আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধীরে ধীরে পুরোটাই তলিয়ে যাচ্ছি (প্রেমের গল্প)



চিরচেনা সবুজ-শ্যামল গ্রামটি অনেক বদলে গেছে। বদলে গেছে ঠিক না, পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় উন্নয়নকে পরিবর্তনই বলা হয়। দীর্ঘ মেঠোপথটি পিচঢালাই করা হয়েছে, দু পাশে লাগানো হয়েছে সফেদ স্ট্রিট লাইট। বড় বড় গাছগুলোর অধিকাংশই কোথায় হারিয়ে গেছে।

এক সময় রাস্তার দু ধারে বিস্তৃত আবাদি জমি ছিল, সারা বছর সবুজ ধানের শীষ কিংবা নানা শস্যে ভরে থাকত মাঠের পর মাঠ। বাতাসের সাথে ঢেউ তুলে দুলত সোনালী ধানের শীষ। গ্রাম বাংলার সেই অপরূপ দৃশ্য আর বিস্তৃত সবুজের দেখা মিলছে না। আবাদি জমির বুক চিরে গড়ে তোলা হয়েছে কাঁচা বাড়ি কিংবা ইট-পাথরের দালান। দু ধারের নতুন নতুন আবাসন আড়াল করে দিয়েছে সবুজের মুখ।

এসব দেখে অবশ্য জনসংখ্যা বাড়ছে-এ কথা এখন বলা যাবে না। কারণ গত দশকে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমহ্রাসমান। এখন যা বলা প্রয়োজন তা হলো নগরায়নের প্রভাব। হয়তো এখানেও তা-ই ঘটছে। নগরায়নের প্রভাবেই গ্রাম বদলে যাচ্ছে, সবুজের রাজ্য হারিয়ে ইট-পাথরের খাঁচা হয়ে উঠছে দিন দিন।

মাতামুহুরী। আমাদের শৈশবের নদী। এ যেন এক ছলনাময়ী নারী। কতবার যে গতিপথ বদলে নিয়েছে, এ কূল ভেঙে ও কূল গড়তে গড়তে কত মানুষের বাস্তুভিটা কেড়ে নিয়েছে, নিঃস্ব করে দিয়েছে কত অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থকে তার ইয়াত্তা নেই। নিঃস্ব মানুষগুলোর চোখের জলে ও কূলের ধূ ধূ বালুর চর সিক্ত হয়েছে হয়ত, কিন্তু মাতামুহুরীর নিষ্ঠুরতা থামাতে পারেনি কখনোই।

কারণ, ভাঙন যে নদীর ধর্ম! প্রায় দশ বছর পর গ্রামে এসেছি, গ্রামের সবকিছুই আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। গ্রাম বদলে গেছে, গ্রামের মানুষগুলোও বদলে গেছে। অদ্ভূত সব বদলে যাওয়া। ‘মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’-বলেছিলেন মুনীর চৌধুরী। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখছি এখানে।

ইতোমধ্যে বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই সংসার পেতেছে। তারা বউ-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত, কোটিপতি বনেছে অনেকেই। ফোরকানের মেয়েটি এখন ক্লাস ফোর এ পড়ে, নজরুল গত মাসেই কোরোলা ও মার্সিডিজ বেঞ্জের দুটি গাড়ি কিনেছে। তাদের শৌর্য-বীর্যের মাঝে নিজেকে কেমন যেন ‘অপভ্রংশ’ মনে হয়। কেননা, এই দশ বছরে আমার তেমন কিছুই হয়নি।

কেবল মাস্টার্সটা কমপ্লিট করেছি, বন্ধুদের অনেকেই সেটা পারেনি বলেই এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলাম, কিন্তু বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। এর কারণ অনেক। তবে শুধু এটুকুই বলা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন মানুষকে দাস বানিয়েছে, আধুনিক দাসপ্রথা চলছে পুরো পৃথিবীজুড়ে। মানুষকে এখন দাসের মতো ব্যবহার করছে কোম্পানিগুলো, পৃথিবীজুড়ে তাদের জয়জয়কার।

অন্যদিকে মানবাধিকারের ধোঁয়া তুলে কত গলাফাটাফাটি কাণ্ড! এমন দ্বৈত নীতির কর্পোরেট পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা, চারিদিকে সবাই ভণ্ড। প্রকৃতির নির্মল আলো-বাতাসে বেড়ে উঠা এই আমিও ঘর ছেড়েছিলাম উচ্চশিক্ষার আশায় কিন্তু একদিন হয়ে গেলাম বিশ্বায়নের পণ্য। যখনই বুঝতে পারলাম আমাকে দিয়ে হবে না, তখনই চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছি। আমি মুক্ত, ফিরে এসেছি আমার গ্রামে। গ্রামে এসে নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছে আমাকে, কত স্মৃতিঘেরা চারদিক।

