অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!
[হোরাশিও পোটেলের দুরবস্স্থার কথা জেনে এই লেখাটি লিখেছিলাম এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম আলোতে। কয়েকদিন আগে ঐ মামলার রায় হয়েছে আর্জেন্টিনায়। জ্ঞানের জয় হয়েছে, পোটেলের বিরুদ্ধে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে সেখানকার আদালত। দক্ষিনের দেশগুলোতে উত্তরের দেশগুলোর তথাকথিত জ্ঞানের হস্তক্ষেপ আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভীত করে তুলছে।
তবে, আশার কথা হলো উত্তরের লোকেরা খুব সহজে দক্ষিণের আদালতগুলোকে কিনতে পারবে না। ভারতের পর আর্জেন্টিনা সেটা প্রমাণ করলো। ]
একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক। ঢাকার নীলক্ষেত এলাকার সব ফটোকপির মেশিন সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ লাইব্রেরির জেরক্স বা ফটোকপি শাখাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একদল পুলিশ নিয়মিতভাবে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে কোথাও কোনো বই ফটোকপি হচ্ছে কি না! চিত্রটি ভয়াবহ এবং আতঙ্কের। তবে অসম্ভব নয়।
শিক্ষাবিস্তারের জন্য যুগ যুগ ধরে অধ্যাপক-শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের নোট দিয়েছেন, সাজেশন দিয়েছেন, বইয়ের পাতা ফটোকপি করে দিয়েছেন। দর্শনের অধ্যাপকেরা নানা তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এসবের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে জ্ঞানের জগৎ।
এগিয়েছে সভ্যতাও। এরই মধ্যে বিকশিত হয়েছে ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তি। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট আজ স্বীকৃত। অধ্যাপক-শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের বিকাশের জন্য ইন্টারনেটকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
অথচ এ কাজ করার জন্য আর্জেন্টিনার অধ্যাপক হোরাশিও পোটেল আজ জেল-জরিমানার সম্মুখীন! আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের জাতীয় লানসা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক পোটেলের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের একটি প্রকাশনা সংস্থা কপিরাইট আইন ভঙ্গের অভিযোগ এনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে।
পোটেলের অপরাধ(?) তিনি ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার (১৯৩০−২০০৪) তত্ত্ব ও এর ব্যাখ্যা ইন্টারনেটে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষার্থীদের জন্য উন্ন্মুক্ত করেছেন! পোটেল ইন্টারনেটের বিকাশ ও ক্ষমতায় মুগ্ধ হন। শিক্ষার্থীদের অধিকতর জ্ঞানান্বেষী করার জন্য তিনি ১৯৯৯ সালে একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট খুলে সেখানে জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের রচনা, ব্যাখ্যা, সমালোচনা ইত্যাদি সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। দার্শনিকদের তালিকায় আছেন জার্মানির ফ্রেডরিক নিৎসে, মার্টিন হেইডেগার, দেরিদা প্রমুখ। বেশির ভাগ দার্শনিকের তত্ত্বগুলো তিনি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন, অন্যদের করা স্প্যানিশ অনুবাদ সংগ্রহ করেন এবং তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। স্প্যানিশ ভাষাভাষী লোকের মধ্যে তাঁর ওয়েবসাইটগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
কেবল নিৎসের জন্য ওয়েবসাইটটি এ পর্যন্ত ৪০ লাখ বারের বেশি পাঠক পেয়েছে!
