চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাসিস্ট প্রশাসন এবার তার মধ্যযুগীয় হিংস্র নখ ও দাঁত প্রদর্শন করে ছাত্রীদের ভয় দেখাতে শুরু করেছে। কয়েকদিন থেকেই আশঙ্কা করছি এই জল্লাদরা অচিরেই দ্বিগুণ হিংস্রতা নিয়ে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। বর্বর মধ্যযুগীয় সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নস্যাত করতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারিরা আন্দোলনের নেতা কর্মীদের বহিষ্কার, মামলা ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাদের পরিবারবর্গকে এসব হুমকি দিয়ে ছাত্রীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এই জঘন্য বর্বরতার প্রতিবাদ জানাবার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
পূর্ব ঘটনা হল, ছাত্র বিক্ষোভে টালমাটাল বিগত কণ্ঠরোধী জরুরী সরকার ছাত্রদের সোজা মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়ার অংশ হিসাবে তথাকথিত 'ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্য পালনীয় আচরণ বিধি' নামক এক বর্বর আইন পাশ করে। এই বিধিতেই ছাত্রীদের মাগরেবের নামাযের পর হলে ঢুকতে বাধ্য করা এবং এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের মধ্যযুগীয় সান্ধ্য আইন ঘোষণা করা হয়। (এ আইনে ছাত্রদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার হরণকারী ধারাগুলো এখানে আর উল্লেখ করলাম না। )
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দলীয়কৃত ফ্যাসিস্ট প্রশাসন সেই ফ্যাসিস্ট কালাকানুন বাস্তবায়নের জন্য আদাজল খেয়ে নামে। তারা জরুরী সরকারের ধারাবাহিতা বজায় রেখে ক্যাম্পাসে সকল ধরণের আন্দোলন-সংগ্রামের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
আন্দোলনকারীদের ছবি সংগ্রহের জন্য ক্যামেরা, ভিডিও চিত্র গ্রহণকারী নিয়োগ করেছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণের পরিণাম সম্পর্কে হুমকি দিয়ে চলেছে। সিসি টিভি ক্যামেরা বসিয়ে পুলিশি ক্যাম্পাস কায়েম করেছে। এমনকি প্রশাসনের খবরদারি এতদূর গড়িয়েছে যে, চায়ের দোকানে ছাত্রদের আড্ডাও ভেঙ্গে দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের এক নারী নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে এক শিক্ষক আমলার মিথ্যা অভিযোগে প্রশাসন আন্দোলনকারী জাহিদুর রহমান রোকনকে বহিষ্কার করে।
অথচ, সেই শিক্ষকের মেয়ে নকলসহ হাতে নাতে ধরা পড়লেও কোন শিক্ষক তাকে শাস্তি দেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি।
এই যখন অবস্থা, তখন গত কয়েকদিন আগে ফ্যাসিস্ট প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র সান্ধ্য আইন বলবৎ করার জন্য কড়াকড়ি শুরু করে। ফলে ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ছাত্রীরা হলের প্রভোস্টের কাছে এর প্রতিকার প্রার্থনা করে। কিন্তু, ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ প্রশাসন তাদের কথার তোয়াক্কাই করেনি, তাদের স্মারকলিপি পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।
গতকাল ২১ অক্টোবর খালেদা জিয়া হলের ছাত্রীরা সন্ধ্যারপর হল গেটের বাইরে প্রতীকী অবস্থান নিয়ে সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং প্রভোস্টকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানের জন্য ছাত্রীদের মাঝে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু, এবারও প্রভোস্ট তাদের কথায় কোনই কান দেয় নি। অবশেষে ছাত্রীদের এক প্রতিনিধি দল প্রভোস্টের সাথে দেখা করে দুই দিনের মধ্যে সান্ধ্য আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত জানাতে বলে। প্রভোস্ট ছাত্রীদের সাথে যথেচ্ছ দুর্বব্যবহার করে। আর পরদিন সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টোর এবং থাসা পুলিশ ফোনে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের পরিবারের প্রতি হুমকি-ধামকি শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারী ছাত্রী এবং তাদের মধ্যে গভীর অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সচেতনভাবে দেশের গতিপ্রকৃতি যারাই লক্ষ্য করছেন, তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, এক এগারোতে বিদেশী শক্তির ইন্ধনে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এদেশে সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় স¤প্রসারণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল বাধা দূর করা। বর্তমান সরকার যে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সমঝোতা করে ক্ষমতায় আরোহন করেছে তা আজ দিবালোকের মত পরিষ্কার। (কেউ যাতে বিভ্রান্ত না হন তার জন্য বলে রাখা দরকার বিএনপিসহ চারদলীয় জোট এই নীলনকশা বাস্তবায়নে অক্ষমতার কারণেই বিদেশী প্রভূদের কাছে আপাততঃ বর্জিত হয়েছে, তার বিরোধীতা করার জন্য নয়। ) দেশবিক্রিসহ এই মহাপরিকল্পনার অন্যতম ক্ষেত্র হলো শিক্ষা।
