রঙ্গিলা বন্ধুরে....... i_mahmud2008@yahoo.com
ইসমাইল মাহমুদ
নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশবিদেশের প্রসিদ্ধ সুগ›িদ্ধ আগর ও আতর শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এখনই না নেয়া হলে এ শিল্প হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে বলে সংশি¬ষ্ট মহল মনে করছেন। মোঘল আমল থেকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিয়া,রাফিনগর,হাসিমপুর,চিন্তাপুর,বটতল,গ্রাম সহ আশপাশের গ্রামের কিছু কিছু ব্যক্তির আগর গাছের বাগান এবং পাথারিয়া বনাঞ্চলের গভীর অরণ্যে প্রচুর আগর গাছ ছিল। সুগ›িদ্ধ আগর ও আতরের সুনাম ও সমাদর সর্বত্র থাকলেও নানা প্রতিকুলতার কারণে আগর চাষ প্রায় হুমকির সম্মুখীন। ব্যক্তি উদ্যোগে সুজানগরে এ শিল্প কোন মতে টিকে আছে। আগর চাষের তথ্য অনুস›দ্ধানে জানা গেছে,আগর গাছ থেকে আগর কাঠ সংরক্ষণ করে কাঠ থেকে অতি মনোরম সুগ›িদ্ধপুর্ণ যে নির্যাষ পাওয়া যায় তাই আগর।
তবে আগর গাছ হলেই যে আগর আতর পাওয়া যায় তা ঠিক নয়। এ জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ করে যেতে হয়। প্রকৃতিক ভাবে আগর গাছ থেকে আগর কাঠ পেতে হলে ৩০-৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আগর গাছ সাদা রঙের নরম কাঠ। এই গাছ পূর্ণতা লাভের পর কাঠের অভ্যন্তরে ছত্রাক জাতীয় এক প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে কাল অথবা লালচে রং ধারন করে।
গাছের এ রোগাক্রান্ত অংশটুকুই মুল্যবান আগর নামে পরিচিত। তখন গাছের সাদা অংশ থেকেই কালো অংশটি আলাদা করে পৃথক করা হয়। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় নির্যাষ। এই নির্যাষ ছোট করে কেটে সপ্তাহখানেক পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এরপর দেনজ চোলাই পদ্ধতিতে অর্থাৎ ডেকচির মধ্যে পানি ও কাঠ রেখে তাপ দিতে হয়।
তাপ দিতে দিতে এক পর্যায়ে ডেকচির ভেতর সৃষ্টি হয় বাষ্প। এই বাষ্প একটি পাইপ দিয়ে পানি ভর্তি পাত্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে পাইপের মুখে একটি পাত্র বসিয়ে রেখে আতর সংগ্রহ করা হয়। ভাল ও এক কেজি নির্যাষ থেকে একতোলা আতর পাওয়া যায়। এছাড়া কৃত্রিম পদ্ধতিতে কম সময়ে আগর গাছ থেকেও আতর উৎপন্ন করা হয়। আগর গাছ লাগানোর পর যখন গাছের বয়স ৫ বছর হবে তখন গাছের গায়ে বড়বড় পেরেক গেথে দিতে হবে।
তারপর আরও ৪/৫ বছর অপেক্ষা করলে এসব গাছ থেকে নির্যাষ পাওয়া যায়। কৃত্রিম ভাবে প্রাপ্ত নির্যাষ ও দেশজ চোলাই পদ্ধতিতে আহরণ করে আতর পাওয়া যায়। ১কেজি আগর কাঠের দাম ২০০ টাকা থেকে ১ লাখ টাকা আবার ১ কেজি আতর ৫০০ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কথিত আছে আতর তৈরির সময় কারিগরদের অত্যন্ত পাক-পবিত্র থাকতে হয় নতুবা এদিক সেদিক হলে মাল(আগর কাঠ থেকে উৎপন্ন আতর) পাওয়া যায় না বলে কারিগররা অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করেন। অবিভক্ত ভারত বর্ষে বৃটিশ শাশনামলে বর্তমানে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে আগর ও আতর সংগ্রহ করে রপ্তানি করা হয়।
যেহেতু সুজানগর এলাকার আগর কাঠ ছিল তুলনামুলক উন্নত তাই আগর আতর ব্যবসায়ীরা এই এলাকায় তাদের ব্যবসা গড়ে তুলে এবং সুজানগর এলাকার ঘরেঘরে আতর নির্যাষ আহরণ করা হত। ফলে এই এলাকার মূল্যবান আগর গাছ দ্রুত বিলুপ্ত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তিলগ্নে এই গাছ গুলো প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী ভারতবর্ষ বিভক্তিরসময় আসামে গিযে স্থানীয় ভাবে আবার আতর উৎপাদন শুরু করে। আগর কাঠের অভাবে সুজানগরে অনেক ব্যবসায়ী এ ব্যবসা ত্যাগ করেন ।
