশার বাহিনী ব্যাপক অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের হাত থেকে পূর্বে অধিকৃত এলাকা পুণরুদ্ধার করে। কোনঠাসা হয়ে পড়ে বিদ্রোহী বাহিনী। মান-সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব মোড়লদের।
তাদের ইগো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সিরিয়াকে ধ্বংস করতে হবে। সিংহের খরগোশ ভক্ষণ করতে যেমন ছুতা দরকার তেমনি একটি ছুতাও আবিষ্কার করলো তারা। ছুতাটি হচ্ছে বিদ্রোহ দমনে সিরিয়ার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। সংবাদে প্রকাশ এই রাসায়নিক অস্ত্রের হামলায় প্রায় ১৩শ মানুষ নিহত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বিদ্রোহ প্রায় নির্মূল করার সময়ে হঠাৎ বাশার বাহিনী কেনই বা রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে যাবে? তা যদি প্রয়োগ করতেই হোত তবে আরো অনেক আগে করতে পারত।
বিশেষ করে যখন সরকারি বাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীর ক্রমাগত হামলার মুখে কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল সেই সময়টাই ছিল তা ব্যবহারের উত্তম সময়। বিরোধীপক্ষ এই সময়ে এসে হঠাৎ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই রাসায়নিক হামলা নিজেরাই করে নি কি? নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করানোর এই নীতিটি তো একমাত্র মানুষই জানে। সামান্য এই ক্ষতির বিনিময়ে যদি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় তাতে দোষের কী?
যাই হোক, যুদ্ধে এটা ঘটতেই পারে। যুদ্ধের আরেক নাম কৌশল। কিন্তু প্রশ্ন হোল এই যুদ্ধের নেপথ্যে কারা কলকাঠি নাড়ছে? ইসরাইল, আমেরিকা, ব্রিটেন তো অনেক আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যেই সিরিয়ায় বাশার সরকার পতনে নেমেছে।
কিন্তু শেষ সময়ে সৌদি আরবের লাফালাফি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। এটা ঠিক যে শিয়া সুন্নী দ্বন্দ্বে সৌদি আরব বাশার সরকারের উচ্ছেদ করা চাইতেই পারে। অপরদিকে ইরান শিয়া প্রধান হওয়ায় বাশার সরকারের প্রতি সৌহার্দ দেখাতেই পারে। তবে যেহেতু ইরান এবং সৌদি আরবের সাথে আদর্শগত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান সেহেতু পুরনো বিরোধ এখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষই এখন মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে।
খবরে প্রকাশ সিরিয়ার মিত্র রাশিয়াকে সিরিয়ার সঙ্গ ছাড়তে সৌদি সরকার তেল বাণিজ্যে বড় ধরনের সুবিধা দেওয়ার নামে ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিল। ইতোমধ্যে সৌদি সরকার প্রায় ৭ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বিদেশী শক্তিগুলোকে উস্কানী দিয়ে সিরিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। সর্বশেষ তারা আরেকটি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে অপর বাহু মিশরে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং ইখওয়ানীদের উপর সামরিক অভিযানে প্রায় সহ¯্রাধিক যা ইখওয়ানের মতে ২ হাজার ২শতেরও অধিক মানুষ হত্যা করা হয়। এর পেছনেও উস্কানী ও ইন্ধনদাতা হিসেবে কাজ করেছে সৌদি আরব।
এ জন্য তারা শত কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছে মিশরের সেনাবাহিনীকে। অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুরসি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাথে সাথেই সৌদি সরকার মিশরের নব্য সামরিক সরকারকে শুভেচ্ছা জানায়। আর ঘুষ দেওয়া অর্থের ঐ অংশটি ছিল প্রাথমিক অংশমাত্র। এর পরে মুরসি সমর্থকরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে তাদের উপর সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হলেও সৌদি সরকার বিভিন্নভাবে সামরিক সরকারকে সমর্থন জানিয়ে তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখে। অন্যদিকে এ হত্যাকা-ে আন্তর্জাতিকমহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে এবং সামরিক সরকারকে চাপ প্রয়োগের প্রস্তাব করলে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে সৌদি সরকার।
