আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপথ্যে সেই মেজর জিয়াউল!

কারাগারের ভেতরেও থেমে নেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের তৎপরতা। বরখাস্তকৃত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের পরামর্শ অনুযায়ী এখনো উজ্জীবিত জঙ্গিরা! কারা অভ্যন্তরের সেলের বারান্দার অল্প জায়গার মধ্যেই তারা সেরে নিচ্ছে সামরিক কায়দায় কঠোর প্রশিক্ষণ। অতীতে কেবলমাত্র বিস্ফোরকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এক বছর ধরে জঙ্গিরা ঝুঁকেছে আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে। এরই অংশ হিসেবে জঙ্গিরা ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ খুন করে কমান্ডো স্টাইলে ছিনিয়ে নিয়েছিল মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তিন শীর্ষ জঙ্গিকে। পরবর্তীতে ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃত জাকারিয়া ও রাসেলকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।

অন্যদিকে, এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার গারোবাজার এলাকা থেকে ছয়টি পিস্তল, আটটি ম্যাগাজিন, ৪১ রাউন্ড গুলি ও পাঁচটি তাজা ককটেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। পুলিশের ধারণা, উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেই জেএমবির সদস্যরা ত্রিশালে কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন জানান, পলাতক দুই শীর্ষ জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান, সালাউদ্দীন সালেহিন এবং অপারেশনের নেতৃত্বদানকারী ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার করলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হওয়া যাবে। তাদের পেছনে আরও অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।

তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

কারা সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী জঙ্গিরা কারাগারের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ম্যানেজ করে নিয়মিত খালি হাতেই তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিন ভোরে অন্যসব বন্দী জেগে ওঠার আগেই তারা প্রায় ঘণ্টাব্যাপী কসরত সেরে নিচ্ছে। মেজর জিয়ার (বরখাস্তকৃত) তৈরি এবিটির সামরিক কৌশল, সিলেবাস এবং প্রশিক্ষণ মডিউলে এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারগারের অভ্যন্তরে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যরা তাদের সেলের বারান্দায় তাদের সামরিক কসরত সেরে নিচ্ছেন।

ওই কারাগারে বন্দী এবিটির সদস্যরা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা আল-কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আকীকে আইকন হিসেবে মনে করেন। এবিটির মতাদর্শ গ্রহণ করতে তাদের পাশে থাকা অন্য বন্দীদেরও তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। দেশের অন্য কারাগারগুলোতে অন্তরীণ হিযবুত তাহ্রীর, জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজিবি) সদস্যরাও একই কায়দায় শারীরিক কসরত ও তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। গত এক দশকে এদেশে গড়ে ওঠা জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহরীর, জামায়াতুল মুসলেমিন, জাদিদ আল-কায়দা, জুমাআতুল আল সাদাত, তামির উদ্বীনের একটি অংশের সদস্যরা এবিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।

কারাবন্দী শীর্ষ জঙ্গিরা এখনো নিয়মিত মেজর জিয়ার পরামর্শ এবং নির্দেশনা পেয়ে থাকেন।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বছর জুলাই মাসে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়া এবিটির প্রধান মুফতি জসীম উদ্দীন রহমানী টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন, তার সঙ্গে মেজর জিয়াউল হক (বরখাস্তকৃত) নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তার পরামর্শেই সাজানো হয়েছিল এবিটির সামরিক কৌশল, সিলেবাস এবং প্রশিক্ষণ মডিউল। গত বছরই কুমিল্লায় ওই সেনা কর্মকর্তা এবং জসীম উদ্দীন রহমানীর সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়। বিদেশে থেকেই তিনি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এবিটির সদস্যদের কাজ করার ব্যাপারে মতামত জানিয়েছিলেন।

গত বছরের মাঝামাঝিতে বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থানরত এবিটির অপারেশনাল প্রধান ইজাজ হোসেন জুন্নুন শিকদার, কাজী রেজোয়ানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছিলেন রহমানী।

তিনি আরও জানিয়েছিলেন, মেজর জিয়ার (বরখাস্ত) পরামর্শ মতোই তৈরি করা হচ্ছিল 'ট্রেনিং ইনস্টিটিউট'। তবে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য এসব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বিস্ফোরকসহ অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের পাশাপাশি মজুদ করা হচ্ছিল ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। তবে আপাতত সমতল ভূমিতে প্রশিক্ষণ নিলেও নিবিড় প্রশিক্ষণের জন্য জঙ্গি পছন্দের তালিকায় রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রহমানী নিজে টেকনো দক্ষ না হওয়ার কারণে মেজর জিয়াকে দেওয়া রহমানীর ই-মেইল পাঠানো এবং খোলার কাজ করতেন তারই একজন ঘনিষ্ঠ সহচর।

পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের একজন বই বিক্রেতা ফোরকান মিডিয়া এবং খুৎবা ওয়েব পেইজের প্রশাসক হিসেবে কাজ করতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, পলাতক থেকেও মেজর জিয়া দেশে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। মেজর জিয়া জঙ্গিদের কাছে রীতিমতো আদর্শ। বর্তমানে হিযবুত তাহ্রীরের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিরা বিভিন্ন নামে বিভক্ত হলেও তাদের টার্গেট এক ও অভিন্ন। কারাগারে অন্তরীণ বিভিন্ন সংগঠনের জঙ্গিরা সুযোগ বুঝে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ সেরে নেয়। এ ছাড়া কারাগারে থেকে আদালতে নেওয়ার সময় মুঠোফোনের মাধ্যমে বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। বিশেষ করে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা হওয়ায় ওইসব মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে তাদের সাক্ষাতের সুযোগ মেলে।

গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, ২০১২ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারের আরাকানের উদ্দেশ্যে এবিটির অন্তত অর্ধশতাধিক জঙ্গি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওনা দিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গা ও আরাকান মুসলমানদের তিনটি সংগঠনের (আরএসও, এআরএনও ও এআরইএফ) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা। এর আগে তারা পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ মডিউলের একটি অংশে লক্ষ্যবস্তুর টার্গেট ঠিক রাখতে মাঝে মাঝে এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করার কথা বলা হয়েছে শিক্ষানবিস জঙ্গিদের।

এ ছাড়া গত বছরের জুলাই মাসে র্যাব-১২ এর একটি দল বগুড়া ঠনঠনিয়া থেকে 'বিইএম' নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে।

তাদের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয় অত্যাধুনিক এসএমজি একে টুটু সাব মেশিনগান, জার্মানির তৈরি এসএমজি, পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিনসহ ৮০টি গুলি এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণের উপকরণ। এসব অস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্রের নকশা এবং আত্দঘাতী হতে উদ্বুদ্ধকরণ নোটও উদ্ধার করা হয় আস্তানাটি থেকে। উদ্ধার করা কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়, জেএমবির আদলেই এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ১৯ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সেখানে। আর তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও কিছুটা সামরিক বাহিনীর আদলে তৈরি করা।

ট্রেনিং মডিউলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো জঙ্গিদের ম্যাপ রিডিংয়ের গুরুত্ব দেওয়া হয়। শেখানো হয় সাংকেতিক চিহ্ন এবং অবস্থানের দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান।

র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, র্যাব সৃষ্টির পর থেকেই জঙ্গি দমনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে র্যাবের সাফল্য দেশে-বিদেশে অনেক প্রশংসিতও হয়েছে। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিসহ অপারেশনে অংশ নেওয়া জঙ্গিদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে র্যাব।

এর পেছনে যারাই নেপথ্য ভূমিকা রেখেছেন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

কে এই মেজর জিয়া : সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াসের অন্য পরিকল্পনাকারী মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর অন্য এক কর্মরত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাকেও রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড তথা সেনাবাহিনীকে অপব্যবহার করার কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে প্ররোচণা দিয়েছিলেন। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করলে সদ্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী মেজর জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে সত্বর ঢাকার লগ এরিয়া সদর দফতরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে গত ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলে তিনি পলাতক থাকেন। পলাতক অবস্থায় মেজর জিয়া সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাবভারসিভ (নাশকতামূলক) কার্যক্রম চালানোর পাঁয়তারা করেছিলেন।

কারাগারে বন্দী জঙ্গিদের তালিকা উদ্ধার : টঙ্গীর গাজীপুরা থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গি জাকারিয়ার স্ত্রী স্বপ্নার কাছ থেকে বিভিন্ন কারাগারে বন্দীদের তালিকা উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত রবিবার গাজীপুরার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তালিকা ছাড়াও তার কাছ থেকে কিছু জিহাদি বই, একটি ল্যাপটপ, একটি মডেম, পেনড্রাইভ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি এটিএম কার্ড, ৫টি মোবাইল ফোন, দুটি গাড়ির ব্লু-বুক উদ্ধার করা হয়। স্বপ্না জানিয়েছেন, কারাবন্দী জঙ্গি এবং দুস্থ জঙ্গিদের পরিবারকে বিভিন্ন সময় আর্থিকভাবে সহায়তা করা হতো।

স্বপ্নার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরশা থানার বাইকাপাড়া এলাকায়।

স্বপ্না রাজশাহীর একটি কলেজের সম্মান শ্রেণীর ছাত্রী। ওই বাসা থেকেই মাঝে মাঝে ক্লাস করতে রাজশাহী যেতেন স্বপ্না।

আরও এক পুলিশ সাময়িক বরখাস্ত : গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. আবদুল বাতেন জানান, দায়িত্বে অবহেলার জন্য গাজীপুর পুলিশ লাইনের কর্মরত হাবিলদার মেজর আইয়ুব আলীকে সোমবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে রবিবার দায়িত্বে অবহেলার জন্য গাজীপুর পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) সাইদুল করিমকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড এবং একই পুলিশ লাইনে কর্মরত ফোর্স সুবেদার আবদুল কাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে ওই ঘটনায় গাজীপুরের তিন পুলিশকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।