বন্ধু নজরুলকে সাথে নিয়ে ঘুরছি এদিক-ওদিক। মাতামুহুরীর ভাঙন দেখতে গেলাম একদিন, নদীর বুকে জেগে উঠা চর দেখছি বিস্ময়ের চোখে। আরেকদিন গেলাম বান্ধবী সার্জিনাদের গ্রামে। এই গ্রামটি ইতিহাসসমৃদ্ধ, কিন্তু এখন সম্ভত ইতিহাসের প্রতিশোধ নেয়ার পালা চলছে। আমি ইতিহাসের ছাত্র হলে এ নিয়ে একটা সমৃদ্ধ গবেষণা কর্ম দাঁড় করাতে পারতাম, কিছু পুরাকীর্তিও খুঁজে পেতাম হয়তো।

পুরো গ্রামটিতেই এখনো একটা জৌলুস-আভিজাত্যের ছাপ। বাড়িগুলো বেশ সাজানো-গোছানো পরিপাটি। মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া সড়কটিও বেশ পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সার্জিনাদের উঠোনজুড়ে জলাবদ্ধতা, কালো থাই গ্লাসে সাজানো বাড়িটির শোভাই ম্লান হয়ে গেছে কিছুটা। সারিবদ্ধভাবে বসানো ইটের উপর পা রেখে আমরা বাড়িটিতে প্রবেশ করি।

সার্জিনাকে দেখেই বুঝলাম, ঘরের আসল শোভা কিসে? সার্জিনার লাস্যময় একটি হাসি পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। আমরা অবাক চোখে তাকাই বদলে যাওয়া মেয়েটির দিকে। চোখে-মুখে উপচে পড়ে চঞ্চলতা। সেই আগের মতোই এখনো কথা বলা শুরু করলে আর কারো কিছু বলার সুযোগ থাকে না। অনর্গল বলে যেতে পারে মেয়েটি।

আমার খুবই ভালো লাগে তার উচ্ছ্বল-চঞ্চলতা। কেননা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে না পারার মতো ব্যর্থতা পৃথিবীতে আরো কিছু হতে পারেনা। অনেক মেয়েই এটা পারে না, সার্জিনা পারে। এ কারণেই প্রথম থেকেই তাকে বেশ ভালো লাগত আমার, বদলে যাওয়া মেয়েটি সেই ভালো লাগার মাত্রা আরো যেন বাড়িয়ে দিল। মনে পড়ে, কলেজ জীবনের শেষের দিকে আমাদের মধ্যে তুমুল মান-অভিমান চলছিল।

এ নিয়ে বেশকিছু চিঠিও আদান-প্রদান হয়েছে। আমি আবেগের তুলিতে কী লিখতাম কী জানি, হয়তো ভাষাগত শৃঙ্খলা ছিল না। এ নিয়ে সার্জিনা বেশ কয়েকটি চিঠিতে আমাকে তীব্র আক্রমণ করে বসে। বেশ কষ্ট হচ্ছিল, তারপরও এক সময় আমি মেনেই নিচ্ছিলাম. ‘আমাদের সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। ’ যেদিন আমাদের বন্ধুত্বটা ভাঙতে বসেছিল সেদিন বিরহ-বেদনার বিভোরে আমার ডায়েরির পাতাজুড়ে কিছু রোমান্টিক ও স্মৃতিময় কথা গেঁথেছিলাম।

সার্জিনাদের বাড়ি থেকে ফিরে সেই পুরনো ডায়েরিটি নিয়ে চোখ বুলাতে শুরু করি- ‘হঠাৎ কোন আষাঢ় কি শ্রাবণে তুমি এসেছিলে। একটা কদমফুল ছিল তোমার হাতে। বর্ষার আহ্বান ছিল, বাইরে তুমুল বৃষ্টির ঝাপটায় পৃথিবীর প্রতিটি বিন্দু-কণা ভিজে একাকার। বৃষ্টির সুর তোমাকে মোহিত করতো জানতাম। আমরা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঝমঝম ছমছম সুর তোলে অঝোরে ঝরছেই বাদল ধারা। তুমি বাইরে হাতটা বাড়িয়ে দিলে একটু ছুঁয়ে দেখবে বলে, তোমার হাতে থাকা কদম ফুলটিও বৃষ্টির ছোঁয়ায় জেগে উঠে। প্রাণহীন জেগে উঠা বড়ই চমৎকার ঠেকে। অসাধারণ রোমান্টিক দৃশ্যের সাথে আমাদের স্মৃতিময় মুহূর্তের লুকোচুরি চলল বেশ কিছুক্ষণ। বৃষ্টির প্রতি তোমার অনাবিল আকর্ষণটা আমাকে ভাবিয়ে তুলত।

কোন জিনিসের প্রতি আকর্ষণটা বেশ অবচেতন বটে। কিন্তু তার মাঝেও অনেকটা কৃত্রিমতা ঢুকে আছে। কোন বিশেষ কারণে, বিশেষ উদ্দেশ্যে সব রকমের রূপ ধারণ করতে পারে কেউ কেউ। প্রকৃতি যেমন অনেকটা হঠাৎ করে বদলে যেতে পারে, বিচিত্র আচরণ করতে পারে তেমনি তোমরাও বদলে যেতে পারো বলেই প্রকৃতির আচরণগুলোর প্রতি তোমাদের এমন মোহ। তোমাদের বিচিত্র খেয়ালের কাছে আমরা পুরুষরা অনেকটা অসহায়।

