সন্ধ্যার আঁধারে আমি যদি হারিয়ে যাই বন্ধু, আমাকে মনে রেখো তোমার ঘরের ধূপ-আগরের সুবাসে- তোমার ঘরের প্রদীপের আলোয়, আমাকে ফেলে দিও না বাসি ফুলের মত। মনের ঘরেই রেখো বন্ধু পথের ধারের ফুলটি ভেবে। আমি যে জলসাঘরে ...www.jolsaghor.com ফ্রাইডে নাইট!
এমনই তো প্রতি সপ্তাহেই আসে। আমার জীবনে খুব বিশেষ হয়ে একবার এসেছিল। আর একবারেই সারা জীবনের জন্য তার ছাপ রেখে গিয়েছিল।
শহরে তো প্রতিদিন বাতি জ্বলে। সন্ধ্যার ছায়া নামতে না নামতেই আলো জ্বেলে উঠে। কিন্তু সেদিন, অন্যরকম ছিল। এত আলো, এত ঝলমলে! জানি, সবই আমার মনের মাঝে। এত হর্ষিত ছিলাম আমি! সারা পৃথিবীটাকে হাসিখুশীর খেলনা মনে হচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল, কারও কোন দুঃখ নেই। সবাই সুখী। পথে বসা মিস্টার ভিখারীকেও দেখলাম পানীয় হাতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে তারই সগোত্র কারও সাথে। হাসছে শব্দ করে। তারও সেদিন দুঃখ ছিল না।
সারাক্ষণ মুখ ভার করে থাকা মিস প্রিটাকেও দেখলাম হেসে-নেচে বন্ধুদের সাথে বের হচ্ছে। সেদিন আমার মন বারবার বলছিল, আজ সবাই খুশী। আমিও। সবচেয়ে বেশি খুশী।
ক্যাথিকে ফোন করেছিলাম।
সে আমতা আমতা করে আসতে রাজি হয়েছে। যদিও তার এই আচরণটা কটু লাগছিল, কিন্তু চিন্তার অবকাশ ছিল না। এমনি তো ক্যাথিই আমাকে ফোন করত। রোজ রোজ। গত বছর খানেক ধরে এভাবেই তো চলছে।
সে হতাশ ছিল। অন্তরে বিপর্যস্থ ছিল। বলত, আমি সাথে থাকলে সে পায়ের নিচে মাটি অনুভব করে। স্রোতের মাঝে আঁকড়ে ধরার মত কিছু পায়। না হলে অতলে হারিয়ে যাবে।
... অবশ্য সে তার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। পুরোদস্তুর স্বাভাবিক। এতদিন সবদিন সে আমাকেই ডাকত। আজই প্রথম আমি তাকে ডাকলাম। যদিও সে জানে না, আজকের সব আয়োজন তো তাকে ঘিরেই।
নদীর তীর ঘেষে বিশাল মিলনায়তনের মত। একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলে পানীয়পেয়ালা। ফুলের তোড়া। প্রদীপ জ্বলছে।
মাত্র দুখানা চেয়ার। চারপাশে অনেক অনেক ফুল। তারা ভরা রাতের মত পথদেখা আলো জ্বলছে, নিভুনিভু, মিটিমিটি। বাকি সব অন্ধকার। অদূরে ভায়োলিন হাতে একদিল বাদক।
তারা বাজিয়ে চলছে। সুখের, শিহরণের, রোমাঞ্চের সুর। শিহরিত আমি। চারপাশের শহরটাকেও রোমাঞ্চিত লাগছে।
ক্যাথি এলো।
সে বুঝতে পারলো না এই আয়োজনের মানে। অথবা বুঝতে চায়নি। আমি প্রথমে কিছু বলিনি। সে ধরে নিলো, আমার কোন বিশেষ দিন। খাবার এলো।
হালকা পানীয় এলো। স্বাভাবিকভাবেই খেলাম আমরা। আমাদের স্বাভাবিক গল্প চলছে। এভাবেই ঘড়ির কাঁটা মাঝরাতে এলো। আমি ক্যাথিকে বললাম, একটু আসো।
সে অবাক হলো। হাতে পানপাত্র নিয়ে সে সাথে আসলো।
