আমার মৃত্যু যেন আমার সকল ইচ্ছা পূরণের পর হয়
গ্রামের ছোট্ট মেয়ে তুলি, বয়সের চেয়ে একটু পাকা বলা চলে। সারাদিন গ্রামে ছুটে বেড়ানো, কাশবনে সখীদের সাথে লুকোচুরি খেলা, বাড়ীর পাশের ছোট্ট জঙ্গলে মায়ের ভয়ে লুকিয়ে থাকা, আর জানালা দিয়ে বাবার বাড়ী ফেরার অপেক্ষা। এতটুকু একটা মেয়ের জন্য এতকিছু একটু বেশি বেশি। বয়স মাত্র ৭। বাবার আদরের মেয়ে মাকে একটু ভয় পেলেও মায়ের সাথে তার একটা অন্যরকম সর্ম্পক আছে।
তুলির বাবা তার মেয়েকে একটু বেশি আদর করে হাট থেকে ফেরার পথে চুড়ি, ফিতা, জিলাপী বা বাতাসি নিয়ে আসবেই, তুলির মা একটু নারাজ হলেও তুলির বাবার কারনে কিছু বলতে পারে না।
তুলির বাবার হাটে ছোট্ট একটা দোকান আছে। মোটামুটি সচ্ছল বলা চলে। বাবা মারা যাবার পর যেটুকু জমি পেয়েছিলো তা দিয়েই ঘর বানিয়েছে আর জমানো কিছু টাকা দিয়ে হাটের দোকানখানা। বলতে গেলে সুখী একজন মানুষ তিনি।
তুলির বাবা তুলিকে অত্যাধিক ভালবাসেন। সামান্য একটু জ্বর সর্দি কাশি হলেই চেচামেচি শুরু করে দেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখানো, জলদি সারিয়ে তোলা, এ যেন একটু বেশি বেশি আর আট-দশটা বাবার চাইতে। তুলির মা তার স্বামীকে সব দিক থেকেই সাহায্য করেন। স্বামীর আর্থিক অনটনে নিজের হাতের বালা, কানের দুল, বাপের বাড়ী থেকে পাওয়া জমিটুকু দিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না।
তুলির বাবার আর্থিক অনটনের সময় যদিও তিনি এটা নিতে চান নি কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধের কারনে তিনি তাকে নিরাশ করেন নি। তাদের সর্ম্পকটা বেশ। তুলির জন্মের দুবছর পরে তুলির মা'র গর্ভের একটা সন্তান মারা যায় আকস্মিত কারণে। তুলির মা ব্যাপার টা সহ্য করতে পারেন নি। প্রায় ছয়-সাত মাস পাগলের মত ছিলেন।
তুলির বাবা সে সময় ছোট্ট তুলি কে এবং তার মা'কে সামাল দিয়েছেন একাই। তাই তাঁর এ দুজনের প্রতি ভালবাসা অনেক।
তুলির বয়স সাত বছর হলেও সে স্কুলে যায়না। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকরা অনেক অনুরোধ করেছে তার বাবাকে কিন্তু তুলির বাবা কোন মতেই রাজি হয়নি। বিষয়টা একটু ভিন্ন।
তুলির বাবার সাথে তার মায়ের প্রায়ই এ নিয়ে ঝগড়া হয়। মেয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো স্কুলে যাচ্ছে না বলে। কিন্তু তুলি চালাক মেয়ে, ঘরে বসেই সে তার বাবার কাছ থেকে অনেক গুলো কবিতা,ছড়া, গল্প শিখে ফেলেছে। গ্রামের সবাই তাঁকে প্রশ্ন করে এ ব্যাপারে কিন্তু তাঁর এক কথা তাঁর মেয়ে সে যা ইচ্ছে তা করবে, লোকজনের পরোয়া সে করেনা। ব্যাপারটা আর্শ্চযজনক হলেও এর পিছনে ছোট্ট একটা কারন জড়িয়ে আছে।
তুলি মাঝে মাঝে অচেতন হয়ে পড়ে কোন একটা কারনে, অচেতন হবার পরেই প্রচন্ড জ্বর হয় এবং শারীরিক দূর্বলতা হয়। তুলির বাবা এই ভয়ে মেয়েকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তুলি তার বাবার আদরের তাই একটু বাইরে তাকে যেতে দেয়াই হয়। তুলির মা তুলির বাইরে যাওয়াটা এই কারনেই পছন্দ করেন না। মাসখানেক আগে কাশবনে অচেতন হয়ে গিয়েছিল তুলি প্রায় দু-ঘন্টা অচেতন ছিল। তাঁকে হন্য হয়ে তার বাবা মা গ্রামবাসী খুজে পেয়েছিল।
