অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
ক'দিন আগে স্বাধীনতার পরপরই নয় নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল সেই গ্রেপ্তারে তার সঙ্গী এবং ৯ নম্বর সেক্টরের স্টাফ অফিসার ওবায়দুর রহমান মোস্তফার বক্তব্যকে। কাহিনীর এবার আরেকটি সংস্করণ জানা যাক। বক্তা নজরুল ইসলাম। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে উনি যুদ্ধকালে জন সংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
ওসমানীর সঙ্গে ওঠা বসা, যুদ্ধের পরও তার অধীনে চাকরি করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর ওসমানীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতির সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যাটা তিনিই দিয়েছিলেন।
নজরুলের বয়ান মানলে আগের পোস্টের অনেক ঘটনাই অস্বীকার করতে হয়। আবার তার বক্তব্য অনেকখানি শ্রুতিনির্ভর হওয়াতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। মানে শুনেছি দিয়ে বলেছেন, যা ইতিহাসের জন্য বিপজ্জনক একটি প্রবণতা।
এবং তার ভাষ্যের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিকটি হচ্ছে জলিলকে নাকি বন্দী করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। আগেই বলেছি, ওসমানীর ঘটনায় তার বক্তব্য ছিলো সরাসরি উদ্ধৃতি, ওসমানীর সঙ্গে তার আলাপ সরাসরি কোট করছেন। আর এই ক্ষেত্রে শোনা কথায়। তবে নজরুল জলিলের সঙ্গে তার সখ্যতার কথাই বলেছেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনে জলিল ও তার সেক্টর সবচেয়ে বেশী লাইনেজ পেতেন কলকাতার কাছাকাছি থাকায়।
অন্য সেক্টর কমান্ডারদের এনিয়ে একটু অসূয়া ছিলো যার উল্লেখ করেছেন তিনি জিয়ার একটি ঘটনা দিয়ে। যাহোক, ফিরে আসি মূল কাহিনীতে।
ঢাকা পতনের আগে দেশের বিভিন্ন অংশ মুক্ত হতে শুরু করে। মুজিব নগর সরকার সেখানে বেসামরিক প্রশাসন কায়েম করার উদ্যোগ নেয়। খুলনা পতনের পর এই ব্যাপারেই জলিল সংক্রান্ত জটিলতার সূত্রপাত।
একাত্তরের রণাঙ্গন ও অকথিত কিছু কথা বইটি থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা যাক (পৃ: ১৯৪) : এসময় মুজিব নগর সরকারের সদর দফতরে এবং আমাদের অর্থাৎ জেনারেল ওসমানী সাহেবের দফতরে সেনা অফিসারদের মধ্যে একটি কথা শুনেছিলাম। কথাটি এরকম : মুজিব নগর সরকার খুলনা মুক্ত হওয়ার পর খুলনায় বেসামরিক প্রশাসন স্থাপনের জন্য একজন ডিসি বা জেলা প্রশাসক নিয়োগ করে পাঠান। খুলনা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলনা-বরিশাল অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল তার সেক্টরের অফিস পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের হাসনাবাদ থেকে খুলনায় স্থানান্তর করেন। খুলনা সার্কিট হাইজে তিনি সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তার অধীনস্থ বাহিনী সার্কিট হাইজের প্রহরায় নিয়োজিত।
তিনিও সেখানে বেসামরিক প্রশাসন চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। এ সময় মুজিবনগর থেকে সরকার নিযুক্ত ডিসি গিয়ে খুলনায় হাজির হন সরকারী সনদপত্রসহ। কিন্তু সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল নাকি মুজিবনগর সরকারের প্রেরিত বেসামরিক আমলার কাছে খুলনার বেসামরিক শাসনভার হস্তান্তর করতে দিতে রাজী হননি। এমনকি নবনিযুক্ত ডিসিকে খুলনা সার্কিট হাউজে অবস্থান করতে দেননি।
খুলনার নবনিযুক্ত ডিসি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে এলেন মুজিবনগরে।
রিপোর্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে। প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষেপে গেলেন এসব খবর শুনে। তিনি ডেকে পাঠালেন জেনারেল সাহেবকে। সব শুনে জেনারেল ওসমানী মেজর জলিলকে বলে পাঠান যে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক সরকারের একটি বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলা হবে। তোমরা সব ব্যারাকে চলে যাবে।
সিভিল এডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে তোমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। সামরিক বাহিনী দিয়ে দেশ শাসনের চিন্তা আমাদের মাথা থেকে দূর করতে হবে। উই আর নট পাকিস্তান, রিমেম্বার ইট।
