১।
আর মাত্র কয়েকটি ঘন্টা; এর পরই সেই কাঙ্খিত রাত!
১৩-১১-০৯ !
ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ।
কতো বছর ধরেই না এই রাতটির অপেক্ষায় ছিল তারা।
ধৈর্য্যের বাঁধকে শত সহস্র আঘাতের মুখে ভেঙে পড়তে দেয়নি। থেকে থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে তাদের এক একজন সাথীরা।
কখনো নীরবে, কখনো অসহনীয় যন্ত্রণার তীব্রতায় কাতর গোঙানীতে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর করাল থাবায়। চলে যেতে হয়েছে এক একজন যোদ্ধাকে।
তবুও তারা অপেক্ষায় আছে।
১৩-১১-০৯ এর অপেক্ষায়; তাদের বিজয়ের সূর্য্য আনবে বলে।
সময় খুব বেশী হাতে নেই।
যার আত্মাকে দখল করে প্রভু লুসিফার ফিরে আসবেন এই মর্ত্যে, সেই মেয়েটিকে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। খুনের রক্তে তার হাত রঞ্জিত হবার পরপরই লুসিফার পূণর্জন্ম নিতে পারবে তার ভক্তদের মাঝে।
২।
এই সমাধিটা যে কার, চার্চের কেউই সেটা বলতে পারে না। পাথুরে দেয়ালে কোন পরিচয় তো দূরে থাক, এমনকি কোন অক্ষর পর্যন্ত খোদাই করা নেই।
আর্চ আকৃতির একটা প্রবেশ দ্বার, তার ভেতরেই ছোট রুম মতো জায়গায় সমাধিটা। ভেঙ্গে পড়া দেয়ালের উপর হয়তো কোন এককালে ভল্ট ছাদ ছিল; এখন তার কোন চিন্হ অবশিষ্ট নেই।
চার্চের এই অংশটা ব্যবহারের অনুপযোগী বলে এদিকটায় কেউ আসেনা। সমাধির গায়ে ধুলোর আস্তর পড়তে পড়তে প্রায় ঢিবির আকার নিয়েছে।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কোথাও একবিন্দু সবুজের ছোঁয়া নেই।
রুমের বাকি জায়গাটুকু আগাছায় ছাওয়া হলেও সমাধিটা পুরোপুরি রুক্ষতার আধার যেন! রাতভর এখানে তীব্র গোঙানী আর কান্নার করুণ ফিসফিসে স্বর ভেসে বেড়ায়। কিন্তু আশে পাশে লোকালয় না থাকায়, শোনার কেউই নেই।
রেনেসার সময়ে একবার এই জায়গাটা ভেঙে রেনোভেশনের চিন্তা ভাবনা চলছিলো। কিন্তু অজানা সমাধির গায়ে ছেনী আঘাত করার পর পর যেই দুর্যোগ শুরু হলো; কুসংস্কারের খোলস ভেঙে সেটাকে নিছক কাকতালীয় ভেবে নেয়াটা তখনকার কোন পাদ্রীর পক্ষে সাহস হয়নি। কাজ বন্ধ হয়ে গেলো।
এই ঘটনার ঠিক পরপরই আবার যখন পোপ প্লেগে মারা গেলেন; অনেকেই এই দুই ঘটনার ভেতর মিল খোঁজার চেষ্টাও যে করেনি, সেটাও বলা যাবে না।
কারণ যেটাই হোক। এর পর থেকে জায়গাটা পরিত্যক্তই থাকলো।
আপাত দৃষ্টিতে।
আজ বৃহস্পতিবার।
বছরের এই সময়টায় চারটা বাজতে না বাজতেই চারদিক আঁধার হয়ে আসতে শুরু করে ঠিকই,কিন্তু সমাধির চারপাশটায় আবছা আলোটুকুও যেন কেউ হঠাৎ করে শুষে নিয়েছে। আর্চটা পার হয়ে ঢোকামাত্রই নিকষ কালো অন্ধকার যেন টেনে নিতে চায়। হয়তো সেকারণেই সমাধির পায়ের কাছটুকু থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে জেগে উঠা ধোঁয়াটাকে মানবীয় অবয়বে রূপ নিতে কেউই দেখতে পেতো না; কিন্তু রাস্তার স্বল্প আলোতেও অপরূপা এই মানবীর দিকে দ্বিতীয়বারের মতো না তাকিয়ে, কোন পথচারীই যেতে পারছিলো না।
একজন ছাড়া!