শিক্ষা সংস্কারের নামে জাতীয় স্বার্থ ও প্রয়োজন পদদলিত করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে তারা স্রেফ সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস তৈরী ও সরবরাহের ডাইসে পরিণত করছে। এ জন্য ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র, শিক্ষানীতি প্রণয়ন ইত্যাদি করা হচ্ছে। কিন্তু, এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে ছাত্র সমাজ বিগত জরুরী আমলেই নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে আর তারই ফলশ্রুতি হলো এই ফ্যাসিস্ট আচরণ বিধি। আর এই সামন্তীয়-মধ্যযুগীয় প্রশাসন কেবল নারীদের উপর পিতৃতান্ত্রিক সান্ধ্য আইনই চাপিয়ে দিচ্ছে না, তারা আন্দোলন দমনে বয়ঃপ্রাপ্ত ছাত্রদের উপর পশ্চাদপদ পারিবারিক কর্তৃত্বের অসদ-ব্যবহার করতেও উঠে পড়ে লেগেছে।
অথচ ’৫৪-এর যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচন থেকেই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী- এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম দাবী হিসাবে সামনে এসেছে।
অনেক রক্ত দিয়ে ১৯৭৩ সালে সে দাবীর কিছুটা অর্জিতও হয়েছিল। একটা স্বাধীন-গণতান্ত্রিক সমাজে মুক্তচিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সমাজের বিকাশের জন্য জরুরী বলেই মধ্যযুগীয় ধারণার বিপরীতে শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত ধারণাটার আবির্ভাব ঘটেছিল। যেখানে ছাত্র-শিক্ষক-গ্র্যাজুয়েট এই ত্রয়ীর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হবে বিশ্ববিদ্যালয়। আমলাতন্ত্র নয়, প্রশাসনেও থাকবে এই ত্রয়ীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। গুরু-শিষ্যের মধ্যযুগীয় ধারণার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা জুনিয়র স্কলার আর শিক্ষকরা সিনিয়র হিসাবে বিবেচিত হবেন।
অথচ আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখছি শিবিরিও মধ্যযুগের স্থান নিচ্ছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও সামন্তবাদ। নিঃশেষিত হচ্ছে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সব অধিকার।
ভাবলে মন বিষিয়ে ওঠে যে, মুক্ত চিন্তার বিদ্রোহী মানস ছাত্ররা বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বলেই ৬২, ৬৪, ৬৬, ৬৮. ৬৯ ৭১, ৯০-এর গৌরবময় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে, অথচ আজ তাদেরই কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, খুপড়ির মধ্যে আটকে রেখে দাস বানানোর চেষ্টা চলছে। আজ তাই বার বার মনে হচ্ছে, সেই সাহসী শহীদ আর লড়াকু বীরদের কথা আমরা যাদের উত্তরাধিকার বহন করছি। আমরা কি তাদের কাছ থেকে সাহস সঞ্চয় করতে পারব? পারব ঐ 'দানবকে হত্যা' করতে?
আজ চ.বি. ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আহ্বান, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেন না।
সরীসৃপ-জীবন আমাদের হতে পারে না। আপনারা সাহসের সাথে রুখে দাঁড়ান। সারা বাংলাদেশ আপনাদের সাথে থাকবে।
গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সকলের প্রতি আহ্বান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াইরত ছাত্রীদের পাশে সবরকম সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসুন। অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান আপনারাও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস যোগান।
এ লড়াই কেবল নির্দিষ্ট হলের, কেবল ছাত্রদের, কেবল মেয়েদের লড়াই নয়, যে জন্য আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি, অনেক নিপীড়ন সহ্য করেছি, ঘাম ঝরিয়েছি, যে সংগ্রাম শত বছরের, আমাদের সেই স্বাধীন-গণতান্ত্রিক একটা দেশের জন্য সংগ্রাম, তারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই লড়াই। এ লড়াইয়ে জিততেই হব-লাখো শহীদের কসম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।