আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৃষ্টি : এক আত্মমগ্ন বীজগান

আহমদ ময়েজ

একদিন আল মাহমুদের কবিতার মতো বৃষ্টির ঘা খোলা পিঠে বিদ্ধ হলে আমাকে কবিতায় পেয়ে বসে। তখন থেকে বৃষ্টির শব্দ ও কবিতার তরঙ্গ সমান্তরাল হয়ে নিরন্তর বাজতে থাকে। বৃষ্টি আমার কাছে এক অনাগত বীজগীত - মাটিকে সিক্ত করে যে কেবল পোয়াতি করে তুলে। বৃষ্টিকে দেখি শুধু সৃষ্টি এবং রমণীয় কলায়, পৌরুষ পাগল করা তীব্র গতিধারা যে কেবল গমকে গমকে উগরে দেয়, রেখে যায় জন্মের দাগ। গভীর অরণ্যের ভেতর বৃষ্টির শব্দ সাধুদের ধ্যানের মতো মনে হয়।

মানুষ হয়ে ওঠে ধীমান। সুক্ষ্ম চিন্তার ভেতর খোলে যায় জীবনের অসংখ্য কপাট। এই জগৎ-সংসার তখন ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দেয়। বৃষ্টি-জল-পানি - সবই ভিন্ন ভিন্ন নাম অথচ একই রঙ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আদরিনী হয়।

অন্যদিকে সুফি-বাউল-ফকিরদের ভাষায় এর আরও অনেক তাৎপর্য রয়েছে। একফোটা বৃষ্টি কিংবা জলের সন্তান এই জগৎ-সংসার। প্রকৃতি-মানুষের গর্ভধারণকে তারা এভাবেই সনাক্ত করেন। অথবা কবিতার ভাষায়- আমি তো কাবিলের বোন একবিন্দু জল দাও রেখে যাবো জন্মের দাগ ...। এই দেখার ভেতর অন্যরূপ, ভিন্ন ঘ্রাণ, যৌগিক স্বাদ বিরাজিত।

বৃষ্টির এই রূপকে একদিন অনুভব করি নিজের সত্ত্বায়। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে অরণ্যঘেরা এক বাড়িতে রাত কাটাই। ঘুঁটঘুটে অন্ধকার। প্রবলবেগে বৃষ্টি নামছে। তোশকের ভেতর শব্দ-ধ্বনি বিড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আসছে।

গভীর আবেগে আমি কুজো হয়ে লেপ আকড়ে ধরি। নুপুরের ধ্বনির মতো আধোঘুম আধোজাগনার ভেতর অসংখ্য পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই। একটু একটু করে যখন বৃষ্টি ধরে আসে তখন রাগাশ্রয়ী সুর-তান আমাকে এক গভীর অরণ্যের ভেতর ফেলে দেয়। জগৎ-সংসার তুচ্ছ হয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে থাকে। আকাশটা আষাঢ়ের জলে ভরা পোয়াতি।

কবিতার চরণ ধরে আমি তখন কেবল জপতে থাকি- মেঘের পোয়াতি মেয়ে বর্ষা তাহার বিচরণ ভূমি অরণ্য নগর কেউ তাকে বধ করো না, রাঙিয়ো না চোখ সে আমার গহন মেঘদূত মেঘের বার্তাবাহক সকল কোমের। এতো কান্না বুকে নিয়ে ভরসায় হাঁটে ... ধুলার পৃথিবী পায় চরণ-নূপুর স্নিগ্ধ শরীরে খেলে বীজগান ভরাট মাটির গন্ধ সরিষা দানার গন্ধ মেঘবতী রচনা করে অসংখ্য পায়ের আওয়াজ। জোড়া-জোড়া পা লক্ষ কোটি পা মন্ত্র-মুগ্ধ করে বেড়ে ওঠে আমাদের ঘরে। মেঘের শরীরে আজ জোৎস্না-প্লাবন শৈত্য-প্রবাহ দিনে, বর্ষা ঘুমায় চাঁদ ও তারার দেশে। মেঘবতী পোয়াতি হলে আমার ভেতর এভাবে বৃষ্টির সরোদ বাজতে থাকে।

আবার নদী কিংবা বিলে বৃষ্টির শব্দ আরো এক বিচিত্র সুর তৈরি করে। পানি থৈ থৈ করে একপাল রাজহংস যেনো ভেসে যাচ্ছে-। নৌকায় বসে দেখা এই দৃশ্যপট সারাজীবনের জন্য চোখের মধ্যে গেঁথে আছে। একবার মনে হয়েছিল কেন ভেসে যাই না মাছেদের সাথে, কচুরিপানার সাথে কিংবা হাঁসের পালের সাথে। ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টির ভেতর দূরে জেলেদের নৌকাগুলোকে অবাধ স্বাধীনতার মতো মনে হয়-যেখানে পৌঁছে গেলে আর ফেরার কোনো তাগিদ থাকবে না।