ঠিক নদীর পাশে তাকে দাঁড় করালাম। বললাম, চলো সবকিছুর আগে আরেকবার উল্লাসের শুভকামনা জানাই। পানপাত্র দুটি ঠুং করে উঠল।
‘আজকের রাত উল্লাস হোক’, সে বলল। ‘তোমার নামেই সকল উল্লাস হোক, ক্যাথি’, আমি বলে থামলাম।
ভায়োলিনের সুর তখন চারপাশ মোহনীয় করে তোলেছে। সুখ শিহরণের জোয়ার বইছে। একজন সেবাদাতা ফুল নিয়ে এলো।
সদ্য বৃন্তচ্যুত লাল গোলাপ ছিল। গোলাপটি হাতে নিলাম। চিরাচরিত রীতির মতই হাঁটু গেড়ে বসলাম। ক্যাথিকে বললাম, একসাথে অনেকদূর পথ চলে মনে হয়েছে তুমিই হতে পার চলার সাথী, জীবন সাথী। তোমার পাণিপ্রার্থী আমি প্রার্থনার মত তোমাকে চাইছি, তথাস্তু বলে কৃতার্থ করো আমাকে।
ক্যাথি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। আমিও অহল্যা-পাথরের মত বসে রইলাম, যেন প্রতীক্ষমান মুক্তির। শুভস্য শীঘ্রম, কিন্তু প্রতিটি পলক যেন যুগযুগ হয়ে কাটছে। ক্যাথি মুখ খুললো, আমি পারবো না রে। আমি ওভাবে ভেবে দেখিনি।
রে, তোমাকে বলা হয়নি, এক মাস হলো আমি অন্য কারও হয়ে আছি। আসছে সপ্তাহেই পার্টি ছিল, আশা ছিল তোমাকে নেমন্তন করব, সেখানেই জানবে। তার আগে এমন কিছু হবে জানতাম না। মানি আমি, আমরা পাশাপাশি চলেছি। কিন্তু আমার কাছে তার মানে এমন দাঁড়ায়নি কখনও।
আমাকে ক্ষমা করো রে।
বিনা মেঘে বজ্রপাত- কথাটি শুনেছি অনেকবার, ক্যাথির কথার পরে অনুভব করলাম কথাটির ভয়াবহতা কেমন। ক্ষণিকের জন্য পেছনের দিনগুলোতে ফিরলাম। সেইসব পানশালার রাত, ঘটিকার পর ঘটিকা একসাথে জড়ানো-নেতানো সময়, তার আদর-আহ্লাদের সব কথা, সবগল্প, ভালোবাসার কথা; কি মানে দাঁড়ায়। ... উঠে দাঁড়ালাম।
বললাম, দুঃখিত ক্যাথি। তোমাকে জ্বালাতন করলাম। কিছু মনে করো না। ক্যাথি কিছু বললো না। কিছু না বলেই ধীরে ধীরে চলে গেল।
আমি তাকিয়ে রইলাম মূর্তির মত। সেই যে গেল, তার যুগলবন্দী পার্টির নেমন্তনও আর আসেনি।
সেই প্রথম, আলোর মাঝেও শহরকে অন্ধকার লেগেছিল। হঠাত করে মাহরাতে শহরে আলো বড় কম পড়েছিল। বাদকের দল শুনছিল আমাদের কথা।
তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের নেতাকে ডাকলাম। বললাম, মাতমের সুর জানো? আর্তনাদের, হাহাকারের? বর্ষার জলের মত, চোখের ধারার মত, বাজাও। সারা রাত বাজাও। উল্লাস হোক আজ, তবে মাতমের! সেরাতে ভোরের দিকে সেবাদাতারা আমাকে ধরে শয়নঘরে পৌঁছে দেবার আগ পর্যন্ত পান করেছিলাম।
বাদকেরা বাজিয়ে গেছে। তাদেরকে ডেকেও পান করতে বলেছিলাম। তারা করেছে, বাজিয়েছে।
আজ ত্রিশটি বছর পরে যখন সেরাতে কথা মনে হয়, খুব হাসি পায়। হেসে উঠি।
তার আড়ালে চিনচিনে একটি ব্যথা এখনও বুকের এপার থেকে ওপারে যায়। কেউ জানে না। আমিও জানি না। আমি তো ভুল করে ভুলে থাকি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।