সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
টিএসসিতে একদিনঃ
ঢাকায় বসবাসরত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আড্ডার জন্য কোন জায়গা সবচেয়ে প্রিয় তবে অধিকাংশই উত্তর দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র। টিএসসি নামেই যার পরিচিতি। ঢাকার বাইরের তরুণ-তরুণীদের অনেকেই ঢাকায় আসলে ঢুঁ মারেন টিএসসিতে। এখানে আড্ডা দেয়া মানুষগুলো সবাই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী তা নয়। টিএসসিতে আড্ডা দিতে আসেন প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, লেখক, আঁকিয়েসহ সর্বস্তরের মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এখনও টিএসসিতে আসেন স্মৃতির টানে। আমরাও জনাকয়েক বন্ধু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গিয়েছিলাম-টিএসসি তে আড্ডা দিতে। আমরা সবাই ১৯৮৪ পুর্ব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।
সকাল ১০টা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা টিএসসির আশপাশের ফুটপাত ঝাড়ু দিচ্ছে।
রিকশা, গাড়ি চলছে বিরতিহীন। তখনও টিএসসিতে তরুণ তরুণীদের ভিড় বাড়েনি। ডাসের আশপাশে বিচ্ছিন্নভাবে বসে আছে তিন জোড়া তরুণ-তরুণী। ডাসের পশ্চিম পাশের গেটে মোবাইল ফোনের দোকান। সাড়ে ১০টার দিকে দোকান খুললেন মাহমুদ।
দোকান বলতে একটি টেবিল, একটি চেয়ার আর শেকলবদ্ধ দুটি মোবাইল ফোন। দোকান খোলা মাত্রই দুইজন তরুণী এসে দাঁড়িয়ে গেল ফোন করার জন্য। মনে হচ্ছিল তারা যেন অপেক্ষা করছিলেন। একজন ফোন করেই ধমকের সুরে বললেন, তোমার জন্য একঘণ্টা ধরে বসে আছি টিএসসিতে। তাড়াতাড়ি আস।
বলেই ফোন কেটে দিলেন। বোঝা গেল তিনি বন্ধুর জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। আরেকজন ফোন করে বললেন, হ্যাঁ, আমি মুনা। বাবা ভালো আছ? এইমাত্র হল থেকে বের হলাম। ক্লাসে যাচ্ছি.........
হঠাৎ চোখ পড়ল রাজু ভাস্কর্যের ওপর।
একটি ছেলে একা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রাজু ভাস্কর্যের দিকে। যেন স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতা খুঁজছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল, আংকেল, স্বাধীনতা দেখিনি। গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করছি। প্রশ্ন করলাম ভাস্কর্যে কেন? উত্তর দিল, বর্তমান ইতিহাস পড়ে আর রাজনৈতিক অবস্থা দেখে তো আর স্বাধীনতা উপলব্ধি করা সম্ভব না।
তাই ভাস্কর্যগুলোই ভরসা।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম একদল ফটোগ্রাফার ও ক্যামেরাম্যান গিয়ে দাঁড়াল রাজু ভাস্কর্যের ওপর। প্রথমে কিছুই বোঝা গেল না। একটু পরেই বিষয়টা পরিষ্কার হলো। একটি পতাকা মিছিল এগিয়ে আসছে চার নেতার মাজার থেকে টিএসসির দিকে।
সামনে বিশাল একটি বাংলাদেশের পতাকা। মিছিলের সবার হাতেও লাল আর সবুজের সমারোহ। কী মোহনীয় দৃশ্য! না দেখলে বিশ্বাস করার নয়। যেন পুরো বাংলাদেশ। স্লোগান কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।
