আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুবেল শাহ এর জন্য

ভেঙ্গে পড়ে সাবেকী বিশ্বাস,

@রুবেল- আমার বাবা যৌবনে কবিতা লিখতেন তাঁর প্রায় সব কবিতাই আমার মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। কিন্তু সংসারের করাল গ্রাসে তাঁর কাছ থেকে ধীরে ধীরে কবিতা হারিয়ে যেতে থাকে। আমার শৈশবে ফিরে গেলে দেখি বাবার কোলে বসে আছি, বাবা চমৎকার ঢংয়ে যোগীন্দ্রনাথের কাজের ছেলে দাদখানি চাল মসুরির ডাল চিনি পাতা দৈ/ দুটো পাকা বেল, সরিষার তেল ডিম-ভরা কৈ পড়ে শুনাচ্ছেন। হারাধনের দশটি ছেলে পাঠ কালে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠতো, ব্যথায়, কষ্টে। হারাধনের একটি ছেলে/ কাঁদে ভেউ ভেউ/ মনের দুঃখে বনে গেল/ রইল না আর কেউ।

জীবন যুদ্ধে নামায় হারাধনের শেষ ছেলেটির মতো বাবার কাছ থেকেও হারিয়ে গেল যৌবনের ভালোলাগার অন্যতম ধন কবিতা। পুরনো ফাইল ঘেটে বাবার কবিতাগুলো যখন আমার বড় ভাই আবিস্কার করেন তখন বাবার অপ্রস্তুত মুখ এবং মায়ের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা সেই সময় একটা চমৎকার কবিতারই জন্ম দিয়েছিলো। এখন চিন্তা করে দেখি আমার বাবা শেষ পর্যন্ত দশটি সার্থক কবিতা লিখতে পেরেছিলেন, যে কবিতাগুলো নিয়ে তিনি এখনো গর্ব করেন। তাঁর দশটি সন্তান তাঁর সেই গর্বের কবিতা। আমার বন্ধু কাজল, বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের এবং বড়বোনের পরম মমতায় বড় হয়েছে।

মৌলভীবাজার শহর তখন আমাদের দখলে ছড়া কবিতায় সর্বক্ষণ এ শহরকে মাতিয়ে রাখি। আমাদের দাপট গোটা শহর জুড়ে। সেটা ১৯৯৮৪ সাল, স্বৈরাচারী এরশাদের মন্ত্রী মতিনের ছেলে ঢাকার রাস্তায় গাড়ী চালানো শিখতে গিয়ে রিক্সায় ধাক্কা দিলে ছড়াকার বাপী শাহরিয়ার পড়ে গিয়ে আহত হন। পিজির এক জীর্ণ কক্ষে মৃত্যুর প্রহর গুনে দিন কাটাতে থাকেন। পঙ্গুত্ব জীবন অসহায় বোধ হলে সতির্থরা এগিয়ে আসেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

আমরা কৌশোরের দুরন্ত দিনগুলো ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে এ মহৎ কাজে লেগে যাই। একটা ছেলে কবিতা লিখে তাঁর এ অবস্থা হতে দেয়া যায় না। বাপী শাহরিয়ার আমাদের স্বজন তাঁকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। কি ভাবে সাহায্য করা যায়? সীদ্ধান্ত নেই স্কুল, কলেজ এবং অফিস পাড়া ঘুরে পয়সা সংগ্রহ করার। প্রথম টাকার (একশটাকা) জোগান দেন কাজলের আম্মা এবং বড়বোন।

আহারে! একটা ছেলে কবিতা লেখে তার এমন কষ্ট! আমরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে টাকা সংগ্রহ করি। দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা/ছড়া পাঠের এক অভিনব আয়োজনও আমরা করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৫বছর আগে মফশ্বলের এক শহরে। তের চৌদ্দ বছরের কয়েকটা কিশোরের কি প্রাণশক্তিই না ছিল সে সময়। আমরা প্রায় হাজার দু’য়েক টাকা তুলে জেনারেশন নামের একটা সংগঠনের কাছে পাঠিয়েছিলাম যারা বাপী শাহরিয়ারের চিকিৎসার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলো। বাপী শাহরিয়ারকে বাচানো যায়নি, সাতাশির কোন এক বিকেলে তিনি লিখে ফেলেন মৃত্যু নামের সেই অমোঘ কবিতা।

১৯৮৭সালে বিলেত যাত্রা আমার জন্য ছিলো এক বিরাট ধাক্কা। পরিচিত প্রান্তর উজাড় হলে যা হয়, কিংবা একটা পাখির ডানা কেটে দিলে তার যে ছটফটানি সেটাই আমার ক্ষেত্রে হয়েছিলো । স্বপ্ন ভঙ্গ এবং মনোকষ্ট নিয়ে পাড়ি দেই দীর্ঘ ১০বছর। কিন্তু জন্মের দাগ! মনোকষ্টে কবিতাকে ভুলে থাকতে চাইলেও কবিতা আমাকে ছাড়ে না। শুধু কবিতার কাছাকাছি থাকবো বলেই সব ছেড়েছুড়ে আসি।

ইল্যান্ডের নর্থের একটা শহরে আমি তখন জাকিয়ে বসেছি ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি সব কিছু আমার নাগালের মধ্যেই আছে। একদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বেচে থাকা অসার মনে হয়। পূণঃবার জীবনানন্দ পঠিত হলে অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। কবিতার বিপন্ন বিস্ময়ে আবার আলোড়িত হলে ছেড়ে দেই সবকিছু। শুধু কবিতার কাছাকাছি থাকবো বলে কিংবা কবিতায় থাকবো বলে নর্থ ছেড়ে পাড়ি দেই কবিতার শহর লন্ডনে।

পিছনে পড়ে থাকে দীর্ঘ দশ বছরের শ্রম। প্রিয় রুবেল আপনার মন্তব্যের উত্তরে বলি কবিতার/কবির প্রতি ভালোবাসা আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমি কবিতা সাধনা করে যাচ্ছি, করে যাবো আমৃত্যু, কতটুকু ধরতে পারছি/পারছিনা সে নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই। কবিতায় থাকতে পারছি এটাই মূখ্য বিষয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।