সেবার তুলি অনেক অসুস্থ ছিল, মারা যাবার উপক্রম।
তুলির প্রজাপতি অনেক প্রিয় ছিল। কাশবনে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রজাপতি ধরার ব্যর্থ চেষ্টারত থাকতো, না পেলে তার সেকি অভিমান। প্রজাপতি ধরার জন্য বাড়ী পাশের ছোট্ট জঙ্গলে ছোট ছোট ঝোপের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো শিকারীর চোখ নিয়ে কিন্তু প্রজাপতি ও তার মনের কথা বুঝেনা, ধরাও দেয়না। কিন্তু তুলি ত শুধু একটু ধরেই ছেড়ে দেবে! অভিমানে প্রায়ই তার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
তুলি তার বাবাকে বলেছে তার জন্য একটা প্রজাপতি ধরে আনতে! তুলির বাবা তাঁর মেয়েকে না করে না। তাই বাপ মেয়ে মিলে একদিন প্রজাপতি ধরার জন্য বের হলো। সারাদিন খুজে খুজে সন্ধ্যা হবার একটু আগে একটা প্রজাপতি হাতে পেলো। তুলি সেকি খুশি! তুলির বাবা একটা কাঁচের পাত্রে প্রজাপতিটা ঢুকিয়ে মেয়েকে দিলো। বাপ-মেয়ে নাচতে নাচতে বাড়ীতে এসে হাজির।
সেদিন রাতে তুলি ঘুমাতে পারেনি, প্রজাপতিটার সাথে সারারাত কথা বলেছে, তাকে জোর করে হলেও বন্ধু বানিয়েছে, তাকে নানা কবিতা, ছড়া, গল্প শুনিয়েছে। সকাল হতেই বাবা কে প্রশ্ন করলো প্রজাপতি কি খায়? তার বাবা একটু ইতস্তত হয়ে বললো মধু খায়! সঙ্গে সঙ্গে আলমিরাটা খুলে মধুর পাত্র থেকে বেশখানেক মধু নিয়ে সাবধানে প্রজাপতি রাখার পাত্রটা খুলে মধুটুকু ঢেলে দিল! এবার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার পালা প্রজাপতি মধু কখন খাবে!
তুলির মা এসব পাগলামি দেখে একটু বিরক্ত হলেন। তুলিকে বললেন প্রজাপতিটা ছেড়ে দিতে, কিন্তু তুলি তা করবে না। সে তার বন্ধুকে ছাড়বে না। তুলির মা আর কথা না বাড়িয়ে নিজ কাজে মন দিলেন।
সারাদিন প্রজাপতির সাথে খেলার পর ক্লান্ত তুলি আপন মনে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মধ্য তার সাথে ছোট্ট একটা পরীর দেখা। পরীটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমন তার মিষ্টি কথা। তারা একসাথে কাশবনে লুকোচুরি খেললো, নদীপাড়ে জোরে হাসাহাসি করলো, সেকি আনন্দ তার। খেলতে খেলতে হয়রান হবার পর তুলি পরীটাকে প্রশ্ন করলো তুকি কে? তোমার নাম কি? তুমি কোথা থেকে এসেছো? পরী তার প্রশ্নের জবাব দেয় না, শুধু হাসে! তুলি একটু বিরক্ত হলেও পরীর সাথে তার বন্ধুত্ব ভালই লেগেছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রজাপতির সাথে খেলাধুলা শুরু হয়ে গেল। তার বাবা তার এহেন আচরনে খুশি হল কারন তুলি আর বাইরে যায় না সারাদিন ঘরেই থাকে, তাঁর ভয়টাও একটু কমেছে। তুলির মা তার প্রজাপতির সাথে খেলাটা একদমই পছন্দ করেন না।
চলবে........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।