স্লোগানটি এরকম গণতন্ত্রের চেতনায় এক হও এক হও, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, দেশবাসী এক হও। ক্রমেই মিছিলটি টিএসসি অতিক্রম করে শাহবাগের দিকে চলে গেল। একটি শর্ট ফ্লিমের শুটিং দৃশ্য ছিল ওটি।
খানিক পরেই একদল তরুণ-তরুণী সেই রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হলো। খেয়াল করে দেখা গেল তাদের সাথে রঙের বালতি, রঙ, ব্রাশ ইত্যাদি।
তারা এসেছেন টিএসসির মোড়ে আল্পনা করতে। প্রথমে কতক্ষণ চলল রঙ গোলানোর পালা। তারপর এক পাশের রাস্তা দড়ি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো। তরুণ-তরুণীদের প্রায় সবাই চারুকলার। অন্যরা দাঁড়িয়ে দেখছেন সেই শিল্পকর্ম।
দর্শকদের মধ্যে একদল পুলিশও আছেন।
ইতিমধ্যেই তরুণ-তরুণীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে টিএসসি ও তার আশপাশ। এবার টিএসসির ভেতরে। ঢুকতেই এলোপাতাড়িভাবে বসে থাকা কতকগুলো গ্রুপ চোখে পড়ল। সবাই আড্ডা দিচ্ছেন।
প্রচন্ড রোদের মধ্যেও অনেককে মাঠের মধ্যেই বসে থাকতে দেখা গেছে। একেক আড্ডার আলাপের বিষয় ভিন্ন। কেউ পড়াশোনা নিয়ে আলাপ করছেন। কেউ তাদের প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। কেউবা তাদের রাজনৈতিক মতবাদ ব্যক্ত করছেন।
মিলনায়তনে চলছে কোন একটি অনুষ্ঠান। তবে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বাইরে বসে আড্ডায় মশগুল। তেমনই এক গ্রুপের সাথে কথা হলো। তারা জানালেন, টিএসসিতে আসেন স্রেফ আড্ডা দিতে। ক্লাস না থাকলেও সবাই মিলে আড্ডা দেয়ার জন্য টিএসসিতে আসি।
প্রশ্ন করলাম, এটির নাম টিএসসি অর্থাৎ টিচার্স স্টুডেন্টস সেন্টার। কিন্তু আপনারাতো সারাক্ষণ ছাত্রছাত্রীরাই আড্ডা দেন। বলতেই সবাই হো হো করে হেসে উঠল। তবে কোনো উত্তর দিল না।
সূর্যিমামা মাথার উপর উঠে খানিক হেলেও পড়েছে।
ঘড়ির কাঁটায় পৌনে দুইটা। সবার চোখেমুখেই ক্ষুধার্ত ভাব। কেউ ছুটছেন মধুর ক্যান্টিনের দিকে। কেউ ডাকসুর ক্যান্টিনে। তবে অনেকেই গেলেন নীলক্ষেতের তেহারি খেতে।
বোঝা গেল নীলক্ষেতের তেহারি এখনও দারুণ জনপ্রিয়। বলতে গেলে ওখানের খাবার খেয়েই আমরাও বড় হয়েছিলাম!
দুপুর বেলাতে টিএসসি একটু খালিমতো হলেও তিনটার পর থেকে তরুণ তরুণীদের ঢল নামে টিএসসিতে। ডাস সংলগ্ন জায়গা, টিএসসির সামনের অংশ আড্ডারত তরুণ-তরুণীতে ভরপুর। তবে ডাস সংলগ্ন জায়গাটিতে অধিকাংশই কপোত-কপোতী। তাদের মধ্যে অনেকে লজ্জাহীন।
তাদের আচরণ দেখার মতো নয়। তবে যারা নিয়মিত টিএসসিতে আসা-যাওয়া করেন তাদের চোখে সয়ে গেছে ওই দৃশ্য। বিকেল থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন নাট্যদল, আবৃত্তি দলের মহড়া। অর্থাৎ টিএসসি শুধু ছাত্র শিক্ষক না, পরিণত হয় সর্বস্তরের মানুষের আড্ডাস্থলে। একজন বলেই ফেলল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি।
কিন্তু নাট্যদলের সুবাদে সন্ধ্যায় টিএসসিতে আড্ডা দিতে পারি। তাইবা কম কিসে!
সূর্য ঘরে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু তখনও টিএসসিতে তরুণ-তরুণীরা আসছে-যাচ্ছে। একে একে দলে দলে। যেন তরুণ-তরুণীদের এক মহা মিলনস্থল।
আমরা ফিরে যাচ্ছি-যার যার স্থায়ী অবস্থানে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।