মনীষীরা এ কারণেই বলেছেন, ‘মেয়েদের মতো এমন নিখুঁত অভিনয় পুরুষরা কখনোই করতে পারে না। ’ অবশ্যই এই পংক্তিতে এসে আমাকে পুরুষবাদী ভাবার দরকার নেই। মনীষীরা অনেক উক্তিই করেছেন, আমার দৃষ্টিভঙ্গি-পর্যবেক্ষণের সাথে এটি মিশে গেছে কেবল। এ দোষ আমার নয়, বাস্তবতার অথবা তোমাদের। অবশ্য তোমার চিঠিগুলোতে অনেক বেশি নারীবাদিতা ছিল।

কিন্তু তোমাকে নারীবাদী ভাবিনি কোনদিন। মনে আছে, আমার উপর রাগ করে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলে তুমি। আমাকে ভদ্র ভাষায় আক্রমণের জন্য তোমার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল। সেখানেই তোমার নারীবাদিতার ছাপ মিলত। সেদিনও তোমাদের ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা।

রুমের বায়ুকোণে বসেছিলে তুমি. ঈশানকোণে ছিল টিভি সেট। তোমার কথা বলার আলাদা ঢং আমার কাছে বরাবরই ভালো লাগত, সেদিনও মোহিত হয়েছি বলেই মুখ ফসকে বলেছি, বায়ু-ঈশান দুই কোণে দুটি টিভি এখন! তবে পাশে বসা বায়ুকোণের জ্যন্ত মানবীর অভিনয়টাই দারুণ। আমার কথায় তোমার চোখে-মুখে একটু বিব্রতকর বিরক্তি-আনন্দ ভেসে উঠেছিল। চেহারায় একইসাথে বিরক্তি ও আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার অসাধারণ শিল্প তুমিই সৃষ্টি করতে পার। মায়াবী দৃশ্যের কারিগর তুমিই- এ রকম টুকরো টুকরো কত স্মৃতি আমাদের! কত কথা বলা হয়েছে তোমাকে।

আজ সবকিছু মিলে গেছে শূন্যতায়। বিদায়, বন্ধু!’ পুরনো ডায়েরির পাতায় কত বছর আগের সার্জিনার জন্য আমার হৃদয়ের ভেতরের কান্নাগুলো আজো বাক্যের তালে জীবন্ত ডানা মেলে আছে। এত বছর পর নতুনভাবে অনুভব করছি সার্জিনাকে, নতুন চোখে দেখছি পুরো শরীরময় অমীংমাংসিত একজন মানবীকে, যার ভেতরে ধীরে ধীরে পুরোটাই তলিয়ে যাচ্ছি আমি। যেন মাতামুহুরীর নতুন চরে ভুল করে চোরাবালুতে পা রেখেছি, হারিয়ে যাচ্ছি চিরদিনের জন্যে। ডুবে যেতে যেতে শঙ্কিত চোখে আৎকে উঠি।

কারণ, বেলা যে পড়ে এল। পড়ন্ত বেলায় আমি এ কী ভাবছি বসে বসে? সাইকোলজিতে হিউম্যান রিলেশন্স নামক একটি বিভাগ আছে। সেখানে মানুষের বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কের উৎপত্তি, ধরন, কারণ ইত্যাদি চিহ্নিত করে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। ওই বিভাগে প্রেম নামক কোন সম্পর্কের অস্তিত্ব নেই। তবে দি প্রবলেমস অব হিউম্যান রিলেলশন্স বিভাগে প্রেমকে একটি ইমোশনাল প্রবলেম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মনোবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অন্তত আমি মানতে বাধ্য যে পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, ইমোশনাল প্রবলেম। আমি এবং সার্জিনা দু জনেই ইমোশনাল এইজটা পেরিয়ে এসেছি, সুতরাং চাইলেই আর ইমোশনাল প্রবলেম বা প্রেমের সৃষ্টি করা যাবে না। বাস্তবতাও তাই। এই সত্য অনুধাবন করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ফিরে যাবো শহরে। আবারো বহুজাতিক কোম্পানির ছায়ায় আশ্রয় নিতে হবে আমাকে।

তারপর, সার্সন রোডে একটি বাড়ি করবো। দু তলা ভবন, চারিদিকে থাকবে ব্যালকনি। দক্ষিণা কিংবা উত্তরী হাওয়ার তালে নেচে উঠবে ব্যালকনির পর্দা। চারুকলা কলেজের কোন চৌকষ ছাত্রকে দিয়ে পুরো বাড়িটিতে কিছু জীবনমুখী পেইন্টিং করাবো, মার্বেল পাথরে খোঁদাই করা নামফলকে লিখা থাকবে ‘কংকার অব সার্জিনা’। রোমান্টিক বাড়িটির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভাবুক পথিকেরা ঠিকই বুঝে নেবে এর অর্থ।

সার্জিনা হয়তো কখনোই বুঝবে না। কারণ, ‘কাব্য দিয়ে প্রেম হয়, প্রেমের বিজয় হয় না। ’

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.