আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রসফায়ারে হত্যা বন্ধে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়



ক্রসফায়ারে হত্যা বন্ধে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায় হাইকোর্ট সুওমটো হয়ে দেশব্যাপী ক্রসফায়ারে হত্যার নৃশংসতা বন্ধে একটি ঐতিহাসিক-অন্তর্বর্তীকালীন রায় দিয়েছেন। সরকারের পক্ষে এটর্নি জেনারেল হাইকোর্টের এই রায়ের বিরোধিতা করলে এবং এতদসংক্রান্ত রুলের জবাব দিতে হাইকোর্টের বেঁধে দেয়া সময় পার করে অতিরিক্ত সময় চাইলে হাইকোর্ট তা নাকচ করে দিয়ে সব ধরনের ক্রসফায়ার হত্যাকান্ড বন্ধে সরকারকে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত বলেছেন : ‘সময় দিলে তো এর মধ্যে ক্রসফায়ারে আরো ৫০ জন মানুষ হত্যা করা হবে। ' শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট শীতকালীন ছুটির পর বিষয়টির শুনানির দিন ধার্য করেন এবং এ সময়কালে যেন আর কোনো ক্রয়ফায়ার না হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এই সময়োচিত রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায় হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এই রায় দেশে বিদেশে যারা মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার, তাদেরকে আশ্বস্ত করবে এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করবে। এর পাশাপাশি দেশে যারা ক্রসফায়ারে জীবন প্রদীপ নিভে যাবার আতঙ্কে রয়েছে এবং যারা বিশেষ বাহিনীর ক্রসফায়ার ঠেকাতে অদৃশ্যে অর্থ খরচ করতে গিয়ে ফতুর হবার আশঙ্কা করছিলেন, সাময়িকভাবে তাদের মাঝেও স্বস্তি আসবে। বর্তমান সরকারের আমলে ইতোমধ্যেই ১৪১ জনকে বিচারবহির্ভূত পন্থায় ক্রসফায়ার টেকনিকে হত্যা করা হয়েছে। এ হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে ১৪/১৫ জনকে ক্রসফায়ারের সাজানো গল্পে ভিলেন বানানো হয়েছে। ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যার লাইসেন্সধারী পোশাকী বাহিনীর ঔদ্ধত্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, একজন পেশাদার সাংবাদিককে ফেনসিডিল পাচারকারী সাজিয়ে নির্মম নির্যাতন করে ক্রসফায়ারে হত্যার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল।

হাইকার্টের মাননীয় বিচারকরা বলেছেন, ‘র্যা বের মধ্যে কিছু কুলাঙ্গার ঢুকে পড়েছে। ' এই মন্তব্যটি রূঢ় এবং যথার্থ। তবে র্যা বকে যারা বিচারবহির্ভূত হত্যার লাইসেন্স দিয়ে ‘কুলাঙ্গার' বানিয়েছে, এর দায়টা তাদেরই। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে কোন বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরো বলেছেন, পুলিশ বা সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদের আত্মরক্ষার জন্য গুলী চালানোর অধিকার দিতে হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের সাংবিধানিক মানবাধিকারের বদলে পুলিশ ও র্যা বের মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যদিও তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং সরকার ও জনগণের সরকার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। ক্রসফায়ারে হত্যার যে মনোলিথিক কাহিনী সাজিয়ে তা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা জাস্টিফাই করতে প্রতিবারই একই ধরনের গল্প সাজাতে হয়। এসব শুনে শুনে মানুষের বিরক্তি ধরে গেছে।

সুতরাং র্যা বকে যারা চালায় এবং যাদের আস্কারা ও প্রশ্রয়ে র্যা ব একের পর এক ক্রসফায়ার করে যাচ্ছে, তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে আগে। দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা এবং পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে নানা প্রক্রিয়ায় আসামীদের ওপর নির্যাতন চালানোর রোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কথা দিয়েছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড আর ঘটবে না এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের তদন্ত করে দোষীদের বিচার করা হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ড চালানোকে আইন-শৃক্মখলা রক্ষাবাহিনীর আত্মরক্ষার অমোঘ ও অপরিহার্য অস্ত্র হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকার করে নেয়ার ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দলীয় সরকারের নীতি-অবস্থানের অনুসরণ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার র্যা ব বাহিনীকে পরিচালনা করে থাকেন, এটাই সবাই বিশ্বাস করবেন।

হাইকোর্টের সুওমটো অন্তর্বর্তী নির্দেশের পর সরকারের পক্ষ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ হবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন। সরকার যদি নিজেদের জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে বলে ভাবেন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটাকে তাদের অধিকার বলে মনে করেন, তাহলে হাইকোর্টের এই নিষেধাজ্ঞা কতটা প্রতিপালিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে সরকারের এটর্নি জেনারেল যেভাবে ফ্যাসিবাদী ভাষায় বিচারকদের ধমক দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন এবং হাইকোর্টের বিচারকদের জামিন দানের এখতিয়ারকে যেভাবে আইন বহির্ভূত পন্থায় চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছেন, তাতে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, সরকার বিচার বিভাগের পবিত্র স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তরিক। এটর্নি জেনারেলের মাস্তানীকৃত উচ্চ আদালতের বিচারকরা অতিষ্ঠ হয়ে বলেছেন, চাইলে সরকার হাইকোর্ট তুলে দিতে পারেন এবং সরকারের যেহেতু প্রবল ক্ষমতা রয়েছে, ইচ্ছা করলে তা প্রয়োগ করে বিচারকদেরও রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করতে পারেন। উচ্চ আদালতের এই নজিরবিহীন ও রূঢ় মন্তব্যের পর সরকারের খাসলতে কোন পরিবর্তন আসছে বলে দৃষ্টিগোচর হয় না।

হাইকোর্ট আসামীর পুলিশ রিমান্ডের আবেদন না-মঞ্জুর করে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা মানেনি। এজন্য আদালত সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের তলব করেছেন কৈফিয়ৎ দেয়ার জন্য। এদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার সুপ্রীম কোর্টের আপীলেট বিভাগ বা চেম্বার জজের আদালতে গিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিয়ে তাদের ক্ষমতার দাপট জাহির করে যাচ্ছেন। সরকারে এই নজিরবিহীন মানবাধিকার লংঘন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে দেশের প্রবীণ আইনজীবীরা কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। হাইকোর্ট মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রগামী হলেও সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ যদি সেক্ষেত্র সরকারের অবস্থানকে ঢালাও বৈধ বলে রায় দেয়, তাতে শুধু বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিই মানুষের আস্থা বিনষ্ট হবে না; প্রমাণ হবে যে, হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগকে বিভক্ত করে সরকার তার অশুভ অভিলাষ পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে এবং সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারকদের সরকার মানবাধিকার লংঘনে ব্যবহার করতে পারছেন।

এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও অখন্ডত্ব রক্ষায় আরো সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে দেশের প্রবীণ নাগরিকরা মনে করেন। একজন প্রবীণ আইনজীবী এ ব্যাপারে নবনিযুক্ত প্রধান বিবারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমরা আশা করি, সরকার তার ব্রুট মেজরিটির জোরে আইনের শাসন পদদলিত করার যে উন্মত্ততায় মেতেছে, কেবলমাত্র বিচারিক প্রক্রিয়ায়ই তার প্রতিকার হতে পারে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.