নোট : ওসমানী নিজেও ছিলেন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একজন, সামরিক বাহিনীতে তার অধিভুক্তি ছিলো সাময়িক সামরিক জরুরীবস্থার প্রেক্ষিত মাত্র। স্বাধীনতার পর সশস্ত্র বাহিনীতে তাকে কোনো পদ দেওয়া হয়নি।
মোস্তফার বয়ানে ডিসি প্রসঙ্গে এটুকুই আছে যে খুলনা মুক্ত হওয়ার পর তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় বেসামরিক কার্যক্রম অব্যহত রাখার জন্য ডেপুটি কমিশনারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে। তিনি রূপসা নদী সংক্রান্ত বাংলো থেকে ডিসিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসেন, ভদ্রলোক '৭৫ পরবর্তীতে শিল্প মন্ত্রনালয়ের সচিব হয়েছিলেন। পরে যৌথ বাহিনীর নির্দেশ মতো পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে খলনার বেসামরিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলা হয়। আগের পোস্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এখানে ধরে নেওয়া যায় যে হয়তো মঞ্জুরই ওসমানীর নির্দেশনা নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন জলিলের সঙ্গে। তবে প্রমাণহীন উপসিদ্ধান্তে আমার যথেষ্টই আস্থাহীনতা।
পরের বক্তব্য এরকম : শুনেছি জেনারেল সাহেব মেজর জলিলকে এভাবে ধমকিয়ে সব বুঝিয়ে বলেন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন খুলনায় ডিসি পাঠানোর জন্য। প্রধানমন্ত্রী জেনারেল ওসমানীর কথামতো আবার ডিসি পাঠালেন। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। মেজর জলিল মুজিবনগর সরকারের ডিসির কাছে খুলনার বেসামরিক শাসনভার তুলে দিতে রাজী হননি।
বরং মেজর জলিল মুক্ত খুলনায় তার সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করে তুলেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের ডিসি তার কাছে কোনো পাত্তা না পেয়ে ফিরে এসেছিলেন। মুজিবনগর সরকার ও জেনারেল ওসমানী রেগেমেগে আগুন। পারেন তো, মেজর জলিলকে এখনই গ্রেপ্তার কর শায়েস্তা করেন। এমনই অবস্থা।
এরপর লেখকের সঙ্গে জলিলের সখ্যতার বিবরণ ও ওসমানীর প্রসন্নতার বর্ণণা রয়েছে কয়েকটি অনুচ্ছেদে। গ্রেফতারের বর্ণনাটি এরপর : শুনেছি অবাধ্যতার কারণে মেজর জলিলকে খুলনা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় গ্রেফতার করার হয়েছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী তার কাছ থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিলো। মেজর জলিলকে বন্দী করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। মেজর জলিলকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করা হয়নি।
মেজর জলিলের গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে আমি এরকমই শুনেছিলাম। পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে মেজর জলিলের গ্রেফতার সম্পর্কে অনেক রাজনৈতিক রং চড়ানো হয়েছিলো।
তবে মেজর জলিলকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জেনেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রশাসনের উপর বাংলাদেশ সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীরও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কারা প্রশাসনের উপর। বাংলাদেশে গ্রেফতারকৃত মেজর জলিলকে কার হেফাজতে রাখা হবে ভারতীয় সেনাবাহিনী তার কোনো গ্যারান্টি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পায়নি।
তাই মেজর জলিলকে গ্রেফতারের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হেফাজতে নেয়া হয়েছিলো। জেনারেল ওসমানী অবাধ্যতার কারণে এবং সামরিক ডিসিপ্লিন ভঙ্গের কারণে তার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলের উপর ভীষণ চটে গিয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দও এ ধরণের কথিত আচরণের কারণে এই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন। এ কারণে পরবর্তীতে মেজর জলিলকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আর গ্রহণ করা হয়নি। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মেজর জলিলের অপরিমেয় ত্যাগ ও অমূল্য অবদান বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