ইরান শিয়া অধ্যুসিত হওয়ায় অনেক আগে থেকে শিয়া-সুন্নী নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। কোন আগ্রাসী শক্তি যদি ইরানকে আক্রমন করে তাহলে সৌদি আরব যে খুশি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন কি এখনো যে তারা পাশ্চাত্যকে এ কাজে উৎসাহিত করছে না তাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। অভিযোগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নেওয়া বিষফোঁড়া ইসরাইলের সাথে সৌদি রাজ পরিবারের রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। ফিলিস্তিনি ভূ-খ- দখলকারী এই দেশটি আরবদের এই অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগে নব বধুর কপালের টিপের আকৃতি থেকে বর্তমানে সারা মধ্য প্রাচ্যেকে গিলে খাবার উপক্রম সৃষ্টি করেছে।
যা তাদের সকলের জন্যই এক বিপদ মহা বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
খেয়াল করলে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি অস্থিরতার পেছনে হাত রয়েছে সৌদি আরবের রাজ পরিবারের। তাই সারা মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতির আকাশে সৌদি আরব উদিত হয়েছে খলনায়কের ভূমিকায়। অথচ পুরো মধ্যপ্রাচ্য এলাকাটাই মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চল। খুব কম সংখ্যক ভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে এখানে।
ইসলামের প্রবর্তক রসুলাল্লাহর জন্ম এই মাটিতেই। তাঁরই অনুসারীরা আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লেও এ দেশের মাটিকে অনেক পবিত্র জ্ঞান করে। এখানে রয়েছে বায়তুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর ঘর, পবিত্র ক্বাবা ঘরের উপস্থিতি। ক্বাবা হচ্ছে মোমেন মোসলেমদের ঐক্যের প্রতীক। মোসলেম উম্মাহ তার সমস্যা, পরামর্শ ইত্যাদির জন্য বৎসরে একবার এখানে উপস্থিত হন আরাফার ময়দানে।
পরিচালনার দায়িত্বে থাকে সৌদি সরকার। অথচ সেই মাটিতে বসবাসকারী আরবগণ আজ শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বে নিজেরা নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছে। তারা প্রতি বছর হজ্ব করতে যায় ঠিকই, কিন্তু তাদের ব্যবধান ঘোঁচে না। ঘরে ফিরেই একে অপরের বিরুদ্ধে লাগে। তবে শুধু যে ঘরে ফিরেই বিরুদ্ধে লাগে তাই নয়।
পবিত্র ক্বাবার প্রাঙ্গণেও এরা ঝগড়া করে, মারামারি করে। এই সুযোগকে ধুর্ত মোড়লরা কাজে লাগাবেই না কেন? ঘরের সমস্যায় যখন পরকে ডেকে আনা হয় তখন পর একটু সুবিধা গ্রহণ করবেই।
সব শেষে আরেকটি গল্প দিয়ে বিষয়টির ইতি টানি। যদিও গল্পটি থিসিস লেখার প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মনে হয় এর ব্যবহার আলোচ্য প্রবন্ধে বেমানান হবে না।
এক খরগোশ একটি গুহার বাইরে বসে লেপটপে কাজ করছে, এমন সময় একটি শেয়াল এসে জিজ্ঞেস করছে, “কিরে, কি করিস?” খরগোশ জানালো, “থিসিস লিখি। ” শেয়াল পাল্টা প্রশ্ন করলো, “ কি নিয়ে থিসিস?” জবাব এলো, “শেয়াল খাওয়ার সহজ উপায়। ” শেয়াল খুব অবাক হোল। প্রশ্ন করলো, “কি, খরগোশ কখনো শেয়াল খায়?” খরগোশ বললো, “বিশ্বাস হোল না, আমার সাথে এসো। ” খরগোশটি শেয়ালটিকে নিয়ে গুহার ভিতর গেলো, কিছুক্ষন পর একা ফিরে এলো এবং আবার লেপটপে কাজ করতে শুরু করলো।
একটু পর এক নেকড়ে আসলো ...।
নেকড়ে একই রকম প্রশ্ন কোরল। নেকড়ে খাওয়ার থিসিসের কথা শুনে সেও আগের শেয়ালের মত অবাক হোল। চালাক খরগোশ নতুন নেকড়েকেও গুহায় নিয়ে গেল এবং একা বের হয়ে এল। সর্বশেষ এলো একটি বেবুন।
বেবুনেরও একই প্রশ্ন এবং পরিণতিও একই।
সারা দিন কাজ করে সন্ধায় খরগোশটি লেপটপ বন্ধ করে গুহার ভিতরে গিয়ে দেখলো, গুহার একপাশে শেয়ালের হাড়, আরেক পাশে নেকড়ের হাড়, আরেক দিকে বেবুনের অর্দ্ধাংশ পড়ে আছে, আর একপাশে একটি সিংহ ঘুমিয়ে আছে।
গল্পটি এখানেই শেষ হলেও যদি দেখা যায় কোন দিন সিংহের জন্য খাবার সংগ্রহের কাজ ফুরিয়ে গেলে কিংবা কোনদিন আহার পর্যাপ্ত না মিলে, তাহলে একদিন বেলা শেষে সিংহ খরগোশকেই যদি খেয়ে ফেলে তবে অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে কি?
অনুরূপ বিশ্ব মোড়লরা যখন দেখবে তাদের সামনে ধ্বংস করার মত আর কোন দেশ নেই, তখন সৌদি আরব কি তাদের থাবা থেকে বাদ যাবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।