ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সুনিশ্চিত সুশাসন
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------------------------
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, শ্লোগানটি বেশ পরিচিত। তা বলেন অনেকেই। প্রায় প্রতিটি দলের ম্যানিফেস্টোতে সে কথাটি আছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যাশায় কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়? না, হয় না। আর হয় না বলেই শাসক শ্রেণীর আশপাশে তোষামোদকারী ফড়িয়া শ্রেণী ভিড়তে পারে।
স্বার্থবাদী একটি পক্ষ কলুষিত করতে পারে মানুষের স্বপ্নকে।
বাংলাদেশে একটি বিতর্ক এখন বেশ তুঙ্গে। তা হচ্ছে, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম স্থানীয় সাংসদদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কে কি করবেন, সেই রুটিন নিয়েও চলছে মতবিরোধ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দুটি পদই সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত।
সাংসদ এবং উপজেলা চেয়ারম্যান দু'জনই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তারপরও স্থানীয় সাংসদরা একটা বিশেষ দাপট দেখাবার প্রয়াসী হচ্ছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা সরাকরের সহযোগিতাও পাচ্ছেন বেশি।
এই যে দ্বন্দ্ব, এর প্রধান কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলবাজির প্রভাব। যেহেতু উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারেন না, তাই তারা সে পরিচয়ও দিতে পারেন না।
আর সেই সুযোগ কাজে লাগান দলীয় সাংসদরা। ফলে স্থানীয় সাংসদ এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের মাঝে যে ঐক্য গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা ওঠেনি কিংবা উঠছে না। দ্বন্দ্বটা সেভাবেই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে।
বিশ্বের উন্নত অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দু'স্তর বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি প্রথা চালু রয়েছে। ভারতে রয়েছে স্থানীয়-প্রাদেশিক প্রশাসন।
আর রয়েছে কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) প্রশাসন। একই অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটর প্রথার পাশাপাশি রয়েছে স্টেট গভর্নমেন্ট এবং ফেডারেল গভর্নমেন্ট। প্রতিটি স্টেটেও রয়েছে স্টেট সিনেটর, স্টেট কংগ্রেসম্যান প্রথা। এই যে দু'স্তর বিশিষ্ট প্রতিনিধি হাউজ, সেখানে কিন্তু এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের কোন বৈরিতা নেই।
কেন নেই? কারণ দু'টি পক্ষই রাষ্ট্র এবং সুশাসনের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগে বিশ্বাসী।
সেখানে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের কোন সুযোগ এবং ইচ্ছা কারোরই নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই রাজনৈতিক সম্প্রীতিই জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বিশেষ সহায়ক হয়েছে। খুলে দিয়েছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশস্ত পথ।
প্রায় পনেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে গণমানুষের স্বপ্ন পূরণের কথাটি অনেক সংগঠনই বলে আসছে।
এর বাস্তবায়নে কাজ করা প্রয়োজন। কারণ মজবুত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে গ্রামীণ জনপদ তথা গোটা রাষ্ট্রের মৌলিক অবকাঠামোর উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমার জানা মতে, স্থানীয় সরকার বিষয়ে দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর ধরে কাজ করছেন একজন সংগঠক, গবেষক। তার নাম আবু তালেব। তিনি যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী হলেও, বাংলাদেশের মানব সম্পদ ও স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।
অতি সম্প্রতি তার প্রতিষ্ঠিত অর্গানাইজেশন 'সেন্টার ফর ডেমেক্রেটিক লোকাল গভার্নেন্স'-এর পক্ষে একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছেন নির্বাহী পরিচালক আবু তালেব। আর তা হচ্ছে- 'গণস্বপ্ন ২০২০ : উন্নত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ - ২০২০'।
সংগঠনটি যে সব দাবিগুলোর বাস্তবায়ন চেয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে তার প্রধান কিছু দাবির সঙ্গে সহ মত পোষণ করে আলোচনায় যেতে চাই।
ক. যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এর বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে গণমুখী নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
খ. ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ণ সুনিশ্চিত এবং সমানুপাত করতে হবে। তাদের জন্য সরকারি ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ. ইউনিয়নের সংখ্যা ৪৪৯৮টি থেকে কমিয়ে ৩০০০টিতে এনে সিস্টেম কস্ট হ্রাস করার উদ্যোগ নিতে হবে। সব স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনের মেয়াদ চার বছর করতে হবে।
ঘ. কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের জাতীয় এবং বৈশ্বিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারগুলোর দায়িত্ব পালনে গঠনমূলক সহযোগিতা দিতে হবে।
মোট সতেরো দফা দাবিনামার পক্ষে কাজ করছে সংগঠনটি যদিও সব ক'টি দাবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানা সম্ভব নয়। কোন সরকার তা মানবেও না।
কতটা জনগণ সংশ্লিষ্ট হলে একটা দাবি জাতীয় সংসদে পাস হয়_ তার উদাহরণ বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। যে সব সাংসদ জাতীয় সংসদকে সব প্রত্যাশার কেন্দ্র বিন্দু বলে দাবি করেন, সেই সংসদেই কোরাম সঙ্কট দেখা দেয়। বাংলাদেশে তা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারকে গণমুখী করলে কিংবা করতে পারলেই গণতন্ত্রের চর্চা এবং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এর প্রধান অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিছু কিছু শীর্ষ নেতাকে বলতেও শুনেছি, স্থানীয় পর্যায়ে সবল নেতৃত্ব বৃদ্ধি পেলে তাদের নিজেদের জন্যই নাকি 'ফ্রাংকেনস্টাইন' তৈরি হয়। তাই তারাই কেন্দ্রে অবস্থান করে সব কলকাঠি নাড়তে চান। এবং নেড়েও যাচ্ছেন।
বর্তমান জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে আওয়ামী লীগের। অতি সম্প্রতি আমরা দেখলাম স্পীকার আবদুল হামিদ নিজের দলের, নিজের সরকারের, সংসদে উপস্থিতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তা নিয়ে বিরোধীদল সমালোচনার মওকাও পেয়েছে। এর জবাবে পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, স্পিকার মহান সংসদের প্রভু নন, সেবক।
তাদের এই বচসা যদি লোক দেখানো না হয়, তাহলে তো আমরা ধরে নিতে পারি সরকারের ভেতরে একটা নীরব স্নায়ুযুদ্ধ চলছে।
এটা কিসের লক্ষণ?
মন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় সংসদে আসতে পারবেন না বা পারেননি, এমন অজুহাত থাকতেই পারে। কিন্তু এর সমন্বয় সাধিত হচ্ছে না কেন?
প্রধান বিরোধীদল সংসদে আসছে না। ছাড় দিয়ে হলেও এই বিষয়টি সমাধান করা উচিত সরকার পক্ষের। কারণ জনগণের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানতে হবে সর্বাগ্রে।
নিউইয়র্ক, ১৩ অক্টোবর ২০০৯।
-----------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ১৬ অক্টোবর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- বের্ন্ট জোহানসন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।