হাজার বছর ধরে অধ্যাপকেরা শিক্ষার্থীদের জন্য যেভাবে জ্ঞানের দরজা উন্নুক্ত করেন, পোটেল সেই কাজটিই করেছেন। কেবল তিনি ব্যবহার করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি। পোটেল দেখেছেন, আর্জেটিনায় দর্শনের বই মোটেই সহজলভ্য নয়। অনেক বই এখন আর মুদ্রিত হয় না। পোটেল আরও দেখেছেন বিদেশি বইগুলোর মূল্যও সাধারণ আর্জেন্টিনিয়ানদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আশি পৃষ্ঠার দেরিদার একটি কনফারেন্স পাবলিকেশনের দাম ১৬২ আর্জেন্টাইন পেসো (বাংলাদেশি টাকায় মাত্র তিন হাজার টাকা)! তাই বছরের পর বছর বিভিন্ন লাইব্রেরি ঘুরে, অন্য অধ্যাপকদের সহযোগিতায় তিনি এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। উদ্দেশ্য জ্ঞানের বিতরণ।
পোটেলের এই বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণের বিষয়টি চোখে পড়েছে দেরিদার অন্যতম প্রকাশক ফ্রান্সের দি মিনিউটের। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারা পোটেলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে (ওরা মাত্র একটি দেরিদার বই প্রকাশ করেছে, তাও আবার ফরাসিতে!)। এই ফরাসি প্রতিষ্ঠানটির তাদের অভিযোগের ব্যাপারে আর্জেন্টিনায় ফরাসি দুতাবাসকে তৎপর হতে বলে।
দুতাবাস আর্জেন্টিনা বুক চেম্বারকে বাধ্য করে পোটেলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে। তারা কত তৎপর হয়েছে এর প্রমাণ হলো আর্জেন্টিনার পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে হানা দেয়! শুধু তা-ই নয়, আর্জেন্টিনা বুক চেম্বার বুয়েনস আয়ার্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের শিক্ষার্থীদের ফটোকপি করতে উৎসাহ জোগানোর চিঠি দিয়ে তিরস্কার করে! আর্জেন্টিনার পুলিশ হয়তো অচিরেই পোটেলের টেলিফোনে আড়ি পাতবে, তার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হাতাবে আর বাড়িতে গিয়েও হানা দেবে ‘অবৈধ কার্যকলাপ’ বন্ধ করার জন্য।
পোটেল এরই মধ্যে সেই ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিয়েছেন। সেখানে গেলে আপনি দেখবেন লেখা আছে, আইনি তৎপরতার কারণে এই ওয়েবসাইটটি বন্ধ করা আছে। পোটেলের বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি মামলা হয়েছে সেটার জন্য আর্জেন্টিনার আইনে তাঁর এক মাস থেকে ছয় বছরের জেল হতে পারে।
জ্যাক দেরিদা যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনি অধ্যাপক পোটেলকে কৃতজ্ঞতা জানাতেন লাখ লাখ স্প্যানিশ ভাষাভাষীর কাছে তাঁর কর্মের অনুবাদ তুলে ধরার জন্য। তিনি যে এমনটি করতেন তা নিশ্চিত, কারণ তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন কিন্তু পোটেলের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানের স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার ছিলেন দেরিদা। কী আশ্চর্য, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে উপজীব্য করে প্রকাশক উদ্যত হয়েছে জ্ঞানের বিকাশ রুদ্ধ করতে!
সারাবিশ্বে জ্ঞানের বিকাশ যারা চান, মুক্তচিন্তায় যারা বিশ্বাসী তারা আজ পোটেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কপিসাউথ গবেষক দল, যারা দক্ষিণের দেশগুলোতে কপিরাইটের নামে উত্তরের দেশগুলোর বৌদ্ধিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারাসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ লড়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে।
২৮ ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার ইংরেজি দৈনিক ক্ল্লেরিন-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রথম এই মামলার কথা জানতে পারে। কপিসাউথের সদস্য হিসেবে আমিও সেদিন থেকে বিষয়টি লক্ষ করছি। পোটেলের মামলাটি আমাদের মতো দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোটেলের মামলায় ফরাসি প্রতিষ্ঠানের জয়লাভ যেকোনো বিচারে জ্ঞানের বিরুদ্ধে অজ্ঞানতার বিজয়, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের গলা চেপে ধরার বৌদ্ধিক আগ্রাসনের সুস্পষ্ট নির্দশন। বেশ কিছুদিন আগে দিল্লি হাইকোর্টে হ্যারি পটারের একটি মামলাতে পশ্চিমা কপিরাইটের ধারণা প্রাচ্যের উদারতার কাছে হেরে গিয়েছিল।
বাংলাদেশেও আজকাল অনেকে না বুঝে পশ্চিমা কপিরাইটের ধারণার বিকাশ চান। তারা ভুলে যান যে, আমরা হাজার বছর ধরে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির কপিরাইট রক্ষা করে যাচ্ছি, পশ্চিমা ধারণা ছাড়াই। আমরা আমাদের রবীন্দ্রণাথ, লালনকে রক্ষা করেছি এবং আমরা আমাদের শামসুর রাহমানকেও রক্ষা করতে পারবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।