আবার কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে কিঞ্চিত সংগ্রহ এবং আমদানী করে শিল্প চালাতে থাকেন । পাকিস্তানের আইয়ুব সরকারের শাসনামলে এক পর্যায়ে আগর কাঠের উপর নিষেধাঙ্গা জারি করা হলে এই শিল্প সম্পূর্ণ অবলুপ্তির পথে চলে যায়। অতঃপর স্থানীয় কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসাকে ধরে রাখেন। আগরের চাষাবাদ বৃদ্ধি এবং এ শিল্প কে রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের ব্যপারে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালেখির পর সরকারের নজরে আসে। ১৯৯৪-৯৫ সনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরীক্ষামুলক আগর চাষের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ।
এ সময় ২ হাজার ৫শ আগরের চারা রোপন করা হয় শ্রীমঙ্গলের মাগুরছড়া ও জুড়ীর লাঠিটিলা পাহাড়ে। ১৯৯৬ সালে সরকার এ দিকে দৃিষ্ট দেওয়ার পরে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার আগর গাছের চারা লাগিয়ে বনায়নের কাজ শুরু করে। ২০০০ সালে সরকার দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে আগর গাছ বনায়ন শুরু করে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ৪০ বছরের মধ্যে আগর বিলুপ্তির আশংকা কেটে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। এ পর্যন্ত ১১ টি পাহাড়ী এলাকায় ৩৫২ হেক্টরের মধ্যে ৩১৫ হেক্টরে ৩ লাখ চারা লাগানো হয়েছে।
অবশিষ্ট ৩৪ হেক্টরের মধ্যে চারা রোপনের কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে সংশি¬ষ্ট সূত্র জানায়। সিলেট বিভাগের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া,মাগুরছড়া,জারাকান্দি,বড়লেখা ও জুড়ী হবিগঞ্জের সাতছড়ি,চুনারুঘাট,রঘুনন্দন ও কালেঙ্গা এবং সিলেটের খাদিমপাড়া পাহাড়ি এলাকায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ লাখ আগরের চারা রোপন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে আগরের নির্যাষ থেকে আতর উৎপাদনের কারখানা রয়েছে বড়লেখার সুজানগর ও সিলেটের খাদিম নগরে। এর মধ্যে বড়লেখার সুজানগরে ৪০০ আতরের কারখানা রয়েছে। তবে স¤প্রতি বড়লেখার সুজানগর ছাড়াও উপজেলার অন্যান্য এলাকায় কয়েকটি আগর আতরের কারখানা গড়ে উঠেছে।
এর সব গুলোর কাচামাল ব্যক্তি উদ্যোগে চাষ করা হয়। সরকারি ভাবে এখনও কোন আগর কারখানা হয়নি। বড়লেখার সুজানগরে আতর কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৪ হাজার তোলা আতর সংগৃহিত হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫কোটি টাকা বলে আতর কারখানার মালিক বদরুল ইসলাম ছয়েফ উদ্দিন রেনু ,ইমান উদ্দিন,কবির আহমদ চৌধুরী প্রমুখ জানান। তবে স্থানীয় আগর আতর ব্যবসায়ীরা জানান প্রশাসনিক হয়রানির কারণে তারা নানা সময়ে বিভিন্ন প্রতিব›দ্ধকতার সৃষ্টি হয়।
এসব ব্যবসায়ীরা আরও জানান,আগর চাষে সরকার আরও উদ্যোগ নিলে এবং পৃষ্ঠপোষকতা সহ সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেয়া হলে ব্যক্তি উদ্যোগে আগর চাষ বৃদ্ধি পাবে এবং অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। শুধু তাই নয় এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষ হবে স্বাবলম্বী।
সুজানগর এলাকায় আগর গাছ উৎপাদনে সুপ্রসিদ্ধ ছিল এ গাছ উৎপাদনে কোন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু আগ্রহ এবং সরকারের সহযোগিতা। সরকারি পর্যায়ে পাথারিয়া এলাকায় পরিত্যাক্ত খাস জমিতে আগর গাছের চাষ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ আগর কাঠ সংগ্রহ করা যাবে পাশাপাশি আয় করা সম্ভব হবে কোটিকোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
বাঁচিয়ে রাখা যাবে ঐতিহ্যবাহী আগর ও আতর শিল্পকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।