ছোটবেলায় বাড়ি থেকে কিছু দূরে বেঁদের নৌকা থেকে ভেসে আসা ডাহুকের ডাক আর বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ওদের কূপির আলো আমার বুকের ভেতর সর্বনাশা-বাতিঘর হয়ে জ্বলছে। কতদিন ইচ্ছে হয়েছে মাগুরার গাঙ সাঁতরে পৌঁছে যাইনা কেন ওদের ছইয়ের ভেতর - যেখানে এক পৃথিবী রহস্য লুকিয়ে আছে। সে রহস্য প্রতিনিয়ত ভাবায় এবং তাড়ায়। এই রহস্যগুলো কেবলই ভরা বর্ষায় জাগ্রত হয়। হেমন্তের টানে নৌকাগুলো কোথাও নাই হয়ে গেলে শুষ্ক শুষ্ক ম্রিয়মান দিন কাটে।

যতীন্দ্র মোহন বাগচী’র কবিতা ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলকবলা কাজলা দিদি কই। ’ - এই কবিতার সাথে বৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমার কৈশোরের পুরোটা সময় এই কবিতা বৃষ্টির রাগ হয়ে বাজে। অঝোর ধারা বৃষ্টির দিনে এই কবিতাটি মুখস্ত করেছিলাম বলেই হয়তো এর দুঃখ দুঃখ সুরগুলো বৃষ্টির নীরবতার মতো মনে হয়। ‘... দিদির কথায় আচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো।

’ কিংবা ‘আমিও নাই দিদিও নাই কেমন মজা হবে। ’ এমন দিনে আমাদের বাড়িতে বেতের কাজ-আদি-মুসল্লা-পাটি বাইনের ধুম পড়ে যেতো। বারান্দা জুড়ে মুরতা কেটে মিহি করে বেত তোলা হতো। আমরা ভাই-বোনেরা হৈ-চৈ করতে করতে বড়দের কাজে ভীষণ ব্যাঘাত ঘটাতাম। আম্মা তখন রাগ করে হাতে বই ধরিয়ে জোর করে পড়ায় বসিয়ে দিতেন।

এমনি এক বেদনা-বিধুর ক্লান্তিকর বৃষ্টির দিনে আমি কবিতাটি মুখস্ত করি। সেই সাথে এক কিশোরীর নির্জীব মুখ চাঁদের মুখে শুয়ে থাকা, আর বাঁশবনের ভেজা ভেজা পাতাগুলো কান্না হয়ে মাটির বুকে ঝরে যাওয়া দৃশ্যগুলো, কখনও স্বপ্নের ভেতর দীর্ঘকায় হয়ে দেখা দেয়। ঘুমের ভেতর ফুঁপিয়ে উঠি। পৃথিবীর সকল মায়া-টান অকার্যকর হয়ে ওঠে। আকাশ ভেঙে হু-হু করা রোদন নামতে থাকে।

সমস্ত পৃথিবীকে মনে হয় বৃষ্টির ধোয়ায় ডুবে যাওয়া এক শূন্য জনপদ। বৃষ্টির তাড়া খেয়ে একবার হরিজনদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল শিলাবৃষ্টি। বড় বড় পাথর-একপোয়া ওজনের। মাথা ফেটে যাবার উপক্রম।

বাঁকা-চোরা বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকেনি, কয়েক মুহূর্ত মাত্র। হরিজনদের ধূলাভর্তি উঠান তেমন ভিজেও উঠেনি। সমস্ত উঠান জুড়ে বৃষ্টির ফোটা ধুলামুখ নিয়ে ছোটো ছোটো বেলুনের মতো ফুটে আছে। আর একটু বেশি হলে থকথকে কাদা হয়ে যেতো। পরক্ষণেই বাচ্চারা কলকল করতে করতে উঠানে নেমে আসে আর ফুটুস করে বেলুনগুলো ফাটিয়ে দেয়।

আজও আমার মাথাজুড়ে উঠানভর্তি ধূলারফুল ফুটে আছে। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এই বিলেতে পুরো শীতজুড়েই মেঘলা-মেঘলা, বৃষ্টি-বৃষ্টি নিয়ে সময় কাটে। আমি বাংলাদেশের ভাটির দেশের মানুষ। কৈশোর-তারুণ্য কেটেছে গ্রামে। শহরে গিয়েছি একজন আগুন্তুকের মতো।

বিলেতের বৃষ্টির রঙ একটুও বদলায়নি। প্রচ- বৃষ্টির ভেতর মনে হয় নলোয়া-হাওরে উপচে পড়ছে জল - স্রোতের টানে দল বেঁধে নামছে মাছের ঝাঁক। হু হু করে পাহাড়ি ঢল নামছে আর গ্রামগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। উঁচু ভিটাবাঁধা বাড়িগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। সকল দুর্যোগের ভেতরও বৃষ্টিস্নাত সময়কে আমার কাছে এক দীর্ঘ আত্মমগ্ন রাতের মতো মনে হয়।

এই আত্মমগ্ন বাহুর ভেতর আজও না দেখা গভীর এক অরণ্যের স্বপ্ন দেখি। বৈঠা : বৃষ্টি সংখ্যায় প্রকাশিত ২০০৭।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.