মেয়েটি কাউকেই ভ্রুক্ষেপ করছিলো না। দু একজন শিষ দিয়ে উঠলো।
ভবঘুরে টাইপ একজন আঙুলে বাজে ইঙ্গিত করলো। সে পাশ কেটে যাবার সময় কি যেন এক নোংরা খিস্তিও করে উঠলো লোকটা।
মেয়েটা চোখের আড়াল হতেই ভবঘুরেটা কোত্থেকে ছুটে আসা মোটর সাইকেলের ধাক্কায় ছিটকে পড়লো রাস্তার পাশে। ককিয়ে উঠলো যন্ত্রণায়। হাতটা বোধ হয় ভেঙ্গেই গেছে।
মেয়েটা অন্য গলিতে মৃদু হাসলো, যদিও ঘটনাটা তার দেখা সম্ভব ছিলনা।
৩।
প্রথম দেখায় মতি মিয়াকে যে কেউ, অশিক্ষিত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আরো একজন ইমিগ্র্যান্ট হিসাবেই দেখবে। লন্ডনের রাস্তায় হাটতে থাকা এমন শত লোক আজকাল চোখে পড়ে। তাই তার দিকে কেউ আলাদা করে তাকাচ্ছিল না।
সেও তার নিজ ধ্যানেই পথ চলছিলো।
পথচারীদের মধ্যে একমাত্র সে ই মেয়েটির দিকে চোখ ফিরে তাকায় নি।
তবু সে তার নজরে পড়ে গেল।
মেয়েটি মনস্থির করতে মোটেই সময় নিলনা। নীরবে অনুসরণ করে চললো তাকে।
বিড় বিড় করে কি যেন পাঠ করে চলছে। সংবাদ চলে গেছে তার সাথীদের কাছে।
শিকার পাওয়া গেছে!
মেয়েটির রক্তে তীব্র কোন নেশার নাচন শুরু হয়ে গেলো যেন। ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবার তাড়নায় তার সব কোষে কোষে যেন জেগে উঠতে শুরু করেছে লুসিফারের আহ্বান।
৪।
কতোই বা বয়স হবে মতি মিয়ার। ? তেইশ নয়তো চব্বিশ। একেবারেই নিরীহ গোছের ছেলে। চাচার সুবাদে লন্ডনে এসেছে মাসখানেকও হয়নি। একেতো মফস্বলের, তার উপর পীর বংশের ছেলে।
পশ্চিমের আধুনিকতার সাথে সে একেবারেই মানিয়ে উঠতে পারছে না।
তবে তার এখানে আসার কারণটা অন্য।
লন্ডনে আসার ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই জেগে উঠেছিল মাস তিনেক আগে থেকে। তার প্রবল ইনটুইশন তাকে বার বার লন্ডনের দিকে টানছিলো। সে টের পাচ্ছিলো তার অদৃষ্ট তাকে এখানে আসতে বলছে।
গত একটা মাস সে একেবারেই বিভ্রমে থেকে গেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেছে।
আজকে সকাল থেকেই তার খুব অস্থির অস্থির লাগছিলো। চাচার রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম যে কাজটুকু করে তাতে শুক্র থেকে রবি এই তিনদিন ছুটি পায়। জমে থাকা নিজের সাপ্তাহিক কাজগুলি কোনমতে শেষ করেই দুপুরের পর বেরিয়ে পরেছে রাস্তায়।
কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে বলতে পারবেনা। কিন্তু যে কেউ হিসেব মেলালেই বুঝতে পারবে, সে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে সেই চার্চটির দিকে; যেখান থেকে মেয়েটি বের হয়ে এসেছে।
মতি মিয়া বলতেই পারবেনা, মেয়েটি কখন থেকে তাকে অনুসরন করছে। কিন্তু বাচ্চাটিকে সে রাস্তার অপর পাশে দেখার সাথে সাথেই থমকে দাড়ালো।
বড়জোর বছর আটেক হবে।
ফুটফুটে একটি মেয়ে শিশু। দেবদূতের পবিত্রতায় ঝলমল করছে তার নিস্পাপ মুখটি।
একলা দাড়িয়ে ছিল, ল্যাম্প পোস্ট টির ঠিক নীচে। তারপরেও যেন কুয়াশা আঁধার তার চারপাশটি ঘিরে। মতি মিয়ার দিকেই সরাসরি তাকিয়ে ছিলো মেয়েটি, চেনা পরিচিতের দৃস্টি দিয়ে।
সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে।
আশপাশের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারতো এখানে একটা অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলছে কিংবা ঘটছে। একটা লোককেও দেখা যাচ্ছে না দৃষ্টির সীমানায়। অথচ অনেক কটা অন্ধকার অবয়ব লুটিয়ে পড়ে আছে যেন রাস্তার উপরে। তারা দ্রুত স্থান বদল করছে।
বৃত্তাকারে দলবেঁধে ঘিরে রেখেছে মতি মিয়া ও সেই বাচ্চা মেয়েটিকে।
সে মতি মিয়ার দিকে হাত বাড়ালো।
"ফলো মি। "
না! বাচ্চাটির মুখ থেকে নয়। খসখসে গলায়, রক্ত হীম করা কথাগুলি ভেসে এলো যেন তার পেছন থেকে।
মতি মিয়ার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আতংকের হিমেল পুকুরে তাকে ফেলে দেয়া হয়েছে। দম ব্ন্ধ হয়ে আসার আগের মুহুর্তে বাচ্চাটির হাত তাকে ছুঁলো।
কোত্থেকে সাহস ফিরে আসলো তার ভেতর, সে বলতে পারবে না। কিন্তু মোহগ্রস্থের মতো তাকে অনুসরণ করার সময় মতি মিয়া আর এক মুহুর্তের জন্যও ভীত হলো না।
(চলবে.........)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।