শেষ কথা : মূলত মুজিবনগর প্রশাসন ও ওসমানীর যুদ্ধকালের নানা কথা নিয়েই নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথাটি। জলিল এখানে সামান্য চরিত্র মাত্র। শোনা কথা নির্ভর এই বক্তব্য পাঠক কতখানি গ্রহণ করবেন সেটা তার নিজের উপর। আমি শুধু মূল ঘটনার আরেকটি ভার্সন তুলে ধরলাম মাত্র।
হঠাত চোখে পড়লো ব্লগার শওকত হোসেন মাসুম এ নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন অনেক আগে এই বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আরেকটি সূত্র উল্লেখ করে।
সেটিও সংযোজিত করা হলো:
এই ব্লগে এসে জানলাম মেজর জলিল নিয়ে নানা তথ্য। জামাতিদের খুব প্রিয় চরিত্র এই জলিল। জলিল নাকি যুদ্ধের পর ভারতীয় লুটপাটের বিরোধীতা করায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে মেজর (অব.) জলিল জামাতীদের প্রিয় আরেকটি কারণে, সেটি হল শেষ সময়ে এসে তার ইসলাম প্রীতির কারণে।
জলিল কেন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তার একটি বর্ণনা আছে 'এক জেনারেলের নীরব সাক্ষী: স্বাধীনতার প্রথম দশক' নামের বইটিতে।
লেখক, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (বি.) বীরবিক্রম। এই বইটিতে তিনি দুইটি গালগল্প বা মিথের জবাব দিয়েছেন। একটি হলো জলিলের গ্রেপ্তার এবং অন্যটি ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামালের গুলিবিদ্ধ হওয়া।
এথম পর্বে জলিল নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আসুন দেখি বইটিতে কি লেখা আছে।
বইটিতে আরও কিছু মন্তব্য আছে সেটার গুরুত্বও তম নয়।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একপাশে (বর্তমান পুলিশ নিয়ন্ত্রণ ক) অস্থায়ী অফিস চালু করি। কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা শহর ও আশপাশ এলাকা থেকে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ, আর্মির গাড়ি ইত্যাদি উদ্ধার করি এবং সেগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসি।
ডিসেম্বরের মাসেরই শেষের দিকে মেজর জলিলকে খুলনা থেকে ধরে এনে বন্দি করার জন্য আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তৎকালীন ক্যাপ্টেন কে এস হুদা (পরে কর্ণেল এবং ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে নিহত) তাকে ধরে নিয়ে আসেন।
মেজর জলিলের বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খলতা ও অন্যান্য সামরিক শঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ছিল। খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক জলিলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং গ্রেপ্তার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। যদিও প্রচার করা হয় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক অস্ত্রশস্ত্র লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জলিলকে আমি পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে চিনি। গ্রেপ্তারের পর তাকে আমার অস্থায়ী অফিসের পাশে আমার অধীনে প্রহরায় রাখা হয়।
মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আমার আলাপ হতো। জলিল আমাকে বলতো, 'আর্মিতে থেকে কী লাভ হবে? বড়জোর জেনারেল হবেন। তার চেয়ে বরং চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসুন। তা না হলে যারা ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় শরনার্থী ছিল এবং যারা নয় মাসের যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল না তারাই দেশ শাসন করবে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙ্গিয়ে। তাই সব মুক্তিযোদ্ধাদের উচিৎ রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়া।
'
লে. কর্ণেল তাহেরের সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালে জলিলের কোর্ট মার্শাল হয়েছিল। কিন্তু জলিলের কোনো শাস্তি হয়নি। তবে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তিনি জাসদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
ছবি : একজন সেক্টর কমান্ডারের স্যালুট গ্রহণ করছেন ওসমানী, তার পেছনে এডিসি